শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৪, ০০:০০

শিকড় থেকে শেখরে

গিয়াস উদ্দিন মিলন
শিকড় থেকে শেখরে

১৯৯৪ সাল। বন্ধু মির্জা জাকিরের সাথে দেখা মতলবগঞ্জ শহরে। তখন আমি সেখানে সাংবাদিকতা করছিলাম। বন্ধু জাকির বললো, তোকে পেয়ে ভালোই হয়েছে। ইকবাল ভাই (অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার) পত্রিকা বের করবে। প্রতিনিধি খুঁজতে আসছি। আমার আর কষ্ট করতে হলো না। তুই এখান থেকে কাজ কর। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, ইকবাল ভাই তো আর পত্রিকার কাজ করবে না। পত্রিকার সাথে আর কে কে আছে? ও বললো, আগে শুরু করি, তারপর দেখা যাক কী হয়। সেই থেকে চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে যুক্ত হলাম। পত্রিকাটির গুরুদায়িত্ব নিলেন শ্রদ্ধাভাজন কাজী শাহাদাত ভাই। তাঁর নেতৃত্বে পত্রিকাটি উত্তরোত্তর পাঠকের মন জয় করতে শুরু করলো।

কিছুদিনের মধ্যেই আমি চলে এলাম চাঁদপুর সদরে নিজের এলাকায়। শাহাদাত ভাই এবার আমাকে দায়িত্ব দিলেন সদর উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে। তাঁর সাথে জাকির, আমি এবং অন্যান্য সহকর্মী পত্রিকাটিকে পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেলাম।

এ পথচলার একটি ঘটনা না বললেই নয়। তখন পত্রিকা অফিসটি লন্ডনঘাটস্থ শাহজালাল প্রিন্টার্স থেকে চাঁদপুর সরকারি কলেজ গেটে খলিল স্যারের প্রেসে চলে আসে। কোনো একদিন বাড়ি থেকে প্রেসে এসে দেখি শাহাদাত ভাই হতাশ হয়ে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী ভাই, কোনো সমস্যা? তিনি বললেন, টাকার অভাবে সম্ভবত এ সংখ্যাটি আর বের হচ্ছে না। তাঁকে সাহস দিয়ে বললাম, আপনি কাজ এগিয়ে নেন। টাকার বিষয়টি আমি দেখছি। সাথে সাথে নেমে গেলাম গ্রাহক তৈরির অভিযানে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে প্রায় একশ’ গ্রাহক করে ফেললাম। তখন এক বছরে মাত্র ১০০ টাকায় একজন গ্রাহক হতে পারতেন যে কেউ। এক দিন পরেই আমি যখন ৩০০০ টাকা এনে শাহাদাত ভাইয়ের হাতে দিলাম, তখন তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, সত্যিই তোমাকে পেয়ে আমি অনেক সাহস পেয়েছি। সেই থেকে পত্রিকাটি ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে। শাহাদাত ভাইসহ পোস্টাল গ্রাহকদের জন্যে পত্রিকা পাঠাতে গিয়ে মেঝেতে বসে আমরা পত্রিকা ভাঁজ করেছি, টিকেট লাগিয়েছি বছরের পর বছর। তখন পত্রিকা প্রকাশ হতো লেটার প্রেস থেকে।

কয়েক বছরের ব্যবধানে পত্রিকা অফিসটি স্থানান্তর হলো চাঁদপুর রেলওয়ে হকার্স মার্কেটে। সেই অফিসেই চাঁদপুর কণ্ঠে প্রথম একটি কম্পিউটার যুক্ত হয়। লেটার প্রেস ছেড়ে চাঁদপুরে প্রথম চাঁদপুর কণ্ঠ আধুনিক প্রিন্টিং জগতে প্রবেশ করে। দিন দিন পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা আরো বাড়তে দেখে একদিন চাঁদপুর প্রেসক্লাবে গিয়ে ইকবাল ভাই বলে ফেললেন, তিনি পত্রিকাটি দৈনিক করতে চান। বসলেন আমাদেরকে নিয়ে।

তাই হলো। পত্রিকাটিকে দৈনিক আকারে প্রকাশিত করার জন্যে কাজ শুরু করলাম আমরা। এ ক্ষেত্রে আমাদের সাথে আরো যুক্ত হয়েছিলেন বন্ধু আলম পলাশ, ছোট ভাই রোকনুজ্জামান রোকনসহ আরো অনেকে। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা এবং ব্যক্তি ইকবাল-বিন-বাশারের ব্যাপক পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে পত্রিকাটি দৈনিক করার কাজ অনেক সহজ হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্স আনতে গিয়ে চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক জানিবুল হক স্যারের সাথে পরিচয় হয় সেখানে। তখন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ইকবাল-বিন-বাশারের সালাম দিয়ে বললাম, চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকাটি দৈনিক করতে আপনার দপ্তরের ছাড়পত্র প্রয়োজন। একটুও দেরি না করে তিনি বললেন, কাল এসো, আমি কাজটি করে দেবো। সত্যিই তিনি সেদিন সে কাজটি করে দিয়েছিলেন। আমি আজও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

চূড়ান্ত অনুমোদনের পর দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। বড়ো আকারে অফিস নেয়া হয় শহরের গুয়াখোলা রোডে ঢোকার পথে বাঁ দিকে হাবিব চেয়ারম্যানের বাড়িতে। দৈনিক পত্রিকায় আমার পদ দেয়া হয় সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার কাম ম্যানেজার হিসেবে। সততা এবং নিষ্ঠার সাথে কিছুদিন কাজ করার পর পত্রিকাটির সরকারি বিজ্ঞাপন তালিকাভুক্তির দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ডিএফপিতে সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকাশের তালিকাভুক্ত হয়। এর পেছনের যে শক্ত কারিগর তিনি হচ্ছেন কাজী শাহাদাত। তাঁর এক সপ্তাহের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পত্রিকাটির ৬০ পৃষ্ঠার উদ্বোধনী সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এ সময় ৭২ ঘণ্টা অফিসে থেকে একটানা কাজ করেছিলেন কাজী শাহাদাত ভাই। আমরা ক’জন ছিলাম তাঁর সহযোগী। আমাদের সাথে ক্রমশ যুক্ত হয়েছিলেন জনাব মাহবুবুর রহমান সুমন, শহীদ পাটোয়ারী, বিএম হান্নান, এসএম আন্ওয়ারুল করীম, রহিম বাদশা, মহিউদ্দিন সরকার, মিরণ প্রমুখ।

আমি পত্রিকাটির সরকারি বিজ্ঞাপন তালিকাভুক্তির অনুমোদন নিয়ে কাজ করছিলাম। অফিস থেকে আমাকে এই কাজের জন্যে ঢাকা রাখা হয়েছিলো বেশ কিছুদিন। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার চাঁদপুর আসতাম ঈগল লঞ্চযোগে। একদিন লঞ্চ না পেয়ে স্টিমারযোগে চাঁদপুর এসে দেখি পুরো শহর পানিতে ভাসছে। বড় স্টেশন থেকে কোর্ট স্টেশন পর্যন্ত রেল লাইনের ওপর দিয়ে নৌকা চলছে। সেদিন স্টিমারটি বড় স্টেশন মোলহেডের ঘূর্ণি¯্রােতে পড়ে বিকল হয়ে হাইমচর পর্যন্ত চলে যায়। সেটি মেরামতের পর রাত তিনটায় চাঁদপুর স্টিমার ঘাটে এসে পৌঁছায়। এতো রাতে কোথায় যাবো, কার কাছে উঠবো ভেবে না পেয়ে নিশি বিল্ডিং কোয়ার্টারের পাশে একটি মেসে বন্ধু রুহুল আমিন সবুজের রুমে গলাসমান পানিতে হেঁটে গিয়ে উঠি। সে এক কঠিন স্মৃতি। সবুজ আমাকে কিছু খাওয়ানোর জন্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু শেষে আর খাওয়া হলো না। জোয়ারের পানিতে তার ভাত-তরকারির পাতিলগুলো ভেসে যায়। সেও না খেয়ে ছিলো। মাচায় তোলা চৌকির ওপর ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দুই বন্ধু ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ জোয়ারের পানি এসে আমাদের চৌকিটাও ডুবিয়ে দিলো। ভেবেছিলাম সেটিই বোধ হয় জীবনের শেষদিন। কিন্তু না, রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় সে যাত্রা বেঁচে গেলাম। যা হোক, শত কষ্টেও পত্রিকাটিতে মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলাম। সমাজের নানা অসঙ্গতি, দুর্নীতি, সরকারের উন্নয়ন নিয়ে আমার বড়ো বড়ো লেখা পাঠক হৃদয়ে বেশ দাগ কেটেছিলো। পাঠকের উৎসাহ-প্রেরণায় প্রতিনিয়তই লিখেছি পত্রিকার পাতায় পাতায়। বাণিজ্যিকভাবেও পত্রিকার জন্যে আমার প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিলো। সে কারণে আমাকে সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার কাম জেনারেল ম্যানেজার করা হয়েছিলো।

ততোক্ষণে পত্রিকা কার্যালয়টি আবার চলে আসে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের পাশে রেড ক্রিসেন্ট ভবনের তৃতীয় তলায়। সেখানে অনেক দিন কাজ করেছি। কাজের সন্তুষ্টিতে পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক ইকবাল ভাই আমাকে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন।

শাহাদাত ভাইয়ের সাথে আমার দীর্ঘ এই পথচলার সময় অনেক সহকর্মী পত্রিকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু আমি শাহাদাত ভাইকে কথা দিয়েছিলাম, মালিক সম্পাদক হলে অন্যত্র যাবো। না হয় আপনার সাথেই একসাথে কাজ করবো। তাই করেছি। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক মেঘনা বার্তা পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিয়েছি। তবে আজও চাঁদপুর কণ্ঠ পরিবারের সাথে রয়েছে আমার সমান্তরাল সখ্যতা। এ সম্পর্ক থাকবে অনন্তকাল।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে পত্রিকাটি ৩০ বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে জেনে সত্যিই আমি আনন্দিত। পত্রিকার এ পথচলায় আমিও গর্বিত অংশীদার। কারণ ৩০ বছরের মধ্যে প্রায় ২৩ বছর আমি এই পত্রিকাটির সাথে যুক্ত ছিলাম। সংক্ষেপে যদি বলি, আমার ভরা যৌবনটাই উৎসর্গ করেছি চাঁদপুর কণ্ঠে। আর পত্রিকাটিও আমাকে দিয়েছে অনেক। পুরানো পত্রিকার পাতায় পাতায় লেখা আছে আমার নাম। মতলব প্রতিনিধি, চাঁদপুর সদর উপজেলা প্রতিনিধি, স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার (ক্রাইম), সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার কাম ম্যানেজার, জেনারেল ম্যানেজার এবং যুগ্ম সম্পাদক বানিয়েছে আমাকে এ পত্রিকাটি। অবশেষে সম্পাদকও হয়েছি সেই অভিজ্ঞতার বলে।

পত্রিকাটির মূল স্টিয়ারিংয়ে আছেন কাজী শাহাদাত ভাই। একজন কাজী শাহাদাত আছেন বলেই পত্রিকাটির সুনাম আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। যিনি এখানেই সমর্পণ করেছেন তাঁর জীবন-যৌবন। তাই তাঁকেও প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাই। পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক শ্রদ্ধেয় ইকবাল ভাই, বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্লাহ, ম্যানেজার সেলিম রেজা, চীফ রিপোর্টার বিমল চৌধুরী, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার মিজানুর রহমান, সার্কুলেশন ম্যানেজার সোহাঈদ খান জিয়াসহ সবার প্রতি রইলো আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

ভালো থেকো দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ। সগৌরবে এগিয়ে চলো অনন্তকাল।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক মেঘনা বার্তা ; সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি, চাঁদপুর প্রেসক্লাব; সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়