প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
চাঁদপুর কণ্ঠ বেঁচে থাকুক শতাব্দীকাল
ভালো নেই সংবাদপত্রশিল্প। ইতোমধ্যে এ শিল্পের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। কেনো জানি শিল্পের স্থায়িত্ব বা জৌলুস খুব বেশি হয় না। তবে শিল্পের ঘ্রাণ শতাব্দীর পর শতাব্দী থাকে। চাঁদপুরের এমন অনেক কিছু আছে যা নিয়ে আমরা অহঙ্কার বা গর্ব করতে পারি। তেমনি একটি শিল্পের নাম ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’। চাঁদপুর কণ্ঠ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে একটানা নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে, যা একটি মফস্বল শহরের জন্যে বিস্ময়কর, একই সাথে বিরল ঘটনা। আর এটা সম্ভব হয়েছে একজন সুদক্ষ কারিগরের কল্যাণে। তিনি হলেন চাঁদপুরের সর্বজনশ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত। এই বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী মানুষটি চাঁদপুর কণ্ঠ সম্পাদনার দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করে আসছেন।
সংবাদপত্রের মানুষগুলো ভালো থাকলেও সংবাদপত্র ভালো নেই। নানা সঙ্কটে এই শিল্প আজ হুমকির মুখে। বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ও আমদানিকৃত এবং দেশি কাঁচামালের মূল্য শতভাগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংবাদপত্রের খোদ মালিকগণ। গত বছরের (২০২৩) ৩ ডিসেম্বর নোয়াবের সভাপতি এ. কে. আজাদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে সেবা শিল্প হিসেবে ঘোষিত সংবাদপত্র শিল্প সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে পত্রিকার উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের ব্যবধান অন্যতম প্রধান কারণ।
এক কপি সংবাদপত্র তৈরিতে ব্যয় গড়ে ২২ টাকা। সেখানে বিক্রয়মূল্য ১২ টাকা। এর শতকরা ৩৫ ভাগ পান পত্রিকার বিতরণে যুক্ত হকাররা। বাকি ঘাটতি বিজ্ঞাপন থেকে পূরণের চেষ্টা করা হয়। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই রুগ্ন শিল্পকে রক্ষার দায়িত্ব এখন সরকারকেই নিতে হবে। তা না হলে দীর্ঘদিনের একটি ঐতিহ্যবাহী পেশার সঙ্গে যুক্ত শত সহস্র সাংবাদিক ও কর্মী বেকারের সংখ্যায় যুক্ত হবে। চূড়ান্তভাবে ‘দ্য ফোর্থ এস্টেট’ হিসেবে খ্যাত এই সেবা শিল্পের এ দেশে পরিসমাপ্তি ঘটবে, যা সংবাদপত্রের সাথে জড়িত কারোরই কাম্য নয়।
অর্থনৈতিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত প্রায় সব মিডিয়া হাউজ। নজিরবিহীন এক সঙ্কটে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো। সার্কুলেশন কমেছে প্রিন্ট মিডিয়ার। এমনিতেই তেমন একটা নেই সরকারি বিজ্ঞাপন। প্রায় বন্ধের উপক্রম বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও। সরকারি-বেসরকারি বকেয়া বিলের স্তূপে এ সঙ্কট হয়েছে গভীর। এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকা এবং সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পাঠকের তথ্যপিপাসা মেটানোর চেষ্টা নিঃসন্দেহে অনেক বড়ো চ্যালেঞ্জ। সেজন্যে একজন লেখক হিসেবে চাঁদপুর কণ্ঠ কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, নানান সঙ্কট এবং প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে চাঁদপুর কণ্ঠ তিন দশক পার করলো। অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে জেলার গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশ, এমনকি দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাভাষী পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে পাঠকপ্রিয় চাঁদপুর কণ্ঠ। এটা বড়ো এক সার্থকতা।
চাঁদপুর কণ্ঠ আর আমার সম্পর্কের গোড়াপত্তন ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে। শুরুতে শিশুকণ্ঠের পাতায় লিখতাম। তারপর পাঠক ফোরাম। এক কথায় বলা যায়, আমার সাহিত্যের হাতেখড়ি চাঁদপুর কণ্ঠই। যদিও আমার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় জাতীয় একটি মাসিক শিশুতোষ পত্রিকায়। কিন্তু অসংখ্য লেখা চাঁদপুর কণ্ঠেই প্রকাশিত হয়েছে। আজ সেই পত্রিকার আমি ‘ফরিদগঞ্জ প্রতিনিধি’। চাঁদপুর কণ্ঠের সেই শিশু লেখক আজ ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভাবতেই পুলকিত হয়ে উঠে মন।
সারা বিশ্বেই সাংবাদিকতা এখন বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ছাপানো পত্রিকা হারিয়ে যাওয়ার পথে। মরণদশায় পেয়ে বসেছে প্রিন্ট মিডিয়াকে। কমছে সার্কুলেশন, কমছে বিজ্ঞাপন। আর এর ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদপত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক নামি-দামি মুদ্রিত সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের তথ্য মতে, করোনার প্রথম চার মাসেই দেশের উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে প্রকাশিত ৪৫৬টি স্থানীয় সংবাদপত্রের মধ্যে ২৭৫টি (৬০.৩১%) সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। জাতীয় পর্যায়ের সংবাদপত্রগুলোও ধুঁকছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার একচেটিয়া আধিপত্য ও জনপ্রিয়তা। একদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারের প্রভাব, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরূপতা, আর্থিক সঙ্কট সাংবাদিকতা পেশার জন্যে এক প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
বর্তমানে সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মান ধরে রাখা, ঘটে যাওয়া ঘটনাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা, পাঠকের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে নিউজ-কনটেন্ট তৈরি করা, নির্ভুলভাবে খবরকে তুলে আনার দক্ষতা। কোনো কিছুই যেন একপেশে, একঘেঁয়ে ও বৈচিত্র্যহীন না হয়। কাজটা অত্যন্ত কঠিন হলেও সংবাদপত্র এবং সংবাদকর্মীদের তা করা নৈতিক দায়িত্ব, সেই সাথে কর্তব্যও। এর জন্যে প্রস্তুতি ও বিনিয়োগ দরকার, যা এই মুহূর্তে সংবাদপত্রগুলোর নেই। শত সীমাদ্ধতার মাঝেও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ এই বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। চাঁদপুর কণ্ঠ বেঁচে থাকুক শতাব্দীকাল। মানের প্রশ্নে আপসহীনতা অটুট থাকুক শেষদিন পর্যন্ত। কোনো অসহায় বা মজলুম যাতে আক্রান্ত না হয় চাঁদপুর কণ্ঠের মাধ্যমে। বস্তুনিষ্ঠতাহীন সংবাদ পরিহার করে নিজের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখবে- এই প্রত্যাশা প্রিয় এবং প্রাণের পত্রিকা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের কাছে। কণ্ঠ আমার শিশুবেলার ভালোবাসা।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি, ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম; সাধারণ সম্পাদক, ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাব।