প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:৫১
মসজিদ-মাদ্রাসা সংস্কার প্রকল্প
৮০ ভাগ প্রকল্পের পুরো টাকাই লোপাট
সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমানের নির্বাচনি এলাকায় মসজিদ-মাদ্রাসা ও গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের নামে প্রায় ২শ ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে অন্তত ৫ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এতে জড়িত রয়েছে সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন ও কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী পিআইও দপ্তরের একটি চক্র।
|আরো খবর
অভিযোগ রয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ত্রাণ ও দুর্যোগ অধিদপ্তর সংস্কার খাতে ৪ কোটি ৫৯ লাখ ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা ও ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা বাজার মূল্যের ৩১৫ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ পান কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলা পিআইও দপ্তর। কাজ না করে ভুয়া প্রকল্পের তালিকা তৈরি করে সিংহভাগ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানে ৮০ শতাংশ কাজের হদিস পাওয়া যায়নি। পিআইও দপ্তরের সংস্কার ও কাজের বিষয়ে জানে না তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রত্যয়ন ও প্রাপ্তি স্বাক্ষর নেন ক্ষমতাসীনরা। অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দ জানাজানি হওয়ায় নামমাত্র টাকা ধরিয়ে মুখ বন্ধ রাখা হয়।
রাঙ্গাবালী উপজেলার তৎকালীন ও কলাপাড়া উপজেলায় কর্মরত পিআইও মো. হুমায়ুন কবিরের হাত ধরে এসব দুর্নীতি করা হয়। যদিও অভিযোগে জড়িত প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনরা সরকার পতনের পর আত্মগোপন রয়েছেন।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্কার খাতে রাঙ্গাবালী পিআইও দপ্তরে ১ কোটি ১৩ লাখ ৫৭ হাজার নগদ টাকা ও ৪৪ লাখ টাকা বাজার মূল্যে ১১০ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেয় ত্রাণ অধিদপ্তর। এ বরাদ্দে ৪২টি প্রতিষ্ঠান সংস্কার দেখানো হয়। একই বছর কলাপাড়া পিআইও দপ্তরে নগদ ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৯২ টাকা ও ৮২ লাখ টাকা বাজার মূল্যের ২০৫ টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। নগদ টাকা ১২৯টি প্রতিষ্ঠান ও খাদ্যশস্য ১৮টি প্রতিষ্ঠান সংস্কারে ব্যয় দেখানো হয়। এসব বরাদ্দ সমঝোতার মাধ্যমে ভাগাভাগির অভিযোগ ওঠে পিআইও হুমায়ুন কবির ও প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে। গত মার্চ ও এপ্রিলে অনুসন্ধান করলে ৮০ শতাংশ কাজের হদিস পাওয়া যায়নি।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, তিনি যোগদানের আগে এসব কাজ হয়েছে। তাই খোঁজখবর নিয়ে জানাবেন ও সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেবেন।
২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ১ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ পান কলাপাড়া পিআইও দপ্তর। ২ লাখ ২২ হাজার টাকা করে ৪৫টি সংস্কার দেখান তারা। তালিকায় তেগাছিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা মাঠ ভরাট দেখানো হলেও তা জানেন না প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক রুহুল আমীন। তেগাছিয়া জামে মসজিদ ইমাম কবির হোসেন তেগাছিয়া মুন্সিবাড়ী জামে মসজিদের আবু হানিফসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক জনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, প্রকল্প সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। ৪৫টি কাজের ২০টি প্রকল্পের হদিস মেলেনি।
৩৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা ১৫টি সংস্কারে ব্যয় দেখায় পিআইও দপ্তর। তালিকা অনুযায়ী ইটবাড়িয়া বায়তুন নূর জামে মসজিদ সংস্কারে ৩ লাখ টাকা ব্যয় হলেও তা জানে না প্রতিষ্ঠানের খাদেম ইমরান হোসেন। ঘুঢাবাছা মরহুম জব্বার গাজীর বাড়ি জামে মসজিদ সংস্কারে ৩ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও কোনো কাজ হয়নি বলে জানান মসজিদ কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান। ইসলামপুর খন্দকার বাড়ি জামে মসজিদ সংস্কারে ৩ লাখ বরাদ্দ হলেও ৪টি গ্রিল নির্মাণ বাবদ ২০ হাজার টাকা দিয়েছে বলে জানান সভাপতি রুহুল আমীন। ইসলামপুর মাস্টারবাড়ি জামে মসজিদে ৩ লাখ টাকার বদলে ৫০ হাজার টাকায় অজুখানা করে দেওয়া হয়। নয়া মিশ্রীপাড়া রহিম মিয়া জামে মসজিদ সংস্কারে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও ৫০ হাজার টাকায় একটি টয়লেট করে দেন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন তরিকুল। এ ছাড়া নবীপুর কালীমন্দির সংস্কারে ৩ লাখ টাকার বদলে মন্দির কমিটিকে ৫০ হাজার, ইটবাড়িয়া নান্নু হাং বাড়ি জামে মসজিদ সংস্কারে ৩ লাখ টাকার বদলে দেড় লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এ তালিকার ১৫টি প্রকল্পের ৮টিতে এ গরমিল পাওয়া গেছে।
অপর একটি বরাদ্দে ৬৫ লাখ টাকা ১৬টি সংস্কার কাজে ব্যয় দেখানো হয়। তালিকায় বিপিনপুর জাহাঙ্গীর শিকদারের বাড়িসংলগ্ন রাস্তা থেকে সগীর খানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণে ২ লাখ ও মোয়াজ্জেমপুর দাখিল মাদ্রাসাসংলগ্ন রাস্তা থেকে মোতালেব হাং-এর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারে ৩ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও কোনো কাজ হয়নি। অপর একটি বরাদ্দে ৬০ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ১৮টি সংস্কারে ব্যয় দেখানো হয়। এতে সুধিরপুর জাহাঙ্গীর সরদার বাড়ি থেকে পশ্চিমে জাহাঙ্গীর সন্নামত বাড়ি হয়ে জব্বার খানের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক সংস্কারে ৫ লাখ ও ডংকুপাড়া মস্তফার বাড়িসংলগ্ন রসুলপুর সরকারি প্রা. বিদ্যালয় পর্যন্ত সড়ক সংস্কারে ৩ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও কোনো কাজ হয়নি। অপর একটি বরাদ্দে ৬৬ লাখ ১৯ হাজার টাকা ২৯টি সংস্কারে ব্যয় দেখানো হয়। তালিকায় মহিপুর পাউবো জামে মসজিদ সংস্কারে ২ লাখ ১৯ হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও মসজিদ কমিটির সভাপতি রাজু আহম্মেদকে ৭০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। রসুলপুর ফোরকানিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা সংস্কারে ২ লাখ, চাপলি বাজার কেন্দ্রীয় মসজিদের পুকুরের ঘাটলা ও চাপলি বাজার একটি গণশৌচাগার সংস্কারে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি। মহিপুর গ্রামীণ ব্যাংকসংলগ্ন সড়ক থেকে বিপিনপুর কালু হাওলাদারের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক সংস্কারের ১০.৪৯ টন চাল বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রাঙ্গাবালীর দক্ষিণ আমলিবাড়িয়া আফের উদ্দিন বাড়ির জামে মসজিদ সংস্কারে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও মালেক প্যাদাকে ৬০ হাজার টাকা দেন প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন বাবু তালুকদার। রাজার বাজার জামে মসজিদে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও তা জানে না প্রতিষ্ঠানের ইমাম রুহুল আমীন। চতলাখালী হাজিবাড়ি দারুস সালাম জামে মসজিদ সংস্কারে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও তা জানে না প্রতিষ্ঠানের সভাপতি রায়হান আহম্মেদ। মাদারবুনিয়া সুলতান প্যাদার বাড়ি থেকে বাতেন মালের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি বলে জানান সুলতান প্যাদা। গঙ্গীপাড়া কাজি বাড়ির সামনে এইচবিবি সড়ক থেকে জবান আলী হাওলাদারের বাড়ি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি। মাদারবুনিয়া আলমগীর হাওলাদারের বাড়ী থেকে ইউনুচ প্যাদার বাড়ী পর্যন্ত সড়ক নির্মানে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি বলে জানান জুরান হাওলাদার। মাদারবুনিয়া জহির ফকিরের বাড়ি থেকে রশিদ মুন্সির জমি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে ১০ টন গম বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি। পুলঘাট এমদাদ আলী জামে মসজিদ সংস্কারে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি। ছোটবাইশা ইউনিয়নের চর তোজাম্মেল ফজলু দালালের বাড়ির পশ্চিম পাশে খালের ওপর কাঠে সেতু সংস্কারে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি। ছোটবাইশা ইউনিয়নের সিদ্দিকিয়া/মমতাজিয়া নুরুদিয়া হাফেজি ক্যাডেট মাদ্রাসা সংস্কারে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি। পশ্চিম কোড়ালিয়া আল বায়তুল জামে মসজিদ সংস্কারে আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি বলে জানান ইমাম ফয়সাল। ছোটবাইশা নূরুল হক মৃধার বাড়ি জামে মসজিদ সংস্কারে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও কোনো কাজ হয়নি। ছোটবাইশা মিরাজ মুন্সির বাড়ি জামে মসজিদ সংস্কারে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও মসজিদ কমিটিকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে এসব অর্থ লুটপাট করে।
রাঙ্গাবালী পিআইও অজিৎ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, তিনি যোগদানের আগে এসব কাজ হয়েছে। তাই এ বিষয়ে তার ধারণা নেই। কলাপাড়া পিআইও হুমায়ুন কবির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শতভাগ কাজ হয়েছে, কোনো অনিয়ম হয়নি।
তথ্যসূত্র :যুগান্তর