বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে 'আল্লাহু চত্বর'
  •   চাঁদপুর কণ্ঠৈর কলামিস্ট এএসএম শফিকুর রহমানের ইন্তেকাল
  •   নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পেল সেনাবাহিনী
  •   জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ প্রধান উপদেষ্টার ১০০ কোটি টাকার অনুদান
  •   মেঘনায় নিখোঁজ দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০

পত্রিকাটির জন্মলগ্নে ছিলাম

বিলকিস আজিজ
পত্রিকাটির জন্মলগ্নে ছিলাম

চাঁদপুর কণ্ঠের জন্মলগ্নে আমি একজন দর্শক ছিলাম। ইঁচড়ে পাকা বয়সে যখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে গল্প-উপন্যাস পাঠে মগ্ন থাকতাম তখন রবীন্দ্রনাথের একটি উপন্যাসে পড়েছিলাম। উপন্যাসের সূচনায় ‘সন্ধ্যা বেলায় দীপ জ্বালার আগে সকাল বেলায় সলতে পাকানো’- এমন একটি বাক্য ছিল। উপন্যাসের নাম ঠিক মনে নেই। তবে ‘যোগাযোগ’ হতে পারে। আমরা সবাই জানি যে কোনো সৃষ্টির শুরুতে একটি প্রস্তুতি পর্ব থাকে। ভাগ্যগুণে আমি সেই প্রস্তুতিপর্বে কিছুটা জড়িত ছিলাম। ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সাহেব আমার ঘরের লোক হলেও তিনি কখনো ঘরে তাঁর কোনো বিষয় নিয়ে সাধারণত আলোচনা করেন না। কোনো কাজে জিতে বা হেরে আসলে তখন ঘরের আত্মীয় স্বজন জানতে পারে।

‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ প্রকাশের ব্যাপারটিও তাই। ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ প্রকাশের পূর্বে এখানে প্রকাশিত দু-একটি পত্রিকা সম্বন্ধে আমার জানা ছিলো। তার মধ্যে ‘সাপ্তাহিক চাঁদপুর’, ‘সাপ্তাহিক রক্তিম আভা’ ইত্যাদি। ‘সাপ্তাহিক চাঁদপুর’ পত্রিকাটি যখন প্রথম আমার হাতে পড়েছিল, আমি পেয়ে অবাক হয়েছিলাম। চারভাঁজ অবস্থায় মেঝেতে পড়েছিলো। পড়ে ভালো লেগেছিলো। ঝরঝরে লেখা, নির্ভুল বানান ও সম্পাদকীয় কলাম। যেন জাতীয় পত্রিকার ক্ষুদ্র সংস্করণ।

‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ প্রথমে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিলো। তার প্রস্তুতি পর্বের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি। একদিন সম্ভবত বিকেল বেলা হবে। বসার ঘরে উঁকি মেরে দেখি সম্পাদক সাহেব (আমার স্বামী) অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশার একটি অল্প বয়সের তরুণ যুবকের সাথে কথা বলছেন। ছেলেটি শান্তশিষ্ট এবং বিনয়ী। দেখতেও সুন্দর। নিম্ন স্বরে কথা বলছেন। আমি জিজ্ঞেস করি, কী ব্যাপার? সম্পাদক সাহেব বললো, একটি সংবাদপত্র বের করবো। আমি বললাম, এতো সংবাদ পাওয়া যাবে? ছেলেটি বললো, যাবে। ওর নাম জানতাম না তখন। তবে এরপর কয়েকবার ওকে আমাদের বাসায় দেখেছি পত্রিকার ব্যাপারে আলোচনা করতে, ডিক্লারেশনের জন্যে ঢাকা-চাঁদপুর ছোটাছুটি করতে এবং সর্বশেষ অগ্রগতি সম্বন্ধে রিপোর্ট করতে। অনেক মানুষকে দেখেছি, যাদের কোনো কাজ দিলে নিজেদের কষ্টের বয়ান আগে শোনাতো। কিন্তু ছেলেটি যখন কোনো বিষয়ে রিপোর্ট করতো মনে হতো সবকিছুই পানির মতো সহজ। পরে ওর নাম জেনেছি মির্জা জাকির।

আমাকে পত্রিকার ত্রিশ বছরপূর্তি উপলক্ষে কিছু লিখতে বলায় আমি ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম এ সম্বন্ধে জানতে। পত্রিকা প্রকাশের শুরুর দিকে জাকিরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পত্রিকা প্রকাশ করার বিষয়টি। আমার স্বামীর মাথায় আসলো কী করে! ও বললো, ইকবাল ভাইকে দেখতাম প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করতে। তাঁর কিছু ছাপাতে হলে একে ওকে ধরতে হয়। তখন আমি ভাবলাম, তিনি নিজে যদি একটা পত্রিকা বের করেন তাহলে ওনার জন্যে ভালো হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর কে কে ছিলো এর সাথে? মির্জা জাকির বললো, আমি এবং শাহাদাত ভাই। আমি বললাম শাহাদাতকে তো আমি কখনো দেখিনি। মির্জা জাকির বললো, ইকবাল ভাইও তাঁকে চিনতো না। আমিই তাঁকে তাঁর কথা বলেছি। আমরা ‘সাপ্তাহিক চাঁদপুর’ পত্রিকায় কাজ করতাম।

এরপর শুরু হলো পত্রিকা প্রকাশের জন্যে কাগজপত্র ঠিকঠাক করা। প্রথমে সাপ্তাহিক এবং পরে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের জন্যে যত প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের নকল কপি সত্যায়িত করা আমার কাজ ছিলো। এরপর চাঁদপুর কণ্ঠের জন্যে কম্পিউটার কেনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ইসলামী ব্যাংকে আমার নামে একটা একাউন্ট খোলা হলো। সেখান থেকে কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য লোনে কম্পিউটার কেনা হয়। ইসলামী ব্যাংকে একাউন্ট খোলার পর কম্পিউটার কেনার সময় একটা কাগজে সাক্ষীস্বরূপ একজনের স্বাক্ষর প্রয়োজন পড়ে। একটা কাগজে দুইজনের স্বাক্ষর দরকার ছিলো। আমি আমাদের চাঁদপুর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের মমতাজ আপাকে একটা স্বাক্ষর করতে অনুরোধ করলাম। তিনি একেবারে আঁতকে উঠলেন। বললেন কোনো অসুবিধা হবে না তো ! আমি লজ্জা পেলাম তাঁর ভয় এবং সন্দেহ দেখে। বললাম, না কিছু হবে না। তিনি স্বাক্ষর করলেন। এখন তিনি বেঁচে নেই। আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন।

সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ বের হতে লাগলো। আমার স্বামীর চেনাজানা বন্ধু-বান্ধব সকলের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো। তাদের ভাবটা এমন ছিলো, ইকবাল ভাইয়ের পত্রিকা মানে তাদের সকলের পত্রিকা। যার যতো সমস্যা, প্রয়োজন, স্বপ্ন এই পত্রিকায় ছাপানোর জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠলো। আমি এতো মানুষকে আগে কখনো কোনো বিষয়ে এতো আনন্দিত হতে দেখিনি। যার যতোটুকু সামর্থ্য সকলেই সাহায্য করেছেন।

অনেকে মানহীন লেখা ছাপানোর জন্যে আমার কাছে অনুরোধ নিয়ে আসতো। আমি কৌশলে এড়িয়ে যেতাম। কেউ আবার ফ্রি বিজ্ঞাপন, পত্রিকায় ছাপানো খবরের ‘প্রতিবাদ’ দিতে আসতো। একবার তো ঝামেলায় পড়লাম চাঁদপুর সরকারি কলেজের একটা বিজ্ঞাপন ছাপা নিয়ে। সামনের পৃষ্ঠায় এটা ছাপা হয়েছিলো। যিনি ছাপতে দিয়েছিলেন তিনি সম্ভবত পত্রিকার কোন্ অংশে ছাপলে কত দিতে হয় জেনে নেননি। আর যারা ছেপেছিলেন তারাও সম্ভবত জানাননি কোন্ পাতায় এবং কতোটুকু স্থানে ছাপালে কতো দিতে হয়। তখন জনাব খালেক সাহেব অধ্যক্ষ ছিলেন। কাজী শাহাদাত সম্ভবত নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। পাঁচ হাজার টাকা বিল দেওয়ায় হেড ক্লার্ক বণিক বাবুর মাথা গরম হয়ে গেলো। সম্ভবত এ নিয়ে কাজী শাহাদাতের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমাকে অধ্যক্ষ সাহেব ডেকে পাঠালেন। অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে তাঁদের অভিযোগ শুনলাম। কারণ তাঁদের ধারণা সম্ভবত মফস্বলের একটি ছোট পত্রিকা তার উপর ম্যাডামের পত্রিকা তো, এতো টাকা চাইবে কেন? অধ্যক্ষ সাহেব বিজ্ঞের মতো বললেন, হ্যাঁ আজকাল মানুষ পত্রিকা ছাপায়, সরকারি কাগজ পায়, কিছু ছাপিয়ে বাকি কাগজ বিক্রি করে দেয়। ভাবটা এমন, সরকারি কাগজ বিক্রির পয়সায় পত্রিকার মালিকের দিন চলে যায়।

আমি সেদিন বুঝলাম, যে যে সেক্টরে কাজ করে না বা অভিজ্ঞতা নেই, সে সেখানে কারো সুবিধা-অসুবিধা বোঝে না। একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে কী পরিমাণ পরিশ্রম ও লোকবল দরকার এবং বেতন-ভাতা দরকার, সেই সাথে অন্য খরচ মেটাতে অর্থের প্রয়োজন- এই ধারণা তাদের নেই।

আমি প্রতি মাসে শুনতাম ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা প্রয়োজন। প্রথম দিকে সম্পাদক সাহেব অধিকাংশ অর্থ নিজেই যোগান দিতেন। খরচ এতো বেশি হচ্ছিল যে পেরে উঠছিলেন না। বাসায় বাজার করতে পারতেন না। আমাকে চালিয়ে নিতে হতো। আমার মেয়ে বৃষ্টি পত্রিকাকে উদ্দেশ্য করে একটি কবিতা লিখেছিলো। যা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় ছাপা হয়েছিলো। তাই সম্পাদক সাহেবের মাথায় মাঝে মাঝে পত্রিকা বিক্রি করে দেওয়ার ইচ্ছে জাগতো। এই সময় কাজী শাহাদাত (বর্তমান প্রধান সম্পাদক) তাঁকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, আপনি চিন্তা করবেন না, দেখি আমরা এটা চালিয়ে নিতে পারি কিনা। এরপর সকলেই জানেন তো আজ দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ কীভাবে টিকে আছে। রবীন্দ্রনাথের কথায় যদি বলি, তাজমহলের পাথর দেখেছো, দেখিয়াছ তার প্রাণ, অন্তরে তার মমতাজ, বাহিরেতে শাহ্জাহান।’ তেমনি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের কণ্ঠ হলো অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার এবং কণ্ঠের সুর হলো কাজী শাহাদাত।

সাপ্তাহিক ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ যেদিন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশের অনুমতি পেলো, এর আগের দিন সম্ভবত ১৪ ডিসেম্বর হবে ‘চাঁদপুর কণ্ঠের’ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের উপর রাজনৈতিক প্রতিহংসার কারণে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হলো। দুজন ব্যক্তির নাম আমি শুনেছি এবং আমার চেয়ে সকলেই তা ভালো জানেন। তাঁকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়। আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তিনি কারো বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন নি।

দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে বহুলোক শ্রম দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন। তাদের সকলের নাম আমি জানি না। কারণ আমি সযতনে, সজ্ঞানে দূরে থাকতাম। এমনকি এই পত্রিকায় আমার ছবিটাও ছাপা হোক তাও আমার ভালো লাগতো না। কারণ নিজেদের পত্রিকায় নিজেদের ছবি বেশি ছাপা হলে মানুষ হাসাহাসি করতে পারে।

মানুষের জীবন আসলেই অদ্ভূত। নিজে কোনো দোষ না করে এবং কারো কোনো ক্ষতি না করেও গোপন শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়। কারণ কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না। এরকম ঈর্ষান্বিত মানুষের কথা আমি জানি। যতই গোপনে হোক কী ভাবে যেন আল্লাহ আমাকে জানিয়ে দেন। চাঁদপুরে আমাদের পত্রিকা দৈনিক হওয়ার পরে আরো কিছু পত্রিকা দৈনিক হয়েছে। একবার একটি দৈনিক পত্রিকায় আমার কোনো একটা অনুষ্ঠানের খবর ছাপা হয়। আমি দেখলাম আমার নামের অক্ষরগুলো ওলোটপালোট করে লেখা। আমি ভাবলাম ছাপার ভুল। কিন্তু সেটা যে ইচ্ছাকৃত সেটা জানলাম একদিন। আমি একটি সমিতির সদস্য ছিলাম (সমিতির নাম উল্লেখ করলাম না)। আমাদের একটা সভা হলো। যিনি সভার এবং সমিতির সভাপতি তিনি হঠাৎ বললেন, আজকের সভায় যারা উপস্থিত তাদের নাম যেন ঠিকঠাক ছাপা হয় আমি বলে দেব। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঠিকঠাক হবে না কেন? তিনি বললেন, আপনি জানেন না, আপনার নাম দেখলে নামটা উল্টা পাল্টা করে দেয়। আমি সত্যিই খুব অবাক হলাম। সেই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং তার ভাইকেও আমি ভালো করেই চিনতাম। কিন্তু তাদের পত্রিকায় বসে কে এটা করতো? মানুষের মন এতো ছোট হয় কীভাবে! অথচ ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’ সকল দলের, সকল মানুষের কাজ করছে। যদিও মাঝে মাঝে যার হাতে কলম তিনি তার মতের প্রতিফলন ঘটান। তবে আমার মতে প্রত্যেক পত্রিকার একটি নিজস্বতা বা স্বকীয়তা বেশি থাকা দরকার এবং সকল ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা উচিত।

এই পত্রিকার শুরুতে অ্যাডঃ শাহ মোঃ ওবায়দুল্যা সাহেব যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। তিনি খুবই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মনে মনে বিপ্লবী ছিলেন। মুখে তিনি অনেক কঠোর কথা বলতেন। কিন্তু অন্তরে ছিলেন স্নেহশীল। আমাদের বাসায় প্রায়ই তিনি আসতেন। ইকবাল সাহেবকে না পেলে আমার সাথেই গল্প করতেন। গল্পের চেয়ে আমাকে খেপাতেন বেশি নারীদের ধর্মীয় অধিকার নিয়ে। আমিও তখন কম বয়সের ছিলাম। তাই তর্ক জুড়ে দিতাম। আমার স্বামী এবং আমাকে দুজনকে তিনি স্নেহ করতেন। আজ তিনি নেই। আল্লাহ সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যেন ওনাকে ক্ষমা করে দেন। ওনার আত্মা কবরে যেন শান্তি পায়--আল্লাহর কাছে এই মোনাজাত।

প্রকৌশলী দেলোয়ার সাহেবের কথা মনে হয়। এই পত্রিকায় লিখে লিখে তিনি মোটামুটি একজন ভালো লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আজ নেই। আল্লাহ তাঁকেও বেহেস্ত নসিব করুন। এই আছি এই নেই দুনিয়ায় আমরা! অনেকেই আগামীতে থাকবো না।

পত্রিকা প্রকাশের প্রথম দিকে আমাদের পাড়ার মধু ও মোবারক ওরাও কাজ করতেন স্বতঃর্স্ফূতভাবে। আমাদের একটা পুরানো শোকেস ছিলো, ওটা কেটে দুটো আলমারি বানানো হয়েছিলো। ওর একটায় ওরা দুজন কয়েকটি পত্রিকা বান্ডিল করে রেখে বাকিগুলো বিতরণের ব্যবস্থা করতো। সাংবাদিক হিসেবে অনেকেই ছিলেন। এর মধ্যে বকুলতলার শওকত, হান্নান, রোকন, বিল্লাল, সুমন, মিলন ও এসএম আনওয়ারুল করীম। এখনও অনেকে কাজ করছেন যারা অনেক দিনের পুরানো। এর মধ্যে আরেকটি মুখ আমার মনের মাঝে জীবন্ত হয়ে আছে- মির্জা মুহাম্মদ আলী। তিনি হলেন বিক্রমপুরের বাসিন্দা। এতিমখানায় জীবন কেটেছে তার। চাঁদপুরে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। চাঁদপুর সরকারি কলেজে সে আমার বিএ ক্লাসের ছাত্র ছিলো। মাঝে মাঝে তাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে হতো। ওর মতো সরল মানুষ কম ছিলো। খেয়ে থাকুক না খেয়ে থাকুক মুখের হাসি কখনও মিলিয়ে যায় নি। পকেটে অল্প দামের চকলেট রাখতো, বাচ্চাদেরকে চকলেট খেতে দিতো। বড়দেরকেও দিতো। সে ছোটখাট সংবাদ বা বিজ্ঞাপন জোগাড় করতো। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠকে খুব ভালোবাসতো। ব্লাড ক্যান্সার হয়েছিল তার। মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে আমার বাসায় এসেছিল। ওকে দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। আমার বাসায় সিঁড়িতে হামাগুড়ি দিয়ে উঠেছিলো। জিহ্বা ফেটে ঝুলে পড়েছিলো। মুখ, জিহ্বা ফ্যাকাসে। আমি তাড়াতাড়ি কিছু টাকা দিয়েছিলাম। সে বাড়ি ফিরে গিয়ে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলো। সে চাঁদপুর কণ্ঠকে এতো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিলো যে, তার প্রতিষ্ঠাতাও তেমন ভালোবাসেনি। মৌমাছি যেমন ফুলে ফুলে উড়ে উড়ে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক বানায়, তেমনিভাবে চাঁদপুর কণ্ঠের সাংবাদিক, লেখক, ফটোগ্রাফার, সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী, বিতরণকারী, সমর্থকবৃন্দ বিভিন্ন বিভাগের সম্পাদকগণ শ্রম ও মেধা দিয়ে এবং বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দিয়ে এর ধারাবাহিক প্রকাশনা টিকিয়ে রেখেছেন। রাখবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের লোকেরাও। হয়তো আমরা বর্তমানের লোকেরা তখন থাকবো না। তাই অতীতের সকলের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বর্তমানে যারা পরিশ্রম করছেন তাদের প্রতি রইলো ভালোবাসা এবং শুভ কামনা। সকলেই ভালো থাকুক আর চাঁদপুরবাসীর সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরার জন্যে পত্রিকাটি দীর্ঘজীবী হোক এই কামনায় শেষ করছি।

লেখক : প্রফেসর বিলকিস আজিজ, উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, পাবনা সরকারি মহিলা কলেজ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়