প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ২০:০৯
শুক্রবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা উৎসব
ভক্ত দর্শনে রাস্তায় নামবেন জগন্নাথদেব

আগামীকাল শুক্রবার (২৭ জুন ২০২৫) সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা উৎসব। এদিন তাদের আরাধ্য ভগবান জগন্নাথদেব রাস্তায় নামবেন ভক্ত দর্শনে। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানের ন্যায় চাঁদপুর জেলায়ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে ব্যাপক আয়োজনে রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এ বছর জেলার ২২টি স্থানে ব্যাপকভাবে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা আয়োজন করা হলেও কচুয়া উপজেলার সাচার রথযাত্রা উৎসব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাচারের রথযাত্রার রয়েছে ঐতিহাসিক পরিচিতি। এমন পরিচিতি থাকায় এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব দর্শনে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ভক্ত সমাগম হয়। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই এই স্থানে বিরাট মেলা বসে। যেখানে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সকল ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দেখা মিলে, যা চোখে পড়ার মত। যেসব কিনতে ইচ্ছে না হলেও ধরে দেখতে ইচ্ছে হয়।এ রথযাত্রার নিরাপত্তা রক্ষায় জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও থাকে প্রশংসনীয়।
|আরো খবর
চাঁদপুর শহরেও রথযাত্রা আয়োজনের কমতি নেই। বিশেষ করে পুরাণবাজার সার্বজনীন জগন্নাথ মন্দির ও চাঁদপুর ইসকন মন্দির আয়োজিত রথযাত্রা উৎসবের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে উল্টো রথযাত্রা পর্যন্ত তাদের আয়োজিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো ভক্তদের কাছে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠে। অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পী ব্যতীত রেডিও টিভিসহ দেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হয়। এককথায় রথ উৎসব চলাকালীন জগন্নাথদেবের উপস্থিতি স্থলে ভক্ত সাধারণের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানস্থল মুখরিত হয়ে উঠে। চাঁদপুর শহরস্থ পুরাণবাজার সার্বজনীন শ্রীশ্রী জগন্নাথ মন্দির থেকে বের হয় অত্যাধুনিক ফোল্ডিং রথ। যে রথখানায় আরোহন করেন শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব, ভ্রাতা বলরাম ও ভগ্নি শুভদ্রা মহারাণী। রথখানার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, রথটি ইচ্ছে করলে উচ্চতায় বড়ো বা ছোট করা যায়। প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও জগন্নাথ মন্দির কর্তৃপক্ষ রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে ২৬ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত ৯ দিনব্যাপী ব্যাপক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক ডা. সহদেব দেবনাথ ও অধ্যক্ষ বিশাল গোবিন্দ দাসাধিকারী জানান, জগন্নাথদেব অতি দয়ালু। তিনি কলিহত জীবের মুক্তির লক্ষ্যে এদিন ধরাধামের রাস্তায় নেমে আসবেন এবং রথে চড়ে কর্মব্যস্ত ভক্তদেরকে তাদের মুক্তির লক্ষ্যে দর্শন দেবেন। যা দর্শন করা খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার। তারা বলেন, রথের দিন বিকেলে হাজারো ভক্তের উপস্থিতিতে পুরাণবাজার হরিসভা রোডস্থ জগন্নাথ মন্দির থেকে আমরা জয় জগন্নাথ ধ্বনিযোগে রথযাত্রার বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করবো। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা পুরাণবাজারের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অতিক্রম করে নতুন বাজারের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ধরে জগন্নাথদেবের মাসী বাড়ি অর্থাৎ (কালী বাড়ি) গুন্ডিচা মন্দিরে গিয়ে শেষ হবে। সেখানে সপ্তাহব্যাপী সকাল থেকে রাত অবধি দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায় জগন্নাথ দেবের পূজা, হোম, যজ্ঞ, কীর্তন, ধর্মীয় আলোচনা সভা, প্রসাদ বিতরণ অনুষ্ঠিত হবে এবং উল্টো রথযাত্রার দিন একই নিয়মে আমরা পুনরায় জগন্নাথ, বলরাম, শুভদ্রা মহারাণী আরোহিত সুসজ্জিত রথখানা পুরাণবাজারের জগন্নাথ মন্দিরে নিয়ে আসবো।
রথযাত্রার একই দিনে চাঁদপুর ইসকন মন্দিরও ব্যাপক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রথযাত্রা উৎসব উদযাপন করবে। রথযাত্রার দিন শুক্রবার (২৭ জুন ২০২৫) বিকেলে চাঁদপুর শহরস্থ মুন্সেফ পাড়াস্থ ইসকনের নিজস্ব ভূমিতে গড়ে ওঠা নীলাচল মন্দির থেকে শ্রী জগন্নাথ, ভ্রাতা বলদেব ও ভগ্নি শুভদ্রা মহারাণী অত্যাধুনিক সুসজ্জিত রথে চড়ে ভক্ত দর্শনে রাস্তায় বের হবেন শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। রথখানা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অতিক্রম শেষে পুরাণবাজার ঘোষপাড়াস্থ ইসকন গোবিন্দ মন্দিরে গিয়ে শেষ হবে। এখানেই ভগবান জগন্নাথদেব ভ্রাতা ও ভগ্নিসহ উল্টো রথযাত্রা পর্যন্ত অবস্থান নেবেন এবং পুনরায় ভক্তবৃন্দ পরিবেষ্টিত হয়ে সুসজ্জিত রথে চড়ে উল্টো রথযাত্রার দিন বিকেলে শহরের মুন্সেফপাড়াস্থ নীলাচল ইসকন মন্দিরে ফিরে আসবেন। প্রথম রথযাত্রা থেকে উল্টো রথযাত্রা পর্যন্ত নীলাচল মন্দিরেই সকাল থেকে রাত অবধি রথযাত্রার ধর্মীয় কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। একইভাবে পুরাণবাজার ইসকন মন্দিরেও ধর্মীয় কর্মসূচি পালিত হবে। ইসকন আয়োজিত সকল অনুষ্ঠানে সকলের সানুগ্রহ উপস্থিতি কামনা করেছেন জেলা ইসকন সভাপতি ও ইসকনের অধ্যক্ষ পণ্ডিত জগদানন্দ দাস ব্রহ্মচারী । তিনি সকলকে রণযাত্রার শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। এছাড়াও প্রতি বছরের ন্যায় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নতুনবাজার গোপাল জিউড় আখড়া থেকেও রথযাত্রা বের হবে। অনুষ্ঠিত হবে পুরাণবাজার হরিসভা শ্রীশ্রী মদন মোহন মন্দির কমপ্লেক্সের রথযাত্রাও। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে পুরাণবাজারবাসীর আনন্দের শেষ নেই। পড়ন্ত বিকেলে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষগণ সম্মিলিতভাবে যোগ দেন পুরাণবাজারের এই রথযাত্রা উৎসবে। তাদের উপস্থিতি আর জয় জগন্নাথ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে হরিসভা মন্দির কমপ্লেক্স। এছাড়াও রথযাত্রা উপলক্ষে পুরাণবাজার শ্রীশ্রী রাধা মুরারী মোহন জিউড় মন্দিরে সকাল থেকে মঙ্গল আরতি, দর্শন আরতি, গুরু পূজা, ভোগ আরতি, জগন্নাথদেবের রাজবেশ দর্শন, প্রসাদ বিতরণসহ ব্যাপক ধর্মীয় উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। এদিন পুরাণবাজার দাসপাড়া শিব মন্দির, নতুনবাজার কুণ্ডের বাড়ি দুর্গা মন্দিরসহ জেলার বিভিন্ন মন্দিরে রথযাত্রা উপলক্ষে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালিত হবে।
শান্তিপূর্ণভাবে রথযাত্রা সম্পন্নে গত ২১ জুন ২০২৫ (শনিবার) প্রথমবারের মতো পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব, পিপিএম তাঁর কার্যালয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভা করেন। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে রথযাত্রা উৎসব সস্পন্নে নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ প্রশাসন সকল প্রকার ব্যাবস্থা গ্রহন করবে। আপনারা নিশ্চিন্তে আপনাদের সকল ধর্মীয় উৎসব উদযাপন করবেন। পুলিশ প্রশাসন সর্বান্তকরণে আপনাদের পাশে রয়েছে। তিনি এই ব্যাপারে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চাঁদপুর জেলা সভাপতি সুভাষ চন্দ্র রায় ও সাধারণ সম্পাদক তমাল কুমার ঘোষ সকলকে রথযাত্রার শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। তারা বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জেলা চাঁদপুর। জেলার সকল ধর্মের মানুষই অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। বিগত দিনগুলোতে উৎসব উদযাপনসহ সকল কাজেই আমরা প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সকলের সহযোগিতা পেয়ে আসছি। আশা করি তাদের সেই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। নেতৃবৃন্দ শান্তিপূর্ণভাবে রথযাত্রা উৎসব সম্পন্নে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, কর্মব্যস্ত মানুষের পাপ হরণে তাদেরকে দর্শন দিতে ভগবান জগন্নাথদেব এই দিন সুসজ্জিত রথে চড়ে রাস্তায় নেমে আসেন ভ্রাতা বলদেব ও ভগ্নি শুভদ্রা মহারাণীকে সাথে নিয়ে। আর জগন্নাথদেবকে কাছে পেয়ে ভক্তগণও আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন। তারা ভগবান আরোহিত রথখানা ধরে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যান আর মনের উল্লাসে জয় জগন্নাথ ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত করে তোলেন। তাদের বিশ্বাস, জগন্নাথদেবের রথ বা রথের দড়ির স্পর্শে সকল পাপের বিনাশ হবে এবং দুঃখ, কষ্ট, জরা, ব্যাধিসহ সকল দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাবে। তাদের আর এই নশ্বর দেহ নিয়ে পৃথিবীতে পুনঃ জন্ম হবে না। কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলে বস্তু তর্কে বহু দূর। এই দিন ভক্তগণ রথে আরোহিত জগন্নাথদেবকে কলা, কাঁঠালসহ নানা ফল দ্বারা সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করেন। তবে রথে থাকা জগন্নাথদেবের ফল, প্রসাদ ভক্তদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়।
জানা যায়, ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরীধামে বিশালাকার পরিবেশে ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়। সেই স্থানে অনুষ্ঠিত রথযাত্রার রয়েছে অলৌকিক কাহিনী, যা রীতিমত অবাক হওয়ার মত। সনাতনী ভক্তবৃন্দ অনেকেই পুরীর জগন্নাথধাম দর্শন করার অভিপ্রায় থাকলেও সময় স্বল্পতা, কর্মব্যস্ততা, আর্থিক সমস্যা, ভিসা জটিলতাসহ নানা কারণে সেই স্থানে যেতে না পারায় দেশেই ব্যাপক আয়োজনে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার আয়োজন করে থাকেন। তারা মনে করেন, চলমান রথের চাকার মতোই জীবন চলার চাকা একদিন থেমে যাবে, আর জগন্নাথদেবের রথই তাদেরকে তাদের আরাধ্য ভগবানের কাছে পৌঁছে দেবে। পুরীতে রথযাত্রায় বিশালকার ৩টি রথ রাস্তায় নামে। একটিতে ভগবান জগন্নাথদেব আর অপর দুটিতে ভ্রাতা বলদেব আর ভগ্নি শুভদ্রা মহারাণী আরোহন করেন। বিশালাকার এই রথ নির্মাণেও রয়েছে অলৌকিক কাহিনী। এই রথ নির্মাণে ১৪ শ' নির্মাণ শিল্পী কাজ করেন এবং রথের বিশালাকার চাকা থেকে শুরু করে রথ নির্মাণে ব্যবহৃত হয় না লোহা, প্যারেক, জিনারি, গজাল, হাতুড়ি, বাটাল, করাতসহ কোনো প্রকার ধাতব নির্মাণ সামগ্রী বা যন্ত্রপাতি। নিমকাষ্ঠের তৈরি বিশালাকার এই রথ তৈরিতে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি যন্ত্রপাতিই ব্যবহৃত হয়, যা রীতিমত আশ্চর্যজনক ঘটনা বলেই মনে হয়। ধারণা করা হয়, রথের পূর্বে ভগবান জগন্নাথদেবই বিশ্বকর্মাকে দিয়ে এই রথ নির্মাণ করে থাকেন। যাতে চড়ে জগন্নাথদেব ভক্ত দর্শনে রাস্তায় নামেন। নির্মাণ শিল্পীগণ এক্ষেত্রে উপলক্ষ মাত্র।