প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২১:০৫
মেঘনায় জাহাজভর্তি চিনি চোরাচালান রুখে দিলো নৌ পুলিশ।। আটক ৮

চাঁদপুরের মেঘনায় পণ্যবাহী একটি কার্গো জাহাজ থেকে অপরিশোধিত চিনি চোরাচালান হওয়ার সময় তা রুখে দিয়েছে নৌ পুলিশ। জাহাজভর্তি এই চিনি পাচারের চেষ্টার অভিযোগে ৮জনকে আটক করা হয়েছে। পরে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবার (১৬ আগস্ট ২০২৫) সন্ধ্যায় আদালতে হাজির করা হয়।
|আরো খবর
এর মধ্যে চারজন চাঁদপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪-এর বিচারক মাহফুজের সামনে ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় জবানবন্দি প্রদান করে। অন্য চারজনের মধ্যে একজনকে দুদিনের রিমান্ড এবং অন্য তিনজনসহ মোট সাতজনকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
শনিবার (১৬ আগস্ট ২০২৫) দুপুরে চাঁদপুর সদরের হরিণাঘাট এলাকায় মেঘনা নদী থেকে এমভি সি ওয়েস্টিন-১ নামক কার্গো জাহাজ থেকে তাদেরকে আটক করে চাঁদপুর নৌ থানা পুলিশ। এ তথ্য জানান চাঁদপুর নৌ থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিল্লাল আজাদ।
অভিযুক্তরা হলেন : মেহেদী হাসান মুন্না ওরফে আকাশ (২৭), মো. শফিকুল (২৮), মো. নুরুজ্জামাল (৩২), মো. মানিক (৩৮), শরীফ মির্জা (৪০), মজিবুর রহমান সর্দার (৪০), বাচ্চু বেপারী (৩৫) ও জাহাজের মাস্টার আইয়ুব মৃধা (৪৫)।
এমভি সি ওয়েস্টিন-১ নামে এই কার্গো জাহাজ গত ৩ আগস্ট চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে অপরিশোধিত ১২ হাজার মেট্রিক টন চিনি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আব্দুল মোমেন চিনি কলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ৪ আগস্ট চাঁদপুরের মেঘনায় পৌঁছে জাহাজটি। এর পরের দিন জাহাজের মাস্টার আইয়ুব মৃধা ও আরো কয়েকজন মিলে অন্যদেরকে খাবারের সঙ্গে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাওয়ায়। এক পর্যায়ে অচেতন করে এসব চিনি জাহাজ থেকে অন্যত্র পাচারের চেষ্টা করে।
এদিকে নির্ধারিত সময়ে অপরিশোধিত চিনি নিয়ে জাহাজটি গন্তব্যে না পৌঁছায় এর সন্ধানে নামে মালিক পক্ষ। তারপর ১০ দিনের মাথায় মূল ঘটনা প্রকাশ পায়। এ ঘটনায় চাঁদপুর সদর মডেল থানায় মামলা করে মালিক পক্ষ।
এদিকে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি পাচারের ঘটনায় চাঁদপুরে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ঘটনায় চাঁদপুর শহরের দুজন জড়িত। যারা ওই ৮ জনের মধ্যে রয়েছেন। তারা হচ্ছেন শরীফ মির্জা ও মজিব সর্দার।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সরকারি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সামগ্রী বিশেষ করে ওপরের অপরিশোধিত চিনি, ভোজ্য তেল, সার, গম, সরিষাসহ জ্বালানি তেল চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের পতেঙ্গা থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ফ্যাক্টরিতে ও বিভিন্ন তেলের ডিপুতে সরবরাহের সময় চাঁদপুর নদী এলাকায় এসব চোরাচালান হয়ে আসছে। এ রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন জাহাজ চাঁদপুরে যাত্রা বিরতির নাম করে পণ্য নিয়ে নোঙ্গর করে এবং জাহাজের মাস্টারের যোগসাজশে চাঁদপুরের চোরাচালানি চক্র রাতের আঁধারে জাহাজ থেকে তেল চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য নামিয়ে এনে ট্রলারযোগে অন্যত্র পাচার করছে।
চাঁদপুর মেঘনা নদীর হাইমচর চরভৈরবী, সদর উপজেলার হানারচর, পুরাণবাজারের দোকানঘর, বড় স্টেশন সংলগ্ন এলাকা, মতলব এলাকার কানুদি, এখলাশপুর ও মোহনপুর হচ্ছে নৌ পথের জাহাজ থেকে পণ্য চোরাচালানের চিহ্নিত স্পট। এখান থেকে চোরাই পণ্য মেঘনা নদীর পশ্চিম পাড় চরাঞ্চল দিয়ে পাচার হয়ে থাকে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন যমুনা রোড, কানুদী এবং মতলব মোহনপুরে রয়েছে নদীর চোরাকারবারীদের বড় নেটওয়ার্ক। নৌ পুলিশের তৎপরতায় অবশেষে চাঁদপুরের নদীর পথের চোরাকারবারি কয়েকজন ধরা পড়লো। কার্গো এবং লাইটার জাহাজের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের পণ্য আনা নেয়ার ছোট ছোট ট্রলার, বাল্কহেড থেকেও কৌশলে পণ্য পাচার করা হয়। বহু বছর যাবত চাঁদপুরের মেঘনায় এসব চোরাচালান হয়ে আসছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
চাঁদপুর নৌ পুলিশের প্রেস নোটে উল্লেখ করা হয়, আসামীরা সবাই পেশাদার চোর এবং সংঘবদ্ধ চোরাচালানি চক্রের সক্রিয় সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে তারা নৌপথে চলাচলরত মালবাহী জাহাজ থেকে নানা কৌশলে মূল্যবান মালামাল চুরি করে আসছিলো। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, এরা পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজের কিছু অসাধু স্টাফদের সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করতো।
মামলার বাদী কোম্পানির চিনি এম. ভি. সী ওয়েস্টিন-১ (এম. নং-৩০১৫৪) নামের জাহাজে করে কুমিল্লার মেঘনা থানা এলাকায় যাবে এই খবর আসামিরা আগেই পায়। আগেই গ্রেফতার হওয়া আসামী আইয়ুব মৃধা, যিনি ওই জাহাজের মাস্টার, তার মাধ্যমে আসামিরা বিষয়টি জানতে পারে এবং পরিকল্পনা করে কীভাবে চিনি চুরি করা যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আসামী মেহেদী হাসান মুন্না ওরফে আকাশ আইয়ুব মৃধার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তরিকুল ও নুরুজ্জামালকে মোনায়েম সুগার মিলের স্কট পার্টির সদস্য পরিচয়ে জাহাজে পাঠায়। ০৪/০৮/২০২৫ তারিখ সকাল আনুমানিক ১১টার সময় তরিকুল ও নুরুজ্জামাল নেশাজাতীয় দ্রব্য নিয়ে এম. ভি. সী ওয়েস্টিন-১ জাহাজে উঠে। এরপর জাহাজের মাস্টার আইয়ুব মৃধা এবং গ্রীজার ইমরান শেখকে নিজেদের পরিকল্পনার কথা জানায়। ০৫/০৮/২০২৫ তারিখ বিকেলে নাস্তা বানানোর সময় মাস্টার আইয়ুব মৃধা বাবুর্চিকে কিচেন থেকে অন্য কাজে পাঠিয়ে দেন। সুযোগে নুরুজ্জামাল কিচেনে গিয়ে ছোলার ভেতর সাদা পাউডার (চেতনানাশক দ্রব্য) মিশিয়ে আসে। তরিকুল বাইরে পাহারা দিচ্ছিল। সেদিন বিকেল প্রায় ৫টার দিকে জাহাজ হরিণাঘাট এলাকায় পৌঁছালে বাবুর্চি সবার জন্যে ছোলা-মুড়ি দেয়। সেটা খেয়ে জাহাজের লস্কর, গ্রীজার, সুকানীসহ প্রায় ১০ জন স্টাফ এবং মামলার বাদী অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
এরপর তরিকুল ফোনে মেহেদী হাসান মুন্না ওরফে আকাশকে খবর দেয় এবং জাহাজের অবস্থান জানায়। পরে সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে আকাশসহ আরও ৫ জন অজ্ঞাতনামা লোক ট্রলার নিয়ে জাহাজে আসে। তারা মাস্টার আইয়ুব মৃধার সঙ্গে আলোচনা করে, কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় শেষে তারা আবার ট্রলার নিয়ে পালিয়ে যায়।
তদন্তে প্রমাণ মেলে আসামিরা আইয়ুব মৃধা, গ্রীজার ইমরান শেখ ও আরও কয়েকজন অজ্ঞাত চোরের সহযোগিতায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে জাহাজের স্টাফদের অজ্ঞান করে মালামাল চুরি করার চেষ্টা করে।