প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছোটগল্প : অনালোকিত জীবন সমাচার
সৌম্য সালেক
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর বহুল গঠিত ও চর্চিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের জন্য বাংলা সাহিত্যে অমরতা লাভ করেছেন। ভাষাশৈলী, অকৃত্রিম জীবন গ্রন্থনা, সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি ও অনালোকিত ধীবর সমাজের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি নির্মাণসহ সার্বিক শিল্পগুণে অনন্য এই আখ্যান বাংলা সাহিত্যের অনিবার্য পাঠ। তিতাস ছাড়াও তিনি আরও তিনটি উপন্যাস রচনা করেছেন। আমাদের এ পর্যালোচনার বিষয়বস্তু তাঁর ছোটগল্প। এ যাবৎ তাঁর লেখা মাত্র দশটি ছোটগল্পের সন্ধান পাওয়া গেছে। গল্পগুলোর মধ্যে কিছু অভিনব নিরীক্ষার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। মানুষের জীবন ভাবনায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে গেলে যে আত্মগত অনুসন্ধিৎসা প্রয়োজন, তাঁর গল্পে পাওয়া যায় তেমনই জীবন মাধুর্যের সারাৎসার।
|আরো খবর
অদ্বৈত’কে নিয়ে সাজানো অধিকাংশ সংকলন ও রচনাবলিতে যে পাঁচটি গল্প পাওয়া যায়, সেগুলো হলো : বন্দী বিহঙ্গ, সন্তানিকা, কান্না, স্পর্শদোষ এবং সাগর তীর্থে। সম্প্রতি উদ্ধারকৃত ‘বিস্ময়’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘নবশক্তি’র অগ্রহায়ণ-১৩৪৩ সংখ্যায় ও পরবর্তীতে ‘এবং এই সময়’ শারদ- ১৪১১ বিশেষ সংখ্যায়। ‘জাল ফেলা-জাল তোলা’ গল্পটি আনন্দবাজার পত্রিকা : ০২.০৬.১৯৪৬ সংখ্যায় পত্রস্থ হয়। ‘তমোনাশের মন’ ছাপা হয় আনন্দবাজার পত্রিকায় ১১.০৮.১৯৪৬ এবং পরবর্তীতে শান্তনু কায়সার সম্পাদিত সমতট-এর মে ২০১৫ সংখ্যায় ছাপা হয়, সেখান থেকেই গল্পটি প্রথম পাঠের সুযোগ পাই। ‘আশালতার মৃত্যু’ ছাপা হয় ‘একাল শরদীয়া’-১৩৫৫ সংখ্যায় এবং ‘সাঁঝের মজলিস গানের মূল্য’ গল্পটির সন্ধান পাওয়া যায় ‘মাসপয়লা’-১৩৩৫ সংখ্যায়। অদ্বৈত মল্লবর্মণ সযতেœ তাঁর লেখাপত্র সংরক্ষণ করেননি, তাঁর জীবনকালীন সময়ের সাময়িকপত্রগুলো ঠিকভাবে পরীক্ষা করা হলে এমন আরো দু-একটি গল্প হয়ত পাওয়া যাবে। সবক’টি গল্পের মধ্যেই বিষয় নির্বাচন, ভাষাশৈলী, দৃষ্টির সম্পন্নতা ও চরিত্রচিত্রণে লেখকের স্বাতন্ত্র্য দৃশ্যমান। এখানে স্বল্প-আয়তনে গল্পগুলো সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।
‘বিস্ময়' এবং ‘তমোনাশের মন’-গল্প দুটোকে বিপ্রতীপ বলা চলে। এমন অভিনব নিরীক্ষা কোথাও পাইনি। ‘বিস্ময়' গল্পের নায়ক শ্রীপতি আর তমোনাশের মন-এর ‘তমোনাশ’। বিস্ময়-এর শ্রীপতি বিপত্নীক কিন্তু তমোনাশ ছিল অবিবাহিত। দুটো গল্পেরই নায়িকা বিনোদিনী, দুটো গল্পেই সে পুরানো দিনের বিচ্ছেদী গান করে আপন মনে। দুটো গল্পের নায়কই রেলের টিকিট কালেক্টর, তাদের মনের গতি ও পরিবর্তন প্রবণতা এবং দ্বন্দ্ব প্রায় একই। অর্থাৎ একই পটভূমির উপরে দুটো গল্প, দুটো গল্পই সুখপাঠ্য ও অসাধরণ শিল্পবোধে চালিত। শ্রীপতির বিনোদিনীর গান শ্রবণের সময়কালে লেখকের উপস্থাপনা এমন : ‘কোন বিস্মৃত যুগে অমার্জিতরুচি পল্লীকবি এই গান রচনা করিয়া গিয়াছে। সেও কি অন্তরে এমন ব্যথার বোঝা বহিতে বহিতেই এই গান বাঁধিয়াছিল? বিশেষ করিয়া সে কি একমাত্র শ্রীপতির জন্যই ইহা রাখিয়া গিয়াছে!’ এখানে তমোনাশের বর্ণনা থেকেও কিঞ্চিৎ শোনা প্রয়োজন : ‘নৈরাশ্য কি তার সারা জীবনের আকাশ থেকে সবটুকু আলো কেড়েকুড়ে নিয়ে নীরন্ধ্র অন্ধকারে তার ইহ-পরকাল লেপেপুঁছে একাকার করে দিয়েছে! কিন্তু তার মনে কি কামনার শেষ নেই, কান্নার কি সমাপ্তি নেই। তার ভাঙা কপালের টুকরোগুলো তো মনের অনুভূতির বৈচিত্র্য একটুও মলিন করতে পারেনি? এক একটা গানের বাঁধা কথা ও বাঁধা সুরের ভেতর দিয়ে যেন হাজার রকমের অনুভূতি আত্মপ্রকাশ করছে।’ এই বিরহী নারীর গীত সম্পর্কে শুনতে গিয়ে মনে পড়ে গেলো William Wordsworth -এর ‘নিঃসঙ্গ শস্যকর্তনকারিণী’র কথা, যে পাহাড়ের পাদদেশে একা একা শস্য কাটে আর পুরানো গান গায়।
`I saw her singing at her work
And o`er the sickle bending
I listened motionless and still;
And, As I mounted up the hill
The music in my heart I bore
Long after it was heard no more.'
শ্রীপতি তার স্ত্রী সরযূকে খুব ভালোবাসতো। বিনোদিনীর গানে মুগ্ধ হয়ে পরবর্তীতে সে তাকে বিয়ে করে। বিয়ের পরে যখন সে বিনোদিনীর গান শুনতে চায় তখন বিনোদিনী বলে : ‘সে সব অলুক্ষুণে গান আমি ভুলে গেছি।’ শ্রীপতি অনুতাপে দগ্ধ হয় এবং সরযুর ফটো বুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে, কিন্তু বিনোদিনী বুঝতে পারে না তার অপরাধ কোথায়, এভাবে সমাপ্তি ঘটে ‘বিস্ময়’ গল্পের। তমোনাশের ঘটনাও প্রায় একই : সে বিনোদিনীর গানে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেছে, কিন্তু বিনোদিনী বিয়ের পর তার সুর হারিয়ে ফেলে। তমোনাশ আত্মপীড়ায় ভোগে, লেখক তার মানসিক অবস্থাকে এক দার্শনিক প্রশ্নে নিবদ্ধ করে গল্প শেষ করেন : ‘জলের উপর চাঁদণ্ডসূর্যের খেলা আর আত্মসমর্পিত নারীর বুকে পুরুষের খেয়ালি মনের ঢেউ তোলা- দুই-ই সমান অকিঞ্চিৎকর, সমান অবান্তর। এ আর ক’দিন একটা মনকে বেঁধে রাখতে পারে। গভীর সত্য কী এমন আছে তাতে? তমোনাশ এখানে আর থাকতে পারবে না, সবকিছু ছেড়ে সে অন্য কোথাও চলে যাবে।’
‘জাল ফেলা-জাল তোলা’ এক ব্যথাতুর গল্প। জীবনের মধ্যে বেদনার অবস্থিতি এখানে জান্তব হয়ে উঠেছে। নইদাবাসী ও গৌরাঙ্গসুন্দর, তাদের দুই ভাইয়ের সংসার। একজন মাছ ধরে, অন্যজন মাছ বেচে এবং এভাবেই তাদের সংসার চলত। তারপর ‘ভাসার ক্ষেপ’-এর মাছ বেচে একসময় বড়ভাই নইদাবাসী জমি কেনে এবং মাছ ধরা ছেড়ে দেয়। মাছ ধরা ছেড়ে দিয়ে নইদাবাসী হালচাষ আরম্ভ করে, এক সময় তার সাথে জেলেদের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং তাকে সমাজচ্যুত করা হয়। পরবর্তীতে সে এক জেলের ঘরের মেয়েকেই তিনশো পঞ্চাশ টাকা পণ দিয়ে বিয়ে করে ফিশারি ব্যাংকে জমি বন্ধক রাখে। ছোট ভাই গৌরাঙ্গ তাকে কোনো সাহায্য না করলে, সে তাকে বলে ‘তোর মাথায় এ জীবনে শোলার মটুক উঠবে না রে গৌরা, এই আমি কইয়া রাখলাম।’ এর কিছুকাল পরেই পঞ্চাশের মন্বন্তর আসে। দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষ মারা যায়। গৌরাঙ্গের ভাই-ভাবীও মারা যায়। পড়শিরা দুজনকে, আগে যে জমিটি তাদের ছিল, সে জমির আলের ওপর শুইয়ে চিতা জ্বেলেছিল। তখন চারিদিক শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু। সেই চরম সময়েই এক মেয়ের সাথে ভাব হয় গৌরাঙ্গের, বিয়ে করতে পণ দেয়া সংক্রান্ত সমস্যা না থাকলে নববধূকে কী খাওয়াবে এই চিন্তা করে সে বিয়ে করা থেকে বিরত থাকে। একদিন সেই মেয়ে তাকে বলেছিল : ‘দেখবে আমি নিজেই তোমার কাছে এসে হাজির হব, সেদিন কিন্তু তাড়াতে পারবে না।’ শেষে আসলে তা-ই হলো। এক গভীর রাতে জাল টেনে সে দেখতে পেলো : ‘জালের কাঠিগুলোর কাছে যে সাঁতার কাটত লীলাচ্ছলে, তারই মৃতদেহ এসেছে ভেসে।’ পঞ্চাশের মন্বন্তরের চিত্র এই গল্পে অত্যন্ত ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে : ‘অনাহারে শুকিয়ে শুকিয়ে এক এক পরিবার থেকে এক একজন খসে যাচ্ছে। নিরূপায় দুঃখের কবল থেকে রেহাই পেয়ে গেল বলে, যারা যাচ্ছে তাদের জন্যে কেউ শোক করে না। যারা আপাতত রয়ে গেল, তাদের নির্বাক শোকের মধ্যেও যেন বিগত প্রাণের জন্যে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। এখন সংসার থেকে যাওয়াটাই যেন কাম্য, অনাহারে শুকিয়ে বেঁচে থাকাটা যেন মর্মান্তিক যন্ত্রণাদায়ক, অবাঞ্ছনীয়।’ এই গুল্পের মধ্যে অদ্বৈতের যাপিত জীবনের ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। দুঃখময় জীবনের অনুপুঙ্খ গ্রন্থনা, ভালোবাসা এবং অনুভূতির গভীর প্রকাশ সব মিলিয়ে ‘জাল ফেলা জাল তোলা’ গল্পটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের অসাধারণ এক ছোটগল্প।
‘আশালতার মৃত্যু’ গল্পটিও অদ্বৈত মল্লবর্মণের একটি নিরীক্ষামূলক কাজ। আশালতা না¤œী তিন নারীর মৃত্যু ও আত্মহত্যার তিনটি কাহিনী রয়েছে এ গল্পে-অনেকটা প্রতিবেদনের আকারে। এই তিন আশালতারই সুখের শৈশব ছিল, তাদের বিয়ে হয়েছিল ধুমধাম করে, কিন্তু বিয়ের কিছুকাল পরেই দেখা দিয়েছিল দুর্ভিক্ষ। একজন না খেতে পেয়ে মারা যায়, একজন বস্ত্রের অভাবে আত্মহত্যা করে এবং তৃতীয় আশালতাও তার শিশু সন্তানদের দুরবস্থা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। তিনটি খবরই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর তদন্তে তৎকালীন সরকার যে ভাষ্য প্রকাশ করে তা ছিল অদ্ভূত! সমাজে রাষ্ট্রে আজও এমন জঘন্য পর্যবেক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে, যা সম্পূর্ণরূপে বস্তুনিষ্ঠতাবহির্ভূত। এখানে একটি ভাষ্য পাঠ করতে চাই : ‘আশালতা মারা গিয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু না খেয়ে মারা গিয়েছে এ কথা মিথ্যা। আসলে তার মাথা খারাপ ছিল এবং অত্যধিক খাওয়ার ফলে দম আটকে গিয়ে সে মারা যায়। কিছুদিন থেকে সে আবার জ্বরেও ভুগেছিল।’
‘সাঁঝের মজলিস গানের মূল্য’ একটি হাস্যরসাত্মক গল্প। এক জোলা বাজার থেকে পাঁচ টাকা দিয়ে গান কিনে আনতে যায়। লোকে তাকে বলে, গান পয়সায় বাজারে বিকোবার জিনিস নয় রে বোকা। কিন্তু অন্য এক চতুর দোকানি তাকে একবারের জন্য মুখে মুখে অদ্ভুত কিছু ছড়া শিখিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, সেও সেসব দ্রুত মুখস্থ করে বাড়ি আসে। লোকে বিনা দামে তার গান শুনে যাবে এজন্যে সে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে গোয়াল ঘরে আশ্রয় নেয় এবং গান আরম্ভ করে : ‘খপ খপাখপ কাটিছে, থেকো সব চুপ/বটীখানা রাখবে ধরে, যেমনি ঢুকবে অমনি ঘাড়ে/ মারবে বেজায় কোপ।’ এদিকে চোর চুরি করতে এসে এই কথা শুনে ভড়কে যায়। গান চলতে থাকে এবং ঠিক তা চোরের অবস্থান অনুসারে, চোর চরম ভয় পায় এবং ধরা পড়ে। কিন্তু জোলা মহাবিরক্ত এজন্য যে, তার পাঁচ টাকার কেনা গান অন্যেরা এমনকি চোর শুদ্ধ বিনা পয়সায় শুনে গেলো, এটাই তার বড় দুঃখ।
‘সাগর তীর্থে’ গল্পটিতে উঠে এসেছে তীর্থ দেখতে এসে বহু লোকের অপমৃত্যুর কথা। জাহাজে ও বিভিন্ন বাহনে চড়ে সেবার বহু মানুষ জড়ো হয়েছিল ডায়মন্ডহারবারের জাহাজ ঘাটায়। মানুষের ভিড় ও হুড়াহুড়ির মাঝে জেটি ভেঙে বহু মানুষ সেখানে নিহত হয়। লেখকের ও তার সহগামীদের তীর্থ দেখার ইচ্ছে একেবারেই দমে যায় এই দুর্ঘটনায়। সেটা ছিল কপিল মুনির তপস্যা-ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তীর্থস্থান। কিছু মানুষ বিভিন্ন তীর্থ ও মাজারকে কেন্দ্র করে যে বিভিন্ন বৈষয়িক উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত তার চিত্রও এ গল্পে সংবাদণ্ডপ্রতিবেদনের মতো করে তুলে ধরা হয়েছে।
‘স্পর্শদোষ’ গল্পের মধ্যে দুঃখপীড়িত মানুষ ও প্রাণীর অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে; মন্বন্তরকালীন সময়ের দুঃখ-যন্ত্রণার আরেক মর্মান্তিক অধ্যায় এই গল্প। দুঃখ ও দারিদ্র্য সম্পর্কিত অভিব্যক্তির মাধ্যমে সূচনা হয় গল্পের, এখানে সামান্য পাঠ তুলে ধরছি : ‘পল্লীর যে বধূ শাশুড়ির গঞ্জনা মাত্র ভক্ষণ করিয়া পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত উদরটাকে দিনের পর দিন শূন্য রাখিয়া নির্বিবাদে চলে তাহাকে দেখিয়া যতটা ব্যথা পাই না, যে বৌ শাশুড়ি রক্ষিত সুখাদ্য চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়ে, সে আমাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করে বেশি।’ ভজা ও খেঁকী দুজনেই পথে কুড়িয়ে খায়, ভজা মানুষের নাম, খেঁকী কুকুর। ভজা নানা ভঙ্গিতে খেঁকীকে উত্ত্যক্ত করে, এতেই যেন তার প্রতিদিনের শান্তি। তার এই অত্যাচারে দিন দিন খেঁকী দুর্বল হয়ে পড়ে। একদিন কুকুরটি এক বড়লোকের বাড়ির আগাছার আড়ালে আশ্রয় নেয়। খুঁজতে খুঁজতে সেখানে গিয়ে হাজির হয় ভজা, এবার ভজাকে দেখেই খেঁকীর মস্তিষ্ক গরম হয়ে যায়। ভজা ‘ঘেউ’ করার পূর্বেই কুকুরটি দৌড়ে গিয়ে এক পথচারীর পা কামড়ে দিয়ে চলে যায়। পরদিন লোকেরা কুকুরটিকে হত্যা করে, জমাট রক্ত তখনও তার দেহে ও পথে লেগে আছে। ভজা ক্ষুদ্র জনতার ভিড় ঠেলে সেখানে যায়, তার খেঁকীকে চিনতে অসুবিধা হয় না। ‘তারপর বিস্মিত স্তম্ভিত জনতাকে ভাবিবার অবসর না দিয়ে সে খেঁকীকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া নীরবে চলে যায়। জনতার মধ্য হইতে একজন হিন্দুস্থানী আধা বাংলায় শুধু বলিল, এ ভি পাগল হোয়ে গেছে।’
‘কান্না’ গল্প শেষ হয় গুরুদয়ালের অরণ্যে রোদনের মতো নিষ্ফল ক্রন্দনের মধ্য দিয়ে এবং তার এই রোদনের মধ্যেও যে চাতুরি থাকতে পারে সে বিষয়ে পাঠকের বেশ সন্দেহ রয়েছে। গুরুদয়ালের প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর সে কিছুদিন স্বেচ্ছানির্বাসনে তীর্থে তীর্থে ঘুরেছে। তারপর একদিন সে ফিরে আসে, আবার বিবাহ করার জন্য সে এক টুকরো ভূমিও বিক্রি করে দেয়। যার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়, বিয়ের পূর্বেই সে তাদের বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত করত। একদিন কন্যা পক্ষ চিঠিতে জানিয়ে দেয় যে, তারা কন্যাকে অন্যত্র বিবাহ দিবেন স্থির করেছেন। এবার গুরুদয়াল বেশ মর্মাহত এবং তার পিসীমাসহ প্রতিবেশীরা ভেবেছিল সে আর কোনোদিন বাড়ি ফিরবে না। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর সে সস্ত্রীক বাড়ি ফিরে আসে। বউটি দেখতে সুন্দর ছিল না এবং সে ছিল অসহায়। বউ অসুন্দর হবার কারণে গুরুদয়াল আত্মপীড়ায় ভুগতো এবং বউকে প্রায়ই মারত। এরমধ্যে একদিন গুরুদয়াল তিতাস নদীর উপর দিয়ে মোটর লঞ্চে করে বিশেষ কাজে কোথাও যাচ্ছিল। লঞ্চে সেই মেয়েটির সাথে তার দেখা হয়, যার সাথে তার বিবাহ ঠিক হয়েছিল। আহ্লাদী তাকে বলেছিল, শনিবার তার বিয়ে হবে, বিয়ের রাতে গুরুদয়াল সেখানে এলে তাকে নিয়ে সে পালিয়ে যাবে। সেদিন দুঃখদগ্ধ স্ত্রীর কথা ভেবে সে আহ্লাদীর ডাকে সাড়া দেয়নি। এরপর থেকে স্ত্রীর প্রতি গুরুদয়ালের নিষ্ঠুরতা আরও বেড়ে যায় এবং একদিন বউটি মারা যায়। গুরুদয়াল স্ত্রীর মৃতদেহের পাশে বসে কপাল চাপড়িয়ে কাঁদে, এবার তার কান্না যেনো থামতে চায় না। গুরুদয়ালের এই কান্নার প্রতি লেখকের সন্দেহ, তাইতো শেষ বাক্যটিতে প্রকাশ পায় এমন বক্রোক্তি : ‘গুরুদয়াল আঁখির জলে ভিজিয়া ভিজিয়া যেন বলিতে থাকে, মরিল তো কিন্তু আর কয়টা দিন আগে কেন মরিল না।’
‘সন্তানিকা’ গল্পটি নিরূপায় এক বৃদ্ধ স্কুল শিক্ষকের শেষ জীবনের অনিশ্চয়তা ও আশ্রয়হীনতা নিয়ে রচিত। বুড়ু ধনঞ্জয় ঘোষাল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া নরেশের পিছু নিয়ে তাদের বাড়িতে পৌঁছায় এবং গৃহশিক্ষক হিসেবে ঠাঁই পান। প্রথম দিকে তার প্রতি বীরেশ বাবু ও তার স্ত্রীর বেশ মুগ্ধতা থাকলেও যখন নরেশ পরীক্ষায় ফেল করে তখন তা কেটে যায় এবং তাঁকে বাড়ি ত্যাগ করার জন্য বলে। এতে বৃদ্ধ অত্যন্ত মর্মাহত হন, বৃদ্ধ কোথায় যাবেন এই ভেবে ব্যাকুল হয়ে উঠেন। ধনঞ্জয় কেবল নিশ্চিন্তে মরতে চান। তিনি ভাবেন, ‘একাকী কেমন করে মরিবে! আর মরিলেই বা কি তাহার অসহায় অসাড় দেহটাকে লইয়া শৃগাল কুকুর শকুনিতে টানাটানি করিবে। একটা ভারী বিশ্রী ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইবে যে...।’ ধনঞ্জয় একবার এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন, কিন্তু আবারও তিনি ফিরে আসেন, জগতে যে তাঁর আপন বলে কেউ নেই। শেষ পর্যন্ত বীরেশ-পরিবার তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে। বৃদ্ধ মানুষের একাকিত্ব, অসহায়ত্ব এ গল্পে গভীর আবেগে উঠে এসেছে; মানুষ শেষকালে নিশ্চিন্তে স্বাভাবিকভাবে মরতে চায়, এটিই গল্পটির প্রতিপাদ্য।
‘বন্দী বিহঙ্গ’ অদ্বৈত মল্লবর্মণের বহুল পঠিত ছোটগল্প। এটি সাপ্তাহিক খবরের কাগজের এক সহকারী সম্পাদকের প্রত্যহিকতার বৃত্তান্ত। গল্পের প্রধান চরিত্র আবু মিয়া কলকাতায় পত্রিকা অফিসে কাজ করেন, বছরে মাত্র একবার ছুটি পান বাড়ি যাবার, সেটি ঈদের সময়, তাও পনের দিনের জন্যে। এবার শারীরিক অসুস্থতার জন্য বাড়ি যেতে পারেন নি, টাকাণ্ডপয়সাও শেষ হয়ে গেছে ঔষধ-পথ্যের পেছনে, তাই তার মন খারাপ থাকে প্রায়ই। তাঁর একমাত্র ভালোলাগার বিষয় স্ত্রী জামিলার চিঠি, সে একই চিঠি বারবার পড়ে। চিঠি পড়তে পড়তে সে আনমনা হয়ে যায়। তার মন ফিরে যায় গ্রামের পথ-ঘাট-মাঠে নানাজনের আঙ্গিনায়। অনেক সময় পত্রিকার কম্পোজাররা লেখা চেয়ে তার ঘোর কাটায়। এই গল্পের মধ্যে পত্রিকায় উপ-সম্পাদক শ্রেণির স্টাফদের কিছু কষ্টের কথাও প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যায়, তারা পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখেন, কাগজের গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট দেখেন এবং চূড়ান্ত করেন, কিন্তু পত্রিকায় ছোট করেও তাদের নাম কোথাও থাকে না। বিষয়টি গল্পের নায়িকা জামিলার চিঠিতে এমন : ‘কলকাতায় তুমি এডিটরি করছো-সত্যের অনুরোধ শুধু ভাবিসাবদেরই নয়, এপাড়া ওপাড়ায় ছোট-বড়ো বউ গিন্নিদেরও এ কথাটা বলতে হয়েছে। আমার কথা এরা সবাই শুনেছে, শুনতে একটুও উসখুস করেনি, খালি বিশ্বাস করেনি এই যা!’-কারণ একটাই, পত্রিকার কোথাও ছোট করেও যে আবু মিয়ার নাম ছাপা হয় না। দুই ছেলে ও মেয়ের জন্য আবু মিয়ার সর্বদা চিন্তা হয়; দুর্ভাবনায় জড়িয়ে পড়ে এই ভেবে যে, কখন জানি ছেলেরা হারিয়ে যায়, দুর্ঘটনায় পড়ে। এ গল্পে বারবার সন্তানের প্রতি পিতৃস্নেহের গভীরতা লক্ষ্য করা যায়। আজকের দিনে প্রবাসে যারা থাকেন, তাদের কঠিন বাস্তবতার সাথে ‘বন্দী বিহঙ্গ’ গল্পের বেশ মিল রয়েছে। প্রবাসীরাও তার স্ত্রী-সন্তানদের কথা ভেবে এমনই পীড়িত হন, ফেলে আসা জীবন ও সংসারের কথা ভেবে ব্যথা বোধ করেন।
গল্পের বিষয় নির্বাচন থেকে আরম্ভ করে আঙ্গিক, ভাষাশৈলী, সমাজবোধ ও বহমান জীবনের অকৃত্রিম উপস্থাপনায় নন্দিত অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রতিটি ছোট গল্প। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিনি যেমন স্বতন্ত্র ও সমুন্নত, তেমনি ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, গল্পগুলো বহুল পাঠের দাবি রাখে।
সৌম্য সালেক : কালচারাল অফিসার, মহাপরিচালকের দপ্তর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সেগুনবাগিচা, রমনা, ঢাকাণ্ড১০০০। মোবাইল : +৮৮০১৯১৮৭১০৭৭৩/ +৮৮০১৮৫৫৫১৮৯০৮