প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাংয়ের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার শঙ্কা
চাঁদপুরসহ ঝুঁকিতে উপকূলীয় ১৯ জেলা
ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’য়ের প্রভাবে চাঁদপুরে গতকাল সকাল থেকে আকাশ অনেকটা মেঘাচ্ছন্ন ছিলো। সূর্য উঁকি দিলেও রোদের দেখা মিলেনি। আবহাওয়া ছিলো গুমোট। সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। সারাদিন এবং রাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর মধ্যে চাঁদপুরও রয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার এটি আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। চাঁদপুর নদীবন্দরে আপাতত ২ নম্বর নৌ-হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতি রয়েছে।
|আরো খবর
বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ থেকে সৃষ্ট হতে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে আজ ২৪ অক্টোবর সোমবার থেকে ২৬ অক্টোবর বুধবার পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবি)। এর ফলে বন্যা পরিস্থিতিও হতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল রোববার (২৩ অক্টোবর) বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া এ তথ্য জানান।
নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে আগামীকাল ২৫ অক্টোবর মঙ্গলবার ভোরে দেশের বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এর প্রভাবে আজ ২৪ থেকে ২৬ অক্টোবর দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে।
তিনি বলেন, ভারী বর্ষণের ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি হতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু স্থানে আকস্মিক বন্যা এবং পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মহুরী, মনু, খোয়াই, সুরমা-কুশিয়ারা নদণ্ডনদীর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। সময় বিশেষে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মোঃ মনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, গভীর নিম্নচাপটির বর্ধিতাংশ, অমাবস্যাতিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যে আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলায় বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এ জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
ঝুঁকিতে থাকা দেশের উপকূলীয় ১৯ জেলা
১. খুলনা ২. সাতক্ষীরা ৩. বাগেরহাট ৪. পটুয়াখালী ৫. বরগুনা ৬. ভোলা ৭. পিরোজপুর ৮. বরিশাল ৯. ঝালকাঠি ১০. নোয়াখালী ১১. লক্ষ্মীপুর ১২. ফেনী ১৩. চাঁদপুর ১৪. চট্টগ্রাম ১৫. কক্সবাজার ১৬. ফরিদপুর ১৭. মাদারীপুর ১৮. গোপালগঞ্জ ও ১৯. শরীয়তপুর।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং দেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলায় একযোগে আঘাত হানতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এখন যে পূর্বাভাস আছে, তাতে ১৯টি (উপকূলীয়) জেলাই ঝুঁকিপূর্ণ। গত ৩ বছরে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো হয়েছে তার চেয়ে এটির আঘাত হানার এরিয়া অনেক বেশি।’ সচিবালয়ে গতকাল রোববার (২৩ অক্টোবর) ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং ইস্যুতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী এর অবস্থান হলো ৮৮. ৫ দ্রাঘিমাংশ এবং ১৬ অক্ষাংশ। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এটি ৮৭ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ এবং ১৭ ডিগ্রি অক্ষাংশের সংযোগস্থলে পৌঁছার পর সরাসরি উত্তর-পূর্ব দিকে টার্ন নিতে পারে। যদি উত্তর-পূর্ব দিকে টার্ন করে তাহলে যে গতিপথ দেখানো হয়েছে এটি একেবারে কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা-উপকূলের সব (১৯টি) জেলায় আঘাত হানতে পারে।’
আর যদি এখন যে ডিরেকশন আছে, উত্তর-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে, তাহলে এটি ভারতের ভুবনেশ্বর ও পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানবে। এখন পর্যন্ত এটাই আমাদের শেষ আপডেট, বলেন মন্ত্রী।
এনামুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এখনো বলছে, সন্ধ্যায় (রোববার) এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হবে এবং আঘাত হানার সম্ভাব্য সময় বলছে ২৫ অক্টোবর (মঙ্গলবার)। ২৪ অক্টোবর (সোমবার) দিবাগত রাতের পর থেকে ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের উপকূলে আঘাত হানতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘যেভাবে ম্যাপিং করা হয়েছে একেবারে কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত আমাদের ৭৩০ কিলোমিটার উপকূল সম্পূর্ণরূপে আক্রান্ত হবে।’ এটা সুপার সাইক্লোন হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা সিভিআর সাইক্লোন পর্যন্ত হবে। গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১১০ কিলোমিটার।’ তিনি বলেন, ‘এটা এখনো ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়নি, সন্ধ্যায় হবে। রূপান্তরিত হলে তখন এর নামকরণ করা হবে সিত্রাং। এখন পর্যন্ত নামকরণ করা হয়নি।’
৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি গত রাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে রূপ নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করা মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে শিগগির নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। রোববার (২৩ অক্টোবর) অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, গভীর নিম্নচাপটির বর্ধিতাংশ, অমাবস্যাতিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যে আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলায় বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এ জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগমনী বার্তায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার পর সমুদ্র বন্দরগুলোতে সতর্ক সংকেত বাড়িয়ে দেয়া হবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত আপাতত ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত অব্যাহত থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ এখন ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে।
নিম্নচাপের প্রভাবে রোববার সকাল থেকেই চাঁদপুরে গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করে। দুপুরের পর শুরু হতে থাকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। চাঁদপুর নদীবন্দর কর্মকর্তা মোঃ শাহাদাত হোসেন জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে চাঁদপুর নদীবন্দরে আপাতত ২ নম্বর নৌ-হুঁশিয়ারী সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মোতাবেক নদীবন্দরকে নিরাপদ রাখা এবং নৌযানগুলোকে সাবধানে চলাচল করার জন্যে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি সম্পর্কে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, যখন লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তখন থেকেই কাজ শুরু করেছি। নদীতীরবর্তী চরাঞ্চলের পরিবারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার জন্যে চাঁদপুর সদর, হাইমচর ও মতলব উত্তর ইউএনওদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জরুরি ত্রাণ সহায়তা হিসেবে সরকার থেকে নগদ অর্থ, চাল ও শুকনো খাবার আমরা বরাদ্দ পেয়েছি। সেগুলো পোঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আবহাওয়া দপ্তর জানায়, আন্দামান সাগর ও সংলগ্ন দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় বৃহস্পতিবার লঘুচাপটি সৃষ্টি হয়। শুক্রবার তা সুস্পষ্ট লঘুচাপে ও শনিবার নিম্নচাপে এবং রোববার সকালে তা গভীর নিম্নচাপে রূপ নেয়।
তথ্যসূত্র : ঢাকা পোস্ট।