প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০
চাঁদপুর কণ্ঠে আমার ১৮ বছরের কর্মজীবন
অক্টোবর ২০০১। বন্ধুদের সাথে আড্ডার ফাঁকে বন্ধু জসিম ও শিমুকে বললাম, তোদের সাথে আমাকে চাঁদপুর কণ্ঠে চাকরির ব্যবস্থা করে দে। তখন এই দুজন চাঁদপুর কণ্ঠে পত্রিকা বিলিকারক হিসেবে চাকরি করতো। শিমু বললো যে, তোর দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, শিক্ষাগত সনদসহ চাকুরির আবেদন দে। তখন আমি বললাম, কার বরাবর চাকরির আবেদন করবো? তখন বন্ধু জসিম হাসতে হাসতে বললো, তুই আমার বরাবর চাকরির আবেদন কর। শিমু বললো, জসিম দুষ্টামি করিস্ না, জাহাঙ্গীরের সিরিয়াসলি চাকরি লাগবে। শিমু আমাকে বললো, তুই চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক বরাবর আবেদন কর। যাই হোক, অবশেষে ২৫ অক্টোবর ২০০১ তারিখে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক বরাবর চাকুরির জন্যে আবেদন করলাম। আবেদনটি বার্তা কক্ষে জমা দিলাম। জমা দেয়ার দুদিন পরে বন্ধু শিমু এসে বললো, তোকে ৩০ তারিখে পত্রিকা অফিসে যেতে বলেছে। ৩০ তারিখ বিকেল পাঁচটায় বন্ধু জসিমের সাইকেলের পেছনে করে চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে বার্তা কক্ষে হাজির হলাম। বার্তা সম্পাদক শহীদ ভাই, চীফ রিপোর্টার বিএম হান্নান ভাই, ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন মিলন স্যার আমাকে ডেকে ইন্টারভিউ নিলেন ও আমার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানলেন। পরে তৎকালীন চাঁদপুর কণ্ঠের পেস্টার ও হেড এমএলএসএস বাবু ভাইকে ডেকে শহীদ ভাই বললেন, এই বাবু! ওর নাম জাহাঙ্গীর, ওর বাড়ি রফিক ভূইয়া ও কালু ভূঁইয়াদের বাড়ির কাছে। আগামীকাল থেকে ও এমএলএসএস পদে চাকুরিতে জয়েন করবে। তখন বাবু ভাই বললেন, কোন্ লাইনে তাকে দিবো, সব লাইনে তো আমাদের স্টাফ আছে। ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন মিলন স্যার বললেন, আমাদের হাজীগঞ্জ ও মেহেরের পত্রিকার বান্ডিল নিয়ে যে ছেলেটা যেতো ও পয়লা ডিসেম্বর থেকে চাকরি করবে না। ঐ হাজীগঞ্জ ও মেহের লাইনে ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকে জাহাঙ্গীর পত্রিকার বান্ডিল নিয়ে যাবে, আর নভেম্বর মাসে সদরের সবার পত্রিকার লাইনগুলো চিনে রাখবে ব্যাকআপ হিসেবে। মিলন স্যার আমাকে বললেন, তোমার কি সাইকেল আছে ? আমি বললাম, জি¦ আছে। আমাকে বললেন যে, ঠিক আছে তুমি কালকে থেকে সকাল পাঁচটার দিকে অফিসে আসো। পত্রিকার চীফ রিপোর্টার বিএম হান্নান ভাই বাবু ভাইকে বললেন, বাবু আপাতত আঃ মালেক, জসিম, নজরুল, শিমু, খোরশেদ এদের সবার লাইন চিনানোর ব্যবস্থা করো। পরে আমাকে বললেন, আজকের মতো আসো। সাইকেলের বিষয়টা নিয়ে আমি একটু মিথ্যাই বলেছিলাম। কারণ আমার সাইকেল ছিলো না। আর সাইকেল না থাকলে চাকরি হবে না। কেননা পত্রিকা বিলির কাজ বাইসাইকেলে হতো।
বাড়িতে এসে বড়োভাইয়ের একখানা বহু পুরাতন সাইকেল পঞ্চাশ টাকা দিয়ে মেরামত করলাম। নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে চাঁদপুর কণ্ঠের চাকুরি সকল পত্রিকা বিলিকারকের লাইন চেনার মাধ্যমে শুরু হলো। প্রথম এক সপ্তাহ অফিসে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন শিমু বললো, দোস্ত তোর চাকরিটা তো মনে হয় হবে না। আমি বললাম, কেন? সার্কুলেশন ম্যানেজার সগীর ভাইয়ের কাছে নজরুল বিচার দিছে তোর বিরুদ্ধে। তোর লগে নাকি অনেক আগে এলাকার একটা ঝগড়া আছে। একাউন্টেন্ট কামাল ভাই শিমুর মুখে কথা শুনে বললেন, এলাকার ঝামেলা এলাকায় থাকবে। আমি সগীর ভাইয়ের সাথে কথা বলবো, জাহাঙ্গীর এখানে চাকরি করবে। আমি নজরুলের সাথে জাহাঙ্গীরের একটা মিট করে দেবো। একাউন্টেন্ট কামাল ভাইয়ের মাধ্যমে নজরুল আর আমার মধ্যে একটা সমঝোতা করা হলো। ওই থেকে নজরুল আর আমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হলো। তখন পত্রিকা অফিসে কাজকর্ম শেখার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি হেল্প আমাকে নজরুলই করেছে। কথায় আছে, শত্রু যখন বন্ধু হয়। অতীব দুঃখের বিষয়, বন্ধু নজরুল রফ রফ লঞ্চের নিচে পড়ে মারা গেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট আমি পাই। যাই হোক, প্রথম এক মাস সকালে পত্রিকা লাইন চেনা ও অফিসে বিকেলে ডিউটির মাধ্যমে সময় পার করলাম। পরে ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ থেকে বান্ডেল নিয়ে মেঘনা ট্রেনযোগে হাজীগঞ্জ, মেহের স্টেশন ও কালিয়াপাড়া যেতাম। প্রতিদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে জেগে হাতমুখ ধুয়ে পত্রিকা অফিসে যেতাম। অফিসে সাইকেল রেখে বান্ডিল নিয়ে ভোর পাঁচটায় মেঘনা ট্রেনে উঠতাম। তখন পত্রিকা অফিস ছিল গুয়াখোলা রোডে ৪নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে হাবিব চেয়ারম্যানের বিল্ডিংয়ের নিচ তলায়।
বান্ডিল নিয়ে ট্রেনে যাওয়ার ডিউটি করছিলাম ঠিকমত। দুমাস পর সহকর্মী জসিম পত্রিকা বিলির কাজ ছেড়ে দেয়। সে প্রেসে প্লেট মেকারের কাজ শিখবে বিধায় তার লাইনে আমাকে পত্রিকা বিলি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন সহকর্মী আঃ মালেক সপ্তাহে তিনদিন নাইট ডিউটি করতো। তিনদিন করতো নজরুল। আর আমি করতাম একদিন। এভাবেই চার বছর পত্রিকা বিলি ও অফিস ডিউটির মাধ্যমে সময় পার হলো। ২০০৪ সালের মে মাসে নজরুল মারা গেলে ও আব্দুল মালেক ছাপাখানায় প্রেসের কাজ শিখবে বলে আমাকে প্রধান সম্পাদক স্যার নিজে ডেকে বললেন, জাহাঙ্গীর তুমি আমাদের পেস্টিংয়ের কাজটা দ্রুত শিখো। আমরা তোমাকে দিয়ে আর পত্রিকা বিলি করাবো না। তুমি আমাদের পেস্টিংয়ের কাজ করবা। আমিও খুশিতে খুব দ্রুত পেস্টিংয়ের কাজ শিখলাম। আমাকে পেস্টিং কাজ শেখানোর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যার অবদান তার কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন তখনকার চাঁদপুর কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক ও আমাদের এলাকার বড়োভাই আন্ওয়ারুল করীম ভাই (সম্প্রতি যিনি ইন্তেকাল করেছেন)। যিনি আমাকে অতি আদর ও স্নেহের সাথে পেস্টিংয়ের কাজ শিখিয়েছিলেন। তাঁর ছোটভাই ছিদ্দিক ছিলো আমার ক্লাসমেট। একদিন সকালবেলা প্রেস থেকে পেস্টিং ও পত্রিকা নিয়ে আসার সময় রিক্সায় আমি পেস্টিংয়ের ফিল্ম শীট ফেলে রেখে এসেছিলাম। রাতের বেলা পেস্টিংয়ের ফিল্ম শীট খুঁজে পায় না। ঐদিন আমার সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো। ফিল্ম শীট খুঁজে না পাওয়ার কারণে নির্বাহী সম্পাদক এসএম আন্ওয়ারুল করীম ভাই বার্তা সম্পাদক শহীদ ভাইকে বিষয়টি অবগত করলে শহীদ ভাই ও আন্ওয়ার ভাই বললেন, এই বিষয়টি প্রধান সম্পাদক মহোদয় যদি শুনেন তাহলে এটা নিয়ে অনেক রাগ করবেন। তাই শহীদ ভাই রিক্সা করে রাত ৯টায় আমাদের বাড়িতে হাজির। আমাকে অফিসে নিয়ে গেলেন। আমি সহ অনেক খোঁজাখুঁজির পরে আমার মনে হলো, রিক্সায় ফিল্ম শীট ফেলে রেখে এসেছি। তখন এসএম আন্ওয়ারুল করীম ভাইকে বললাম, আমি এখন কী করবো? স্যার তো এটা নিয়ে অনেক রাগ করবেন। আন্ওয়ার ভাই বললেন, তুমি নিশ্চিন্তে বাসায় গিয়ে ঘুমাও। আমি ব্যবস্থা করছি। পত্রিকার জন্যে নতুন ফিল্ম শীট রেডি করলেন তিনি।
এভাবেই আন্ওয়ার ভাই আমাকে আমার কাজে অনেক সহযোগিতা করেছেন। জুন ২০০৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পেস্টার পদে কর্মরত ছিলাম। পেস্টার পদে ১৪ বছর চাকুরি করাবস্থায় সকল কর্মকর্তা ও সহকর্মীর ভালোবাসা পেয়েছি। চাঁদপুর কণ্ঠের সাবেক বার্তা সম্পাদক শহীদ পাটোয়ারী ভাই আমাকে সব সময় দুষ্টামি করে বন্ধু বলে ডাকতেন। নির্বাহী সম্পাদক মির্জা জাকির ভাই, তাঁর সম্পাদনায় শিশু কণ্ঠ পাতা বের হতো সপ্তাহে একদিন। সপ্তাহে দুদিন ছিলো তাঁর পত্রিকা মেকাপের দায়িত্ব। ওই দুদিন রাত নয়টা বাজতে দেরি আছে, ওনার দেয়া ফোন কল আমার মোবাইলে বাজতে দেরি হতো না। তিনি কল দিয়েই বলতেন, কিরে টাউট, আর কতক্ষণ দেরি, কখন আসবি? অফিসে দ্রুত আয়, আজকে আমার শিশুকণ্ঠের পাতা আছে। আজকে আমার পত্রিকার মেকাপ আছে। তুই জানিস্ না? দ্রুত আয় টাউট। আসলে তিনি আমাকে ভালোবেসে এভাবে টাউট বলতেন। এটা আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। এখন আর সেই প্রিয় মানুষের কল আমার মোবাইলে বেজে উঠে না আর সেই টাউট শব্দ কানে আসে না। মাঝে মাঝে তার সাথে দেখা হয়। তিনি এখনও সেই টাউট বলে আমাকে ডাকেন। সেই প্রিয় মানুষের মুখের হাসি আমার কাছে সব সময় ভালো লাগে। তার টাউট ডাক শুনতেও আমার কাছে ভালো লাগে।
বর্তমান বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্লাহ ভাইয়ের সম্পাদনায় বের হতো সাহিত্য পাতা। আহসান ভাইয়ের সপ্তাহে একদিন ছিল পত্রিকা মেকাপের দায়িত্ব। তিনি আমাকে ৯টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে ফোন দিয়ে বলতেন, কিরে নির্বাহী সম্পাদক মির্জা জাকির ভাইয়ের ছোট ভাই টাউট জাহাঙ্গীর, তুই কখন আসবি, পত্রিকা অফিসে আজকে আমার সাহিত্য পাতা আছে। আজকে আমার পত্রিকা মেকাপের দিন, দ্রুত আয় টাউট। আহসান ভাইয়ের একটা কমন ডায়ালগ ছিলো, ‘মনা’ ধর এই নিউজটা এখানে লাগা, ‘মনা’ এই হেডিং টা এখানে লাগা, ‘মনা’ দেখতো এই ছবিটা কোথায় লাগালে ভালো দেখা যায়। আর ওনার এই ‘মনা’ ডাকটা ওনার সকল সংগঠনের ছোট ভাইদেরকেও ডাকতেন।
অন্যান্য বিভাগীয় পাতার মধ্যে ইসলামীকণ্ঠ পাতার দায়িত্বে ছিলেন সাংবাদিক মাজহারুল ইসলাম শফিক ভাই। পরে ইসলামী কণ্ঠের দায়িত্ব পান ম্যানেজার সেলিম রেজা ভাই, পাঠকফোরাম পাতার দায়িত্বে ছিলেন শান্ত ভাই, পরে আসেন ক্ষুদিরাম দাস, তারপরে মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। ক্রীড়াকণ্ঠের দায়িত্বে ছিলেন মিজান ভাই, তারপরে এই দায়িত্ব পান চৌধুরী ইয়াসিন ইকরাম ভাই। সংস্কৃতি অঙ্গনের দায়িত্বে ছিলেন গোলাম মোস্তফা ভাই। পরে সংস্কৃতি অঙ্গনের দায়িত্বে ছিলেন কবির মিজি, চিকিৎসাঙ্গনের দায়িত্বে ছিলেন এসকে জিয়া ভাই। আরো সাপ্তাহিক পাক্ষিক বেশ কিছু পাতা আছে। সকল বিভাগীয় সম্পাদকের সাথে আমার ছিলো গভীর ও আত্মার সম্পর্ক। এ কারণে সকলে আমাকে খুব ভালবাসতেন।
যার কথা না বললেই নয়। আমার লেখা হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি চাঁদপুরে সাংবাদিক গড়ার কারিগর, ভালো মনের মানুষ গড়ার কারিগর, সাংবাদিক ও সম্পাদক জগতের পরিচ্ছন্ন ব্যক্তির কথা না লিখি। তিনি হচ্ছেন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত স্যার।
এতো বড়ো মাপের একজন সাদা মনের মানুষের সাথে দীর্ঘ ১৪ বছর ওনার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করার মতো সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। যার কাছে আমি শিখেছিলাম কীভাবে একটা মানুষ পরিশ্রম করে কিছু করতে পারে ও ভালো জায়গায় আসতে পারে। আমি আরো শিখেছি একটা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব কীভাবে দিতে হয়। সেই মহান মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরে আমি নিজেকে অনেক গর্বিত মনে করি। আমার মনে আছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখ চাকুরি থেকে অব্যাহতি নেই। আমি কাজী শাহাদাত স্যারের রুমে গিয়ে আমার আইডি কার্ডটি হস্তান্তর করতে গেলে তিনি আমাকে বলেন, তুমি আমাদের কাছে আইডি কার্ড কেন হস্তান্তর করছো? আমরা তো তোমাকে একবারে ছাড়ি নি। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন হলে ডাকতে পারি। তুমিও তোমার প্রয়োজনে অফিসে আসবা বলে ম্যানেজার সেলিম ভাইকে ডেকে বললেন, জাহাঙ্গীরের সাথে হিসাব নিকাশ করে তার পাওনা বুঝিয়ে দিন। এতো বড়ো মাপের একজন ব্যক্তি আমাকে সর্বশেষ এভাবে হাসিমুখে বিদায় দিলেন- আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
দীর্ঘ আঠারো বছর চাকরি জীবনে বিভিন্ন সময় পদোন্নতি হয়েছে। প্রথমে এমএলএসএস পদে ৯৫০ টাকা বেতনে চাকুরিতে যোগ দেই। পরে পদোন্নতি হয় হেড এমএলএসএস পদে এবং পেস্টার ও সহকারী সার্কুলেশন ম্যানেজার পদে। সর্বশেষ ৫০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন হয়। তারপর চাকুরি থেকে ইতি টানলাম।
লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেঘনা ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক, ঢালীঘাট বাজার, চাঁদপুর; সাবেক পেস্টার,
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।