প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
পরিবারের বটবৃক্ষ। ছায়া বিলিয়ে চলেছেন পরম মমতায়। শুভ কাজে যেমন তার আশীর্বাদ নেয়া হয়, তেমনি পরিবারের যে কোনো বিপদে একটি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্তের জন্যেও ছুটে যাওয়া হয় তার কাছে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা তো এমনই আশ্রয়স্থল। আজীবন কনিষ্ঠদের জন্যে ভেবে চলেন তারা। তবে তাদের জন্যেও আমাদের কিছু ভাবার আছে বৈকি। তাদের সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করাটা পরিবারের সবার দায়িত্ব।
সুস্থ থাকুক বটবৃক্ষ
পরিবারের গুরুজনের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, অবসরযাপন (কর্মচাঞ্চল্যের সময়টা পেরিয়ে তিনি হয়তো এখন সারাদিনই অবসর সময় কাটান), বিনোদনÑসবদিকেই খেয়াল রাখুন।
এভাবে তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত হবে। দীর্ঘমেয়াদি কোনো রোগে ভুগলে (যেমন উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস) তাকে নিয়মিত ফলোআপ তো করাতেই হবে (অর্থাৎ পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে)। কোনো রোগ না থাকলেও চল্লিশোর্ধ্ব প্রত্যেক মানুষকে বছরে অন্তত একবার চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। বছরে একবার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো উচিত প্রত্যেকেরই।
সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতামূলক সব ব্যবস্থা তো নিতেই হবে। কম বয়সীদের মধ্যে জটিলতা তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু পরিবারের গুরুজনদের এ ভাইরাস থেকে রক্ষা করতে নিজেদের সুরক্ষিত রাখুন অবশ্যই। বাড়িতে অন্য কেউ এলে তারাও এই বিষয়গুলো মেনে চলছেন কি না, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। বাড়ির কাছে কোথাও হয়তো হাঁটতে যাচ্ছেন পরিবারের গুরুজন। তার মাস্ক পরে বের হওয়াটা নিশ্চিত করুন।
হয়তো বয়োবৃদ্ধ বাবার সারাজীবনের অভ্যাস নিজের হাতে বাজার করা। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তার যে ভিড় এড়িয়ে চলা উচিত, সেটি তাকে বুঝিয়ে বলুন। এ নিয়মগুলো কিন্তু কেবল করোনাভাইরাসই নয়, অন্যান্য অনেক জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করবে।
এছাড়া যা করতে হবে
* বয়স্ক ব্যক্তির খাবার প্রস্তুত কিংবা পরিবেশনের আগে হাত ধুয়ে নিন নিয়মমাফিক। তাকে সেবাদান করা ব্যক্তি যাতে সেবা দেয়ার সময় হাত পরিষ্কার রাখেন, তা নিশ্চিত করুন।
* তিনি নিজের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে পারছেন কি না, সেদিকে খেয়াল রাখুন। তার পোশাক এবং অন্যান্য অনুষঙ্গের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করুন।
খোঁজ নিন, খবর নিন
বয়সজনিত কারণে চোখে কোনো সমস্যা হতেই পারে। তিনি দৈনন্দিন কাজকর্মে কোনো অসুবিধা বোধ করছেন কি না, তা জিজ্ঞেস করুন মাঝেমধ্যে (দীর্ঘ সময় ধরে চশমা ব্যবহার করলেও এই খোঁজ নিতেই হবে। কারণ, চশমা ব্যবহার করা সত্ত্বেও দৃষ্টিক্ষমতার পরিবর্তনের কারণে অসুবিধা হতেই পারে)। তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ অনুভব করছেন কি না, তা জিজ্ঞেস করুন। তার সঙ্গে কথা বলার সময় যেনো আপনার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা ফুটে না ওঠে।
সংকোচ ভেঙে কিছু বিষয় জানুন
* মেনোপজের পরেও কোনো কোনো নারীর রক্ত যেতে পারে। এমন বিষয় হয়তো নিজের ছেলের সঙ্গে আলাপ করতে সংকোচ বোধ করেন মা। এসব বিষয়ে তাকে সহজ করে নিন। প্রয়োজনে পরিবারের অন্য কোনো নারী সদস্যের সহায়তা নিন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।
* স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং হিসেবে প্রতি মাসে নিজের স্তন পরীক্ষা করা উচিত প্রত্যেক নারীর। এ সম্পর্কে আপনার পরিবারের বয়স্ক নারীকে জানান। প্রয়োজনে তাকে এই কাজটিতে সহযোগিতা করুন।
সহজ হোক জীবনধারা
বয়স হলে হাঁটুব্যথায় ভোগেন অনেকেই। হাঁটুব্যথার চিকিৎসায় জীবনধারার পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন প্রার্থনা করতে হাঁটু মুড়ে নিচে না বসে চেয়ারে বসা। তাহলে আপনার দায়িত্ব হলো, এই চেয়ারটি তার ঘরে ঠিকঠাকভাবে রাখা। ঠিক তেমনিভাবে কারও হাঁটার জন্যে লাঠি কিংবা ওয়াকারের প্রয়োজন হলে সেটির ব্যবস্থা করা।
লিফট ছাড়া হয়তো তার ওঠানামার সমস্যা, এদিকে বাড়ির লিফট বন্ধ থাকল তার নামার সময়টাতেই। সম্ভব হলে তার ওঠানামার সময় একটু এদিক-ওদিক করে দিন।
নইলে সেই সময় লিফট চালু করার ব্যবস্থা করুন। সামাজিকভাবে অন্যদেরও উচিত এমন কাজে সহযোগিতা করা (নিয়ম সবার জন্যে সমানÑএ রকম কথা শুনিয়ে ওই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে হীনম্মন্যতার শিকার বানিয়ে ফেলবেন না)। রিকশায় করে তাকে কোথাও নিতে হলে রিকশা রাখতে বলুন কোনো উঁচু জায়গা ঘেঁষে, সম্ভব হলে অল্প দূরত্বের জন্যেও গাড়ির ব্যবস্থা করুন (তবে পা-দানি যেনো বেশি উঁচু না হয়)।
দুর্ঘটনা এড়াতে
শিশুদের নিয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে যেমন আলাদা করে ভাবতে হয়, বয়স্কদের বেলায়ও কিন্তু তাই। বয়স্ক ব্যক্তির জন্যে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখুন।
* মেঝেতে কিছু পড়ে (পানি, তেল, পাউডার ইত্যাদি) পিচ্ছিল হয়ে গেলে তা যতো দ্রুত সম্ভব মুছে ফেলে মেঝে পিচ্ছিলতা থেকে মুক্ত করতে হবে।
* বাথরুম বা গোসলখানার দেয়ালে বেশ কিছু হাতল (দরজার হাতলের মতো) বসিয়ে দিতে পারেন, যেনো হঠাৎ পা পিছলে গেলেও হাতল ধরে ভারসাম্য রাখা যায়।
* প্রয়োজনের সব জিনিস রাখুন তার হাতের নাগালে (যাতে খুব নিচু হয়ে তাকে কিছু নিতে না হয় কিংবা মই বেয়ে ওঠার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করতে না হয়)।
* বিদ্যুৎ ও আগুন-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা এড়াতে সচেষ্ট থাকুন।
ভুলে যাওয়াই রোগ
অনেকেই অনেক কিছু ভুলে যান এই বয়সে। মনে করিয়ে দেয়াটাও এক বিরাট দায়িত্ব। সময়মতো তার খাবার খাওয়া ও ওষুধ সেবন নিশ্চিত করুন। সপ্তাহের সাতদিনের তিনবেলার ওষুধ একটি বাক্সে (একুশ খোপের বাক্স) গুছিয়ে রাখতে পারেন (কিংবা তিনবেলার ওষুধ তিনটি আলাদা বাক্সে)। তবে প্যাকেট থেকে ওষুধ বের করে রাখা যাবে না।
রসনাবিলাস না কি সচেতনতা
তিনি হয়তো মিষ্টি খেতে ভালোবাসেন কিংবা ভাত খাওয়ার ঝোঁক একটু বেশি। কিন্তু এদিকে তার ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত। কিংবা কিডনির সমস্যার কারণে আমিষ খাবারে রয়েছে বিধিনিষেধ। যে-ই না তিনি হাতা বাড়িয়েছেন খাবারের বাটির দিকে, অমনি হয়তো অফিসফেরত ক্লান্ত সন্তান কড়া গলায় বলে উঠলেন, ‘বাবা, তোমার না এসব খাওয়া বারণ!’
অসহায় বাবা হয়তো শারীরিক দিক থেকে উপকৃত হলেন; কিন্তু মানসিকভাবে? স্বাভাবিক প্রফুল্লতা হারালেন তিনি একটি বাক্যেই। এমন পরিস্থিতিতে তাকে বুঝিয়ে বলাই কিন্তু সন্তানের দায়িত্ব। এমনকি প্রয়োজনে তাকে তার পছন্দের খাবার অল্প পরিমাণে খেতে দিয়ে সারাদিনের খাদ্য তালিকায় অন্য কোনো খাবার কমিয়ে দেয়ার সুযোগ আছে, সেটি চিকিৎসক কিংবা পুষ্টিবিদের কাছ থেকে জেনে রাখাটাও কর্তব্য।
কর্মব্যস্ত মানুষ হয়তো সহজ নাশতায় অভ্যস্ত, কিন্তু পরিবারের গুরুজন চান একটু চিরাচরিত খাবার। একবার ভাবুন, এই মানুষই জীবনের এতোগুলো বছর পার করেছেন আপনার চাওয়াগুলো পূর্ণ করতে। তার ইচ্ছা পূরণের জন্যে একটু সময় দিলেনই না হয়।
অবসর, বিনোদন ও অন্যান্য
* তিনি যা করতে পছন্দ করেন, তা করার সুযোগ করে দিন। ঘরের কাজ নিতান্ত যদি করতেই চান তিনি, তাহলে সহজ ব্যবস্থা করে দিন (যেমন দাঁড়িয়ে কাটাকোটা করার উপযোগী বিশেষ বঁটি)। বই কিনে আনতে পারেন, সহজ কোনো মাধ্যমে তার পছন্দের অডিও ক্লিপ চালানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। কখনো ঘুরতে নিয়ে যেতে পারেন। রেস্তোরাঁ থেকে তার পছন্দের খাবার অর্ডার করতে পারেন। আবার হয়তো দিনের এক বেলা একটু সময়ের জন্যে পাশে বসলেন, সাধারণ দুটি কথা বললেনÑএতেই পরিতৃপ্ত তিনি।
* নাতি-নাতনি বা অন্যান্য প্রিয়জনকে ছোটখাটো উপহার কিনে দিতে ইচ্ছা হতে পারে তার। সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে বয়স্ক ব্যক্তির হাতে কিছু টাকা দিয়ে রাখতে পারেন (তবে কৌশলে কারণ, আপনি যে উদ্দেশ্যে টাকা তার হাতে দিচ্ছেন এটা বুঝতে পারলে তিনি তা নিতে কুণ্ঠাবোধ করতে পারেন)। হয়তো নাতনি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে। সেই সামান্য টাকা কয়টি খরচ করে নাতনিকে একটি ছোট্ট উপহার কিনে দিয়েই মানসিক প্রশান্তি মিলবে তার।
* বন্যা বা ভূমিকম্পের মতো দুর্ঘটনায় কখনো বয়স্কদের পেছনে ফেলে চলে যাবেন না। জীবনে যা-ই ঘটুক, আপনজনের পাশে থাকুন।
লেখক : ক্লিনিক্যাল স্টাফ, নিউরো আইসিইউ, স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেড, ঢাকা। সূত্র : প্রথম আলো।
* চিকিৎসাঙ্গন বিভাগে লেখাসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক যে কোনো প্রশ্ন পাঠান।
ই-মেইল : রহঃড়.ধষধসরহ@মসধরষ.পড়স