প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২২, ০০:০০
অ্যাসিড উৎপাদনকারী খাদ্য অ্যাসিডবৃষ্টির মতো হজমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং দিনের পর দিন অ্যাসিড খাবারের প্রভাব চলতে থাকলে অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গিয়ে প্রথমে পেটের পীড়া দেখা দেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে নানা রকমের ডিজেনারেটিভ রোগ, যেমন গ্যাস্ট্রিক, আলসার, হৃদ্রোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগের জায়গা তৈরি করে।
আমাদের শরীরে একটি রাসায়নিক মান ঠিক করে চলার বিষয় আছে, যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় পিএইচ (পটেনশিয়াল অব হাইড্রোজেন) বলে। মাটি ও পানির যেমন নির্দিষ্ট পিএইচ ব্যালান্স আছে, মানুষের দেহেরও এমন ব্যালান্স থাকে, যা আমরা প্রোফাইল চেক করলে পেয়ে থাকি। এই পিএইচ ঠিক থাকলে আমরা সুস্থ, না থাকলে অসুস্থ। অনেক সময় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে লেখা থাকে ‘বডি কন্ডিশন’ অ্যাসিডিক কিংবা অ্যালকালাইন। আমাদের শরীরের এ অবস্থা জানান দেয়, আমাদের পিএইচ কোন অবস্থায় আছে। অ্যাসিডিক হলে আপনি অসুস্থতার জায়গায় অবস্থান করছেন, অ্যালকালাইন হলে আপনি ভালো কন্ডিশনে আছেন।
মাঝে মাঝে প্রকৃতিতে অ্যাসিড-বৃষ্টি হয়। অ্যাসিড-বৃষ্টি হলে গাছের পাতা এবং বোঁটা শুকিয়ে পাতার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। এই অ্যাসিডের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে গাছের শিকড় মাটি থেকে প্রয়োজনীয় অ্যালকালাইন চরিত্রের পুষ্টি (ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম) শুষে নিয়ে পাতাকে জোগান দেয়। তারপর ধীরে ধীরে পাতা আবার নতুন জীবন ফিরে পায়।
ঠিক তেমনি অ্যাসিড উৎপাদনকারী খাদ্য অ্যাসিড-বৃষ্টির মতো হজমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং দিনের পর দিন অ্যাসিড খাবারের প্রভাব চলতে থাকলে অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গিয়ে প্রথমে পেটের পীড়া দেখা দেয়। এরপর পর্যায়ক্রমে নানা রকমের ডিজেনারেটিভ রোগ, যেমন গ্যাস্ট্রিক, আলসার, হৃদ্রোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগের জায়গা তৈরি করে। অথচ এটা এখন প্রমাণিত যে অ্যালকালাইন খাবার বেশি খেয়ে শরীরকে অ্যালকালাইন করতে পারলে রোগ থাকে না।
সুস্বাস্থ্যের জন্য আদর্শ রক্তের পিএইচ স্তরগুলো সামান্য অ্যালকালাইন যুক্ত (৭.৩৬৫ থেকে ৭.৪৫-এর মধ্যে) হওয়া দরকার। পিএইচ হলো হাইড্রোজেন আয়ন ঘনত্বের একটি পরিমাপ। পিএইচ স্কেল ০-১৪ পর্যন্ত হিসাব করা হয়। নিরপেক্ষ পিএইচ ৭.০। পিএইচ উচ্চতর (৭-এর বেশি) বেশি অ্যালকালাইন বা বেসিক, তবে ৭-এর চেয়ে কম পিএইচ অ্যাসিডিক। তাই লিপিডে দেখা যায়, অসুস্থ মানুষের মধ্যে খুব কমই ৭ মাত্রা পিএইচ পাওয়া যায়।
মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশু অ্যালকালাইন থাকে। শিশু ধীরে ধীরে যখন খাদ্য গ্রহণে বৈচিত্র্য আনতে থাকে, রান্নাজাতীয় খাবার বেশি খেতে থাকে, তখনই অ্যালকালাইন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুটিও অ্যাসিডিক হয়ে ওঠে।
আপনার রক্তের পিএইচ ভারসাম্য বজায় রাখা নিশ্চিত করার জন্য শরীর জটিল প্রক্রিয়া অতিক্রম করে। আপনার দেহের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে সমর্থন করার জন্য কেবল একটি ভারসাম্যযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে!
অ্যালকালাইন এবং অ্যাসিডিক খাবারের চার্ট
অ্যালকালাইন খাবার ও পানীয়
বেশির ভাগ শাকসবজি, বেশির ভাগ ফল, ছোলা, মুগ ও মসুর ডালÍএ খাবারগুলো অ্যালকালাইন বা লো-অ্যাসিডযুক্ত খাবার হিসেবে বিবেচিত। এগুলোকে আপনি আপনার ডায়েটের জন্য বিবেচনা করতে পারেন। সয়া (তবে আমরা যে সয়াবিন তেল নামে যা খাই, তার পিএইচ ঠিক নেই), অলিভ অয়েলসহ ছোট একটি তালিকা দেখে নিন।
উচ্চ অ্যালকালাইন খাবার
লেবু (যা অ্যাসিডিক হলেও শেষ পরিণতিতে এটা অ্যালকালাইনে পরিণত হয়ে দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে বেশ কার্যকর), কুল, তরমুজ, পাকা আম, পাকা পেঁপে, আনারস, আঙুর, ক্যাপসিকাম, কিশমিশ, খেজুর।
মাঝারি অ্যালকালাইন খাবার
বেশির ভাগ শাক (যা প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে ওঠে), শজনে ডাঁটা, কাঁচা পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, বেগুনসহ বেশির ভাগ সবজি। ফলের মধ্যে কলা, কমলা, কাঁঠাল, বেদানা, নাশপাতি, পেয়ারা ও বেল।
কম অ্যালকালাইন খাবার
ডাবের পানি, শসা, ঢ্যাঁড়স, পেঁয়াজ, মুলা, টমেটো, সেদ্ধ ডিম, পানিফল, সয়া দুধ, মাশরুম।
উচ্চ অ্যাসিডিক খাবার
অ্যাসিডিক খাবার ও পানীয় বিশেষত অ্যাসিডযুক্ত বা ৪ বা ৭ এর নিচে কম পিএইচসহ কিছু খাবারের মধ্যে রয়েছে সব ধরনের কার্বনেটেড পানীয় বা কোমল পানীয়, সোডা ওয়াটার, শক্তি পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকস, কিছু দুগ্ধজাতীয় পণ্য, চিনি, অ্যালকোহল, মাংস ও সব ধরনের ফাস্ট ফুড। সব ধরনের মিষ্টি বা মিষ্টান্ন, সাদা ময়দার তৈরি সব খাবার, সাদা চালের তৈরি সব খাবার, সব ধরনের পোলট্রি মাংস, চাষের মাছ।
মাঝারি অ্যাসিডিক খাবার
চিনাবাদাম, কাজুবাদাম, মাখন, ঘি, পনির, কর্নফ্লেক্স, মুড়ি, সুজি, খই ও যব।
কম অ্যাসিডিক খাবার
নারকেল, বার্লি, মধু, বেশির ভাগ গরমমসলা, আমন্ড বাদাম।
অ্যালকালাইন খাবার আমাদের দেহে রক্তের পিএইচ যা হওয়া দরকার, ঠিক সেখানে রাখার জন্য দুর্দান্ত কাজ করে। অ্যালকালাইন যুক্ত খাবার, যেমন শাক, ফল এবং কাঁচা সবজি পাওয়ার হাউস হিসেবে এ উদ্ভিজ্জ খাবারগুলো আমাদের দেহকে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইটোকেমিক্যাল সরবরাহ করে।
স্বাভাবিক পিএইচ মাত্রা রাখার জন্য প্রতিদিন ৭০ শতাংশ অ্যালকালাইন এবং ৩০ শতাংশ অ্যাসিডিক খাবার গ্রহণ করলে শরীর সঠিক মাপে চলে আসবে, শরীর ভারসাম্যপূর্ণ থাকবে। আমাদের শরীরে ক্রনিক সমস্যা থাকলেও ভালো হতে থাকবে।
অ্যাসিডিক খাবার রক্তের পিএইচের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে রক্তের গতি মন্থর ও দূষিত করে ফেলে, যা অ্যাসিডিক কন্ডিশন। এই অবস্থা শরীরে রোগ তৈরি হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে, যার শুরু হয় পেট থেকে অর্থাৎ হজমের সমস্যা দিয়ে।
স্বাভাবিক পিএইচ মাত্রা রাখার জন্য প্রতিদিন ৭০ শতাংশ অ্যালকালাইন এবং ৩০ শতাংশ অ্যাসিডিক খাবার গ্রহণ করলে শরীর সঠিক মাপে চলে আসবে, শরীর ভারসাম্যপূর্ণ থাকবে। আমাদের শরীরে ক্রনিক সমস্যা থাকলেও ভালো হতে থাকবে। যদিও আমরা উল্টো পথেই চলছি, তাই শরীর ঠিক রাখার জন্য অ্যাসিড অ্যালকালাইনের দিকে খেয়াল রেখে প্রাকৃতিক নিয়মে সুস্থ থাকা সম্ভব। আমরা যদি অ্যাসিডিক খাবারগুলো কমিয়ে দিয়ে অ্যালকালাইন খাবারগুলো গ্রহণ করতে থাকি, তাহলে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা হবে, যা সুস্থ থাকার চাবিকাঠি। দেহের এই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে খাবার দিয়ে। কোনো ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট দিয়ে সেটি করা সম্ভব নয়।
লেখক : খাদ্য পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ।