প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক আমল
মাওলানা আবদুল জাব্বার
ইমানদার ব্যক্তি ইমান ও ইসলামি আকিদা মোতাবেক প্রত্যেকটি কাজ করবেন, তাই ইমান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা কোরআনের ৭২০ জায়গায় ইমানের উল্লেখ করেছেন। ইমানের সঙ্গে আমলের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ইমান ছাড়া নেক আমল যেমন গ্রহণযোগ্য হয় না, ঠিক তেমনি নেক আমল ছাড়া ইমানও আল্লাহর কাছে গৃহীত হয় না। মানুষের দুনিয়ার জীবনের আমল দুই ভাগে বিভক্ত। ক. ভালো আমল যা মানুষের ইমানের সহায়ক, আর এসব আমলের মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হন। খ. খারাপ আমল যা মানুষের ইমান ধ্বংস করে। এখানে কোরআন-হাদিসের আলোকে ইমান বৃদ্ধিকারী কয়েকটি আমলের কথা উল্লেখ করা হলো
জীবনব্যবস্থা : একজন মুমিন তার জীবনে একমাত্র ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করবে। আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে মেনে নেবে এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর হুকুম-আহকাম মেনে চলবে। মহান আল্লাহ সব মানুষ ও জিনকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার ইবাদতের জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘আর জিন ও মানুষকে কেবল এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদত করবে।’ সুরা জারিয়াত : ৫৬
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন ও ইমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে খুঁটিতে বাঁধা ঘোড়ার মতো। যত দূর তার দড়িতে ঠাঁই পায় ততটুকু সে যায়, আবার খুঁটির কাছে ফিরে আসে। সে ভুল করে, অতঃপর আবার ইমানের দিকে ফিরে আসে।’ মুসনাদে আহমদ
পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ : ইমানের জন্য সহায়ক ও ইমান বৃদ্ধিকারী আমলের অন্যতম হচ্ছে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ। আল্লাহর ইবাদতের পরই কোরআনে কারিমে পিতা-মাতার হক আদায়ের ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না। আর তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো। আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বলো, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।’ সুরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪
হজরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় মলিন হোক, ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় মলিন হোক, ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় মলিন হোক। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, ওই ব্যক্তি কে ইয়া রাসুলুল্লাহ! তিনি জবাবে বললেন, যে তার পিতা-মাতার উভয়ের একজনকে অথবা উভয়কেই বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, অথচ সে বেহেশতে গমন করতে পারল না।’ সহিহ্ মুসলিম
নামাজ ও কল্যাণকর কাজ : নামাজ কায়েম করা আল্লাহ র্কর্তৃক নির্ধারিত ফরজ। মুমিন নামাজের পাবন্দির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করবে। কোরআনে কারিমের ৮২ স্থানে নামাজ কায়েম ও জাকাত প্রদানের ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নামাজের মধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক বাড়ে এবং সব ধরনের অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা যায়। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর বান্দা ও কাফেরদের মধ্যে পার্থক্যকারী হচ্ছে নামাজ।’ তিরমিজি
নামাজের পর একজন মুমিনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সব সময় আল্লাহকে ভয় করে সব কাজ সম্পাদন করা। এ সম্পর্কে হজরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তুমি যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং অসৎ কর্মের পর সৎ কর্ম করো। তবে পুণ্যকর্ম মন্দ কর্মকে মিটিয়ে দেবে। আর মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করো।’ তিরমিজি
সত্য বলা : একজন মুসলিম সব অবস্থায় সত্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং সমাজজীবনে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ সুরা তাওবা : ১১৯
সত্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে নবী কারিম (সাঃ) বলেছেন, ‘তুমি সব সময় সত্য কথা বলবে যদি সেটা তিক্তও হয়।’ বায়হাকি, শোয়াবুল ইমান
ধৈর্য অবলম্বন : মুমিন জীবনে ইমান বৃদ্ধিকারী আমলের অন্যতম হচ্ছে ধৈর্য। মুমিন জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র, বিরোধিতা, বিপদ-আপদ ও মুসিবতে ঘেরা। এ সব বিপদ-মুসিবত আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে তাই এমন পরিস্থিতিতে মুমিনকে আল্লাহর ওপরে ভরসা করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর
আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদের যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।’ সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৬
বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য অবলম্বনকারী আল্লাহর সান্নিধ্য পায়। বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য অবলম্বন করলে প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ মুমিনের জীবনে ঘটে যাওয়া পাপসমূহ ক্ষমা করে দেন। এ সম্পর্কে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন নর-নারীর জীবনে সন্তানসন্ততি ও ধন-সম্পদের ওপর বালা-মুসিবত আসতেই থাকে। অবশেষে সে আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করে যে, তার আর কোনো পাপ থাকে না।’ তিরমিজি
অন্যের ত্রুটি গোপন করা : একজন মুমিন আরেকজন মুমিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, বিপদে তার সহযোগিতা করবে এবং সব সময় তার কল্যাণকামী বন্ধু হিসেবে কাজ করবে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘পারস্পরিক মহব্বত, দয়া-অনুগ্রহ ও স্নেহ-মমতার দৃষ্টিকোণ থেকে সব মুমিনের দৃষ্টান্ত হচ্ছে একটি দেহ সদৃশ। যদি দেহের কোনো অংশ অসুস্থ হয়, তবে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই জ্বর ও অনিদ্রা অনুভব করে।’ সহিহ্ বোখারি
এ কারণে একজন মুসলিম অন্য মুসলিমের দোষ-ত্রুটি মানুষের কাছে বলে বেড়াবে না বরং তা সব সময় গোপন রাখবে। তার মনে কষ্ট দেবে না এবং তার ক্ষতি সাধনের চেষ্টাও করবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব।’ সুরা নুর : ১৯
বর্ণিত আয়াতের আলোকে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, একজন মুসলিম যদি অন্য মুসলিমের দোষ-ত্রুটি মানুষের সামনে বলে বেড়ায় তাহলে এর প্রভাবে সমাজে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়তে পারে, যার ফলে সমাজজীবনে নৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য হজরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে গোলাম অপর গোলামের দোষ-ত্রুটি এ পার্থিব জগতে গোপন রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।’ সহিহ্ মুসলিম
বিবাদ মীমাংসা করা : ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছে। তাই মুসলমানদের মধ্যে বিবদমান সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তাদের ওপরেই অর্পণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে।’ সুরা হুজুরাত : ১০
হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘দ্বীন হচ্ছে কল্যাণকামিতা। আমরা বললাম, কার জন্য? তিনি বললেন, আল্লাহ, তার কিতাব, তার রাসুল, মুসলিমদের ইমাম (নেতা) এবং সব মুসলিমের জন্য।’ সহিহ্ মুসলিম
আত্মীয়তার সম্পর্ক : আল্লাহতায়ালা তার ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে পিতা-মাতা, কাছে-আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীর হক আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছেন মেহমানের সম্মান ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার। এ সবের মাধ্যমে একজনের সঙ্গে অন্যজনের সম্পর্ক অটুট হয়, সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত হয়। এসবই ইমানের সহায়ক ও ইমান বৃদ্ধিকারী গুরুত্বপূর্ণ আমল। এক হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর ইমান রাখে সে যেন অবশ্যই মেহমানকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ইমান রাখে সে অবশ্যই আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখবে।’সহিহ্ বোখারি
হালাল জীবিকা উপার্জন : কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে অনুসন্ধান করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।’ সুরা জুমা : ১০
মহান আল্লাহ এখানে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বিশেষকে উদ্দেশ্য করেননি বরং সব মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা জমিনে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা কর। নিজের হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ। হালাল রিজিক উপার্জন, হালাল রিজিক ভক্ষণ একজন মুমিনের ইমানকে বৃদ্ধি করে। আর হারাম ভক্ষণকারী বান্দার কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। তাই মুমিনের দায়িত্ব হালাল উপার্জন এবং হারাম উপার্জন পরিহার করা। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘নিজের হাতে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম জীবিকা কেউ কখনো ভোগ করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) স্বহস্তে উপার্জিত সম্পদই ভোগ করতেন।’ সহিহ্ বোখারি
শিক্ষকের সম্মান : একজন মুমিনের দায়িত্ব হচ্ছে দ্বীনের যথার্থ জ্ঞান অর্জন করা এবং যার কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছে সেই শিক্ষককে সম্মান করা। এ সম্পর্কে হজরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা কর, দ্বীনের জ্ঞান অর্জন কর, প্রশান্তিও মর্যাদাবোধের জ্ঞান শিক্ষা কর এবং যার থেকে তোমরা ইলম শিক্ষা কর তাকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি কর।’ আল মুজামুল আওসাত ও আল মুজামুল কুবরা
সন্তানদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার : মুমিন তার সন্তানদের দ্বীনের জ্ঞানের পাশাপাশি শিরক-বেদায়াত থেকে বেঁচে থাকার জ্ঞান শিক্ষা দেবে এবং একজন খাঁটি ইমানদার হিসেবে তৈরি করার চেষ্টা করবে। সেই সঙ্গে তাদের আদর-যত্ন ও লালন-পালনে কোনো ত্রুটি করবে না, তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ ও ব্যবহার করবে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের সন্তানদের সঙ্গে কোমল ব্যবহার কর এবং তাদের উত্তম তালিম ও তারবিয়াত প্রদান কর।’ ইবনে মাজা
এভাবে ঋণগ্রস্তকে সহযোগিতা, শ্রমিকের মজুরি ঘাম শুকানোর আগেই পরিশোধ, মানুষকে সৎ পরামর্শ প্রদান, বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ, নারীদের প্রতি ভালো আচরণ, জাকাত আদায় ও আল্লাহকে করজে হাসানা প্রদান, রমজানের রোজা পালন, সামর্থ্য থাকলে হজ পালন, আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ ও জামাতবদ্ধ জীবনযাপন, মানুষদের আল্লাহর দিকে ডাকা, নিজের কাছে রক্ষিত আমানতসমূহ আদায়, পরিবার-পরিজনকে ইসলামের পথে পরিচালিত করা, সুন্নতের হেফাজত এবং আমল, ইসলামের ওপর অটুট থাকা, পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ভালো আচরণ, গরিব-মিসকিনের অধিকার আদায়, সন্দেহজনক কাজ বর্জন, অসহায়কে সাহায্য, স্ত্রীকে দেনমোহর আদায় এবং কৃত অঙ্গীকারসমূহ পূরণ করাও নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। এসব আমল মুমিনের ইমানকে বৃদ্ধি করে। এছাড়া আরও কিছু আমল রয়েছে যা বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে ভালো না মন্দ তা অনুধাবন করা যায়। সেগুলোর ভালোটা গ্রহণ করা মন্দটা পরিত্যাগ করা উচিত।