প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
বিন্দু রাণী। হাইমচরের কৃতী সন্তান। প্রসূতি মায়েদের সেবাদান ও নিরাপদ সন্তান প্রসবে সেবা প্রদানের জন্যে তিনি ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মাননা লাভ করেন।
বিন্দু রাণী হাইমচর উপজেলার ৩নং আলগী দুর্গাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এসএসিএমও সংক্ষেপে সাকমো) হিসেবে কর্মরত। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি নরমাল ডেলিভারি ও গর্ভবতী নারীদের আপন ঠিকানা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলে বিনাখরচে নরমাল ডেলিভারির মাধ্যম সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া সাধারণ মানুষের জন্যে অনেক পাওয়া। যার ফলে তিনি সকলের প্রশংসা পাচ্ছেন।
বিন্দু রাণী ১৯৯৬ সাল থেকে ৩নং আলগী দুর্গাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করলেও সবসময় ছিলেন প্রচার-বিমুখ। প্রচারণার চেয়ে নিজের কাজের মাধ্যমে কীভাবে মানবসেবায় বেশি মনোযোগী হওয়া যায় সে ব্যাপারে তিনি তৎপর।
১২ ফেব্রুয়ারি শনিবার দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘চিকিৎসাঙ্গন’ বিভাগে সাক্ষাৎকারের জন্যে যোগাযোগ করা হলে বিন্দু রাণী প্রথমে রাজি হননি। এ সময় তিনি বলেন, ‘নিজেকে প্রচার করার মতো আমার কিছু নেই। আমি চেষ্টা করছি মানুষকে সেবা দিতে। সেটাই করতে চাই।’
বিন্দু রাণীর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও সফলতার কথা পাঠকের কাথে পৌঁছাতে চেষ্টা করে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ। বিন্দু রাণীর দায়িত্ব ও নিষ্ঠার কথা পাঠকের কাছে পৌঁছানোই চাঁদপুর কণ্ঠের মূল লক্ষ্য। আলাপচারিতার মাঝে বিন্দু রাণী বহুবার আবেগতাড়িত হয়ে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করেন।
সাক্ষাৎকার নেন সাজ্জাদ হোসেন রনি ও আলআমিন হোসাইন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?
বিন্দু রাণী : ভালো আছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কোথায়?
বিন্দু রাণী : আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে হাইমচরে। আমি হাইমচরের মেয়ে। আমার বয়স যখন ৯ বছর তখন বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। আমার মা অনেক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
বিন্দু রাণী : হাইমচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আমি পঞ্চম শ্রেণি পাস করি। পরে আমার মামা হাইমচর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আমাকে ভর্তি করান। মামা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র বৈদ্য ছিলেন নীলকমল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। চরকৃষ্ণপুর মামার বাড়িতে থেকে আমি এসএসসি পাস করি। তারপর ১৯৮৬-১৯৮৭ সেশনে কুমিল্লা ম্যাটস্ েসুযোগ পাই। সেখান থেকে ১৯৯১ সালে আমি পাস করি। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা এবং দিকনির্দেশনায় শিক্ষাজীবনে জ্ঞান অর্জন করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : মানুষকে চিকিৎসক সেবা দিবেন এ ভাবনাটি সূচনা হলো কীভাবে?
বিন্দু রাণী : আমার বাবা একজন পল্লীচিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর আমরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। তখন থেকেই মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার ভাবনাটি সূচনা হয়। আসলে চিকিৎসাব্যবস্থাটা বিশাল। সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় প্রার্থনা করতাম, যদি কখনো সুযোগ হয় তাহলে মানুষের সেবা করবো। সেই ভাবনা থেকেই পড়াশোনা করে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতার কথা বলুন।
বিন্দু রাণী : আমাদের ক্লিনিক ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। সপ্তাহে সাতদিনই আমরা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করি। উক্ত ক্লিনিকে আমরা পাঁচজন দায়িত্ব পালন করছি। সহকর্মীদের আন্তরিকতা আর অকৃত্রিম সহযোগিতায় আমার কাজ করা সহজ হয়েছে। আর পরিবারের কথা যদি বলি, তাহলে বিশেষভাবে আমার স্বামীর কথা বলতে হয়। আমার স্বামীর সহযোগিতা না পেলে আমি হয়তো এতোটুকু পথ পাড়ি দিতে পারতাম না। তার সহযোগিতা আমার কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আমার স্বামী আমার কাজের মূল্যায়ন করছে বলেই আমি রোগীদের পেছনে সময় ব্যয় করতে পারছি।
একজন মেয়েকে তার পরিবারে সময় দিতে হয়। সন্তানদের লালন-পালন করতে হয়। কিন্তু দেখা গেলো, আমি আমার বাচ্চাদের রেখে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে চলে গিয়েছি। আমার সন্তান লালন-পালন তখন স্বামীই করেন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ঝুঁকিপূর্ণ জানা সত্ত্বেও সর্বত্রই অনেক প্রসূতি সিজারিয়ান অপারেশনের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু আপনার ক্লিনিক প্রসূতিদের নিরাপদ ঠিকানা বলে সুনাম অর্জন করেছে। আপনার এ সফলতা অর্জনের পেছনের কথা জানতে চাই।
বিন্দু রাণী : চিকিৎসাবিষয়ক আমার যে শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে, যে অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করেছি সে আলোকে মানুষকে সঠিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের চেষ্টা করি। কারণ গ্রামাঞ্চলের মায়েদের আগে ধাত্রীদের মাধ্যমে নরমাল ডেলিভারি হতো। অধিকাংশ ধাত্রির কিন্তু চিকিৎসাবিষয়ক জানাশোনা কম। ফলে তারা অনেক সময় সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা প্রয়োগ করতে পারেন না। এ কারণে কিন্তু মায়েদের জটিল রোগে ভুগতে হয়। আমাদের ক্লিনিকে গর্ভবতী মায়েদের প্রয়োজনীয় চেক-আপ করে ওষুধসহ ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ জানিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। গর্ভবতী নারীদের নরমাল ডেলিভারির ব্যাপারে আমরা উদ্বুদ্ধ করি। কারণ নরমাল ডেলিভারির ফলে একজন গর্ভবতী নারী শারীরিকভাবে সুস্থ থাকেন। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। আমি মনে করি, রোগীদের যে আস্থা আমরা অর্জন করেছি, সে অনুপাতে তারা এখানে আসেন।
এ সফলতার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই আমাদের উপ-পরিচালক মহোদয় ডাঃ মোঃ ইলিয়াছ স্যারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। যাঁদের আন্তরিক সহযোগিতায় আমি রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করি। ডাঃ মোঃ ইলিয়াছ স্যার আমাদের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে নিয়মিত দিকনির্দেশনা প্রদান করেন এবং বেশ ক’বার তিনি আমাদের এখানে জনসচেতনতা বৃদ্ধি জন্যে ক্যাম্পেইন করেছেন। ফলে মানুষজন অনেকটা সচেতন হয়েছে বলে আমি মনে করি। একই সাথে ধন্যবাদ জানাই আমার সহকর্মীদের।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসা সেবক হিসেবে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
বিন্দু রাণী : একজন চিকিৎসা সেবক হিসেবে প্রথমদিন খুবই নার্ভাস ছিলাম। তারপরও সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় আমি আমার অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পন্ন করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আলগী দক্ষিণ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগদান করেছেন কবে?
বিন্দু রাণী : ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : হাইমচর উপজেলাসহ ফরিদগঞ্জ, রায়পুর এবং আশপাশের গর্ভবতী ও প্রসূতিদের কাছে নিরাপদ সন্তান প্রসবের আস্থা হয়ে উঠেছে এ কেন্দ্রটি। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
বিন্দু রাণী : আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পূর্বদিকে ফরিদগঞ্জ, দক্ষিণে নোয়াখালী সংশ্লিষ্ট, পশ্চিমে দক্ষিণ আলগী ইউনিয়ন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় আমাদের ক্লিনিকের সুনাম এবং আমাদের উপর মানুষের আস্থা আছে বলেই তারা এখানে আসেন। যাতে নিরাপদ ও সঠিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে রোগমুক্ত জীবনযাপন করতে পারেন। আমরা সবসময় রোগীদের আন্তরিকতার সাথে সঠিক সেবাটি প্রদান করতে চেষ্টা করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থেকে চাঁদপুর রেফার করা রোগী এবং সিজারের পরামর্শ দেয়া রোগীরও এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নরমাল ডেলিভারি হওয়ার সুনাম রয়েছে। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
বিন্দু রাণী : একজন গর্ভবতী মা আমাদের ক্লিনিকে কোথা থেকে আসলেন সেটা আমি খোঁজার চেষ্টা করি না। আমি চেষ্টা করি, আমার আওতাধীন যতো সুযোগ আছে তা দিয়ে সেবা দিতে। আমি আমার সাধ্যানুযায়ী নরমাল ডেলিভারি করতে পারি কি-না সে চেষ্টা করি। আমাদের ক্লিনিকে সিজার করা হয় না। যদি সিজারের উপযুক্ত হয় সেটা পরের কথা। অনেক মায়ের কিন্তু ধৈর্য না থাকায় সিজারিয়ান অপারেশনের প্রতি ঝুঁকছেন-এটা ঠিক না। একজন গর্ভবতী মাকে অবশ্যই নরমাল ডেলিভারির জন্যে ধৈর্যধারণ করতে হবে। আমরা মায়েদের নরমাল ডেলিভারির প্রতি আশ^স্ত করি। এক্ষেত্রে আমাকে সবসময় সহযোগিতা করেন ‘মা-মণি প্রজেক্ট’-এর সহকর্মী সেলিনা বেগম।
চাঁদপুর কণ্ঠ : প্রসূতি সেবাদান ও নিরাপদ প্রসবের জন্যে আপনি জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মাননা লাভ করেছেন। অনুভূতির কথা জানতে চাই। এ শ্রেষ্ঠত্ব আপনার কাজে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে?
বিন্দু রাণী : শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি বিশাল। আমার জীবনে এটি একটি বড় পাওয়া। দায়িত্ব পালনের ফলস্বরূপ কর্তৃপক্ষ আমাকে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার দিয়েছেন, এজন্যে আমি তাঁদের কাছে ঋণী। এ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের ফলে আমার কাজের পরিধি বেড়েছে। রোগীদের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছতে পেরেছি। আমি এলাকাবাসীর কাছে বলতে পেরেছি আপনাদের কারণেই এ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। আপনারা নির্দ্বিধায় চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। সাধ্যমতো সেবা জন্যে আমরা সবসময় প্রস্তুত রয়েছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার কাছে কোন্ ধরনের রোগী বেশি আসে?
বিন্দু রাণী : সাধারণ রোগীরা সবসময় আমার কাছে আসেন। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী এবং পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারীরা বেশি আসেন। প্রসূতি নারীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যয় হয়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : রোগীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?
বিন্দু রাণী : শ্রেণিভেদে রোগীদের আশীর্বাদ এবং দোয়া সবসময় প্রত্যাশা করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসাজীবনের একটি সুখের স্মৃতির কথা বলুন।
বিন্দু রাণী : চিকিৎসাজীবনের বহু সুখের স্মৃতি রয়েছে। অনেক মা বলেন দিদি নরমাল ডেলিভারি হওয়ায় সুস্থ আছি। রোগীরা সুস্থ হয়ে যখন হাসিমুখে কথা বলেন তখন খুবই ভালো লাগে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : রোগমুক্ত জীবনযাপন করতে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
বিন্দু রাণী : বাল্যবিবাহমুক্ত সমাজ গড়তে হবে। পুষ্টি-সংক্রান্ত স্বাস্থ্যশিক্ষা গ্রহণ এবং সে অনুপাতে খাবার খেতে হবে। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে চলতে হবে। করোনাকাল চলছে। যা আমাদের জন্যে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারি বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে। কারণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাই তো আমাদের রোগমুক্ত জীবনযাপন করার মূল হাতিয়ার।
চাঁদপুর কণ্ঠ : অবসরে কী করেন?
বিন্দু রাণী : গল্প এবং পত্রিকা পড়া আমার সখ। টেলিভিশনে ভালো অনুষ্ঠান হলে দেখি। পরিবারকে সময় দিই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
বিন্দু রাণী : আমি হাইমচরের মেয়ে। সবসময় চেষ্টা করি এখানকার মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে। আমার সফলতার পেছনে হাইমচরবাসীর অবদান অপরিসীম। এজন্যে তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। তাঁরা আমাকে হাইমচরবাসীর সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমার উপর বিশ^াস ও ভরসা করেছেন। আমি আমৃত্যু আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে চাই। আমার জন্যে দোয়া করবেন। ধন্যবাদ জানাই গণমাধ্যমকর্মীদের। আপনাদের মাধ্যমে মানুষ আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারছেন।
* চিকিৎসাঙ্গন বিভাগে লেখাসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক যে কোনো প্রশ্ন পাঠান।
ই-মেইল : রহঃড়.ধষধসরহ@মসধরষ.পড়স