প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
ঔষধ রুগ্ন জীবনের দীপ জ্বালিয়ে রাখে। রোগ-ব্যাধিতে ঔষধই হয়ে ওঠে আর্তমানুষের আপন। অ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক কিংবা আয়ুর্বেদিক, যে কোনো ঔষধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঔষধের রাসায়নিক গুণের ওপর যেমন নির্ভর করে তেমনি নির্ভর করে ব্যক্তির শরীরবৃত্তীয় অবস্থার ওপর। প্রয়োগকৃত মাত্রার ওপরও ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিশেষভাবে নির্ভর করে। ব্যবহারকারীর বয়স এবং নারী-পুরুষ ভেদেও ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রার তারতম্য নিরূপণ করে।
সবচেয়ে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসম্পন্ন ঔষধ হলো প্যারাসিটামল, যা অ্যাসিটামিনোফেন জাতীয় ঔষধ। জ্বর এবং মৃদু ব্যথায় কার্যকরী এ ঔষধ নিরাপদ হলেও কতিপয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে গ্যাস্ট্রিক ইরিটেশান বা পাকস্থলীর জ্বালা-যন্ত্রণা তৈরি করে। লিভার বা যকৃতের প্রদাহে প্যারাসিটামল একটি প্রয়োগ নিষিদ্ধ ঔষধ। স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধের বাইরে ব্যথা উপশমকারী ঔষধগুলো একদিকে পেটে অ্যাসিডিটি বাড়ায়, পাকস্থলীর রক্তক্ষরণ ঘটায় এবং অন্যদিকে প্রেসার বাড়িয়ে তোলে কিংবা কিডনির ছাঁকন প্রক্রিয়া দুর্বল করে দেয়। স্টরয়েড জাতীয় ব্যথানাশকগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, হাড়ে ক্যালসিয়ামের ঘনত্ব হ্রাস করে ঝুরঝুরে করে দেয়, দেহের স্থুলতা বাড়ায় এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি ও শরীরে পানি সঞ্চিতি বাড়িয়ে দেয়। ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে দেহের ভেতরে অন্ত্রের উপকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলো মারা যায় এবং খাদ্য হজম ও বর্জ্য নিষ্ক্রমণে অসুবিধা তৈরি হয়। পেট ভার ভার লাগে, অস্বস্তি তৈরি হয়। পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি জীবাণুর প্রতিরোধ তৈরি হয় এবং জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিও সহনশীল হয়ে যায়। অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অনেকের মাথা ঘোরাতে পারে, দৈহিক দুর্বলতা লাগতে পারে। অ্যামক্সাসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে পাতলা পায়খানা হতে পারে, ফ্লুক্লক্সাসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিকে মাতৃস্তন্য শুকিয়ে যেতে পারে, ফ্লুরোকুইনোলন জাতীয় ঔষধ সেবনে বলোক সংবেদনশীলতা তৈরি হয় এবং গলা শুকিয়ে আসতে পারে যাতে অধিক পিপাসা হয়। সেফ্রাডিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে বাজে ঢেঁকুর আসতে পারে। যক্ষ্মা রোগের ঔষধ রিফামপিসিন সেবনে মূত্রের বর্ণ লালচে হতে পারে, রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং জন্ডিস দেখা দেয়, ত্বকে ফোস্কা পড়তে পারে যাকে স্টিভেন-জোন্স সিন্ড্রেম বলে। আইসোনিয়াজিড জাতীয় যক্ষ্মার ঔষধ সেবনে পায়পর গিঁটে গিঁটে ব্যথা হয়, শরীর জ্বালা-পোড়া করে। কিছু কিছু মূত্রবর্ধনকারী ঔষধ যেমন : ডাই-ইউরেটিক সেবনে যৌনতার চাহিদা কমে যায়, গোড়ালির গিঁটে ব্যথা হয়। রক্তনালী প্রসারক ঔষধ সেবনে পায়ের নিচের অংশে জলস্ফীতি হয়ে ইডিমা তৈরি হয় এবং এসিই-ব্লকার জাতীয় প্রেসারের ঔষধ যেমন : লোসারটান পটাশিয়াম, র্যামিপ্রিল জাতীয় ঔষধ দীর্ঘদিন সেবনে শুকনো কাশি হয়। মাইগ্রেনের ব্যথায় পিজোটিফেন জাতীয় ঔষধ সেবনে খাওয়ার রুচি বাড়ে ও দেহ স্থুল হয়ে যায়। শ্বাসনালী প্রসারক ঔষধ যেমন : ডক্সোফাইলিন জাতীয় ঔষধ সেবন করলে শরীর কাঁপতে থাকে। স্টেমিটিল কিংবা ডমপেরিডন জাতীয় ঔষধ সেবনে ঘাড় শক্ত হয়ে যেতে পারে। ডায়বেটিসের নিয়ন্ত্রণে ঔষধ সেবন করলে রক্তের গ্লুকোজ অতিরিক্ত কমে গিয়ে দৃষ্টি ঝাপসা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরাতে পারে। বেশি কমে গেলে অচেতনতা তৈরি হয়। ম্যালেরিয়ার ঔষধ কুইনাইন সেবনেও রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যেতে পারে। অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় সর্দি বা ঠাণ্ডার ঔষধ সেবন করলে ঘুম ঘুম ভাব হয়। আবার কতিপয় উদ্বেগ কমানোর ঔষধ যেমন ক্লোনাজিপাম জাতীয় ঔষধ সেবনে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। কিছু কিছু মানসিক রোগের ঔষধ সেবনে যৌন সক্ষমতা রহিত হয়। আবার নারীরা মানসিক রোগের ঔষধ সেবন করলে রক্তে প্রোল্যাকটিনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং অবিবাহিতা নারীদেরও দুগ্ধ ক্ষরণ ঘটতে পারে। হৃদরোগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাইট্রেট জাতীয় কতিপয় ঔষধ সেবনে মাথার শিরা দপ দপ করতে পারে বা শিরঃপীড়া হতে পারে। কিছু কিছু অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ঔষধ সেবনে মায়েদের স্তন্য দান করার ক্ষমতা কমে যায়। মেট্রোনিডাজল জাতীয় ঔষধ যা সাধারণত জীবাণুঘটিত পাতলাপায়খানা নিরসনে সেবন করা হয়, তাতে মুখের স্বাদ হ্রাস পায়। ক্লিনডামাইসিন জাতীয় ক্যাপসুল সেবনে পায়খানা নরম হয়ে যায়। শিরাপথে ইঞ্জেকশন দেয়ার সময় দিতে ত্রুটি বা তাড়াহুড়ো হলে উক্ত স্থানের শিরার প্রদাহ হয় এবং জ্বালাপোড়া করে। কিছু কিছু কাশির সিরাপে মাদকতা তৈরি হয়। ট্রামাডল বা গাবাপেন্টিন জাতীয় ঔষধ সেবনে মাথা ঘোরায়, বমি ভাব হয়। বমিও হয়। লিভোফ্লক্সাসিন জাতীয় ঔষধে অস্থিরতা ও অনিদ্রা দেখা দেয়। এক ধরনের হায়-হুতাশ তৈরি হয়। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স সেবনে মূত্রের বর্ণ হলুদ হয়।
ঔষধ মাত্রেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত। কোনো ঔষধই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত নয়। চিকিৎসকই ভালো জানেন, কোন্ ঔষধে কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ রকম অবস্থায় ঔষধ সেবন বন্ধ রেখে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কোনো ঔষধ প্রয়োগের আগে বোঝা যায় না তা কোন্ দেহে কী পরিমাণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। চিকিৎসক ক্ষতির চেয়ে উপকার বেশি হয় এরূপ পরিস্থিতিতে বিবেচনা করে ঔষধ নির্বাচন করেন। কিছু কিছু ঔষধ নির্বাচনে পরিস্থিতিগত কারণে বিকল্প থাকে না। সেক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে প্রশমিত করে নিতে হয়।
এক এক ঔষধ এক এক দেহে এক এক রকম মাত্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন : কেউ সিপ্রোফ্লক্সাসিন সহ্য করতে পারে কিন্তু লিভোফ্লক্সাসিন সহ্য করতে পারে না। কেউ লিভোফ্লক্সাসিন সহ্য করতে পারে কিন্তু মক্সিফ্লক্সাসিন সহ্য হয় না। আবার অনেকেই সেফ্রাডিন সহ্য করতে না পারলেও স্পারফ্লক্সাসিন ঠিকই সহ্য করে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, এক রোগী প্যারাসিটামল খেলে পাকস্থলী হতে রক্তক্ষরণ হয় কিন্তু ন্যাপ্রোক্সেন জাতীয় ব্যথার ঔষধ দিব্যি হজম করে ফেলেন। কাজেই ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কোনো চিকিৎসকের ঔষধ নির্বাচনে অযোগ্যতা নয়, পরিস্থিতির বিরূপতা মাত্র।
* চিকিৎসাঙ্গন বিভাগে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]