প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২১, ১৯:২০
ব্রিটেনে লকডাউন শিথিল করলেও মাস্ক পরা নিয়ে চলছে বিতর্ক
দীর্ঘ লকডাউনের বেশিরভাগ বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে ‘মুক্ত’ জীবনে ফিরছে ব্রিটেন; কিন্তু মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতাও বাদ দেওয়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে চলছে বিতর্ক।কোভিড মোকাবেলায় জারি করা হয় দেশটিতে।
|আরো খবর
ব্রিটিশ সরকার দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনের শেষ বিধিনিষেধগুলো শিথিল করার ঘোষণা দিতে চেয়েছিল ২১ জুন, যাকে ‘ফ্রিডম ডে’ বলা হচ্ছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন ছড়িয়ে পড়ায় সরকার সেই ঘোষণা পিছিয়ে ১৯ জুলাই নতুন তারিখ নির্ধারণ করে।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, তাতে ওই দিন থেকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আর সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে চলতে হবে না, মুখে মাস্ক না পরলে তা আর অপরাধ হিসেবে দেখা হবে না। কিন্তু ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ যখন আতঙ্ক জাগাচ্ছে, তখন মাস্ক বাদ দেওয়ার কথায় উদ্বেগ জানিয়েছেন অনেকে।
বরিস জনসন বলেছেন, বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ঘরের আবদ্ধ পরিবেশে মানুষ মাস্ক পরবে, সেটাই ‘প্রত্যাশিত’। আর লন্ডনের মেয়র সাদিক খান ঘোষণা দিয়েছেন, শহরে গণপরিবহনে চড়তে গেলে মাস্ক পরতেই হবে। অন্য বিধিনিষেধ উঠলেও স্কটল্যান্ডে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা ঠিকই থাকবে। ওয়েলসেও গণ পরিবহন আর স্বস্থ্যকেন্দ্রের মত জায়গায় গেলে মাস্ক পরতে হবে।
এখন কেউ যদি কার্ডিফ থেকে ট্রেনে করে লন্ডনে যান, কোন নিয়ম তিনি অনুসরণ করবেন? অর্থাৎ এত রকম নিয়মে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি। যারা বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন, কিংবা টিকার দুটি ডোজ এখনও পাননি, মাস্ক বিধি প্রত্যাহারের যৌক্তিকতা নিয়ে তাদের অনেকের সংশয় আছে। আবার অনেকেই আছেন, যারা মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা ওঠার জন্য রীতিমত অপেক্ষা করছেন। তাদের কারও ভাষ্য, মাস্ক মুখে থাকলে কথা বলতে সমস্যা হয়। কারও জন্য আবার গরমের মধ্যে মাস্ক মুখে দিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করা কঠিন। বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরে কোথায় এবং কোন ক্ষেত্রে মাস্ক পরা অব্যাহত রাখা উচিত তার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে হাফিংটনপোস্টের একটি প্রতিবেদনে।
১. সুপারমার্কেট :
ভিড়ের মধ্যে কেউ সেভাবে সামাজিক দূরত্ব মানে না। সে কারণে সুপারমার্কেটগুলোতে অবশ্যই মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারের অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল ভাইরোলজিস্ট ড. জুলিয়ান ট্যাং।
তিনি বলেন, “আপনি যদি মাস্ক পরে থাকেন, তাহলে সংক্রমণ কমে আসবে, বিশেষ করে ডেল্টা এবং ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট যখন সামনে আসছে।”
শুধু ভিড়ের মধ্যে থাকা আশপাশের ক্রেতা নয়, এমন হাজারো ক্রেতার সংস্পর্শে যাওয়া বিক্রেতার দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে মাস্ক পরার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
২. যাদের জন্য ঝুঁকি বেশি:
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পল হান্টার বিষয়টাকে উল্টো করে ভাবতে বলছেন, অর্থাৎ ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে।
ব্যক্তিকে আগে বিবেচনা করতে হবে, করোনাভাইাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে তার স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটা, অর্থাৎ তিনি অন্য কোনো জটিল অসুখে ভুগছেন কি না, যখন কোভিড হলে তার মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
আবার তিনি যখন কোথাও যাবেন, সেখানে এরকম ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের কথাও তাকে ভাবতে হবে।
“আমি বলতে চাই, আপনি যদি ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপে থাকেন এবং আর এমন কোনো ভিড়ের পরিবেশে আপনাকে যেতে হয়, যেখানে কোভিড ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি, তাহলে মাস্ক পরাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, নিদেনপক্ষে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির এই সময়টায়।
“আবার আপনি হয়ত কারও সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন, তিনিও তো ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপে পড়তে পারেন। ফলে আপনি যদি পুরো ডোজ টিকা নিয়েও থাকেন, সেই মানুষটির নিরাপত্তার জন্য হলেও আপনার মাস্ক পরা উচিত।”
সুপার মার্কেট, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, কেয়ার হোম কিংবা কারো বাড়িতে গেলে- সবখানেই এমন ঝুঁকিতে থাকা মানুষ থাকতে পারে। সুতরাং মাস্ক পড়া চালিয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়।
৩. সিনেমা এবং থিয়েটার:
বাতাস চলাচলের কোনো সুযোগ না থাকায় সিনেমা হল এবং থিয়েটার নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসব জায়গায় টিকেটের লাইন এবং বসার সিট খোঁজার সময় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এ ধরনের জায়গায় মাস্ক পরার পরামর্শ দিচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারের অধ্যাপক জুলিয়ান ট্যাং। বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, “আপনি যখন রান্নাঘরে টোস্ট পুড়িয়ে ফেলেন, তার গন্ধ পুরো রান্নাঘরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ঠিক তেমনি, আবদ্ধ জায়গায় পুরো বাতাস ভাইরাসে পূর্ণ হয়ে যেতে পারে।”
৪. ক্লাসরুম ও অফিস:
ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ মাধ্যমিক স্কুলে গত ১৭ মে থেকে মাস্ক পরার নিয়ম তুলে দেওয়া হয়েছে। অফিসেও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক নয়। তবে অতি সংক্রামক ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ এর কারণে কিছু স্কুল এবং অফিসে মাস্ক ব্যবহার হয়।
ড. জুলিয়ান ট্যাং বলেন, “অফিস এবং ক্লাসরুমে আপনার মাস্ক পড়া উচিত, কারণ স্কুলে মাস্ক ব্যবহার ছেড়ে দেওয়ায় কী হচ্ছে সে তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি, সংক্রমণ বাড়ছে।”
৫. গণপরিবহন:
বাসে অনেক মানুষের মধ্যে কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে কয়েকজন মিলে চলাচলের সময় জানালা খুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ড. ট্যাং। তবে ট্রেনে সে সুবিধা না থাকায় মাস্ক পরা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত কনসালট্যান্ট ডা. পেটার ইংলিশও একই মত দিয়ে বলেন, “এমন জায়গায কেউ মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতায় সামান্যতম হেলা করলেও তা ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে বিপদগ্রস্ত করে তুলবে।”
৬. রেস্তোরাঁ ও পাব:
রেস্তোরাঁর টেবিলে বসে খাওয়ার সময় যেহেতু মাস্ক পরে থাকা সম্ভব না, তাই এক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। রেস্তোরাঁ ও পাব কর্তৃপক্ষকে বাতাস চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করছেন তারা।
এছাড়া যারা সেসব জায়গায় খেতে যাবেন, তাদের জন্য ড. ট্যাং পরামর্শ দিয়েছেন খোলা জানালা কিংবা দরজার কাছাকাছি বসার। পাশাপাশি খাওয়া শেষ হয়ে গেলে আবারও মাস্ক পরে নেওয়ার কথা বলছেন তিনি।
৭. উড়োজাহাজ:
বাতাস বদলে নেওয়ার সুবিধার কারণে উড়োজাহাজকে তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করতে পারেন অনেকে। কিন্তু যাত্রীদের মধ্যে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ থাকতে পারেন, সে কারণে মাস্ক পরার পক্ষেই মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভাইরোলজিস্ট ড. জুলিয়ান ট্যাং বলেন, করোনাভাইরাসের টিকাগুলো বানানো হয়েছে প্রথম জেনারেশনের জন্য। কিন্তু করোনাভাইরাসের বদলে যাওয়া সব ধরনের ক্ষেত্রে টিকা একই রকম কাজ নাও করতে পারে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে মাস্ক হয়ত সবসময় শতভাগ সুরক্ষা দেবে না, তবে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেবে।