বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ৩৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে 'আল্লাহু চত্বর'
  •   চাঁদপুর কণ্ঠৈর কলামিস্ট এএসএম শফিকুর রহমানের ইন্তেকাল
  •   নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পেল সেনাবাহিনী
  •   জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ প্রধান উপদেষ্টার ১০০ কোটি টাকার অনুদান
  •   মেঘনায় নিখোঁজ দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০

চাঁদপুর কণ্ঠ আমার আজীবনের ভালোবাসা

পারভেজ খান
চাঁদপুর কণ্ঠ আমার আজীবনের ভালোবাসা

২০০১ সাল। ঢাকা থেকে এসে চাঁদপুর সরকারি কলেজে বিকম প্রথম বর্ষে ভর্তি হলাম। পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করার তাগিদ ছিলো সবসময়। একদিন এমন আলোচনার এক পর্যায়ে একমাত্র বোন-জামাই আবু সাঈদ কবির পাটোয়ারী বললেন, তোমার কথা বলা আর লেখার স্টাইল খুবই ভালো, তুমি সাংবাদিকতায় ভালো করবে, লেগে যাও। বললাম, চাঁদপুরে থেকে সাংবাদিকতা কীভাবে সম্ভব? তিনিই প্রস্তাব দিলেন চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত স্যারের সাথে কাজ করার। পরদিন দুজন মিলে গেলাম, দেখা করলাম এবং রঘুনাথপুর ও সাখুয়া ইউনিয়নের সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার প্রাথমিক অনুমোদনপত্র নিয়ে চলে আসলাম। শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়।

এলাকার বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে লেখা শুরু করলাম। বাসায় থাকা ক্যামেরা দিয়ে আবোলতাবোল ছবি তোলা শুরু। এক রিলে ৩০-৩৫টি ছবি হতো। ওয়াশ করতাম, অফিসে জমা দিতাম। প্রধান সম্পাদক মহোদয় দু-একটি পছন্দ করতেন, ছাপাতেন। তাতেই আমি খুশি। নতুন অবস্থায় নিজের পকেটমানি থেকেই ফিল্ম কেনা ও ওয়াশ করার খরচ মেটাতাম। পত্রিকার শুরুর দিকে খুব সহজেই খুব অল্প সময়ে আমার পথচলা বেগবান হতে লাগলো। প্রাথমিক নিয়োগের মাস তিনেক না যেতেই প্রধান সম্পাদক একদিন ডেকে বললেন, তুমি যেহেতু সরকারি কলেজে পড়ো, কাজেই ক্যাম্পাস রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে পারো। তোমার আপত্তি না থাকলে সেই সাথে চাঁদপুর শহর প্রতিনিধির পদটাও আমি তোমাকে দিতে চাই। সাত-পাঁচ না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। কাজ শুরু করলাম আমার সিনিয়র বড় ভাই সাংবাদিক মির্জা জাকির, গিয়াসউদ্দিন মিলন, বিএম হান্নান, শহীদ পাটোয়ারী, এসএম আন্ওয়ারুল করীম, গোলাম মোস্তফা, মিজানুর রহমানসহ অনেকের সাথে।

সাংবাদিকতায় কাজ শুরুর ছয় থেকে সাত মাসের মাথায় একদিন প্রধান সম্পাদক ডেকে আমাকে বিভিন্ন উপজেলা থেকে পাঠানো প্রতিনিধিদের হাতে লেখা বেশ কিছু সংবাদের স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এগুলো এডিট করে দাও। তখন সংবাদ এডিটিং কী জিনিস বুঝতাম না। প্রধান সম্পাদক মহোদয়কে বললাম, কীভাবে কী করবো। তিনি বললেন, এগুলো পত্রিকায় ছাপানো যায় এমন উপযোগী করে ঠিক করে দাও। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সব স্ক্রিপ্ট এডিট করে তাঁর কাছে জমা দিলাম। পরদিন অফিসে আসার পরে তিনি বললেন, তুমি আমাদের সম্পাদনা বিভাগে কাজ করতে পারো, মাসে বারোশ’ টাকা বেতন পাবে। প্রতিদিন বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তোমাকে সংবাদ এডিটিং ও প্রুফ রিডিংয়ে কাজ করতে হবে। কী জানি কী বুঝে রাজি হয়ে গেলাম। শুরু হয়ে গেলো সাংবাদিকতার বেতনভুক্ত চাকরি। প্রতিদিন বিকেলে অফিসে এসে মির্জা জাকির ভাই ও এসএম আন্ওয়ারুল করীম ভাইয়ের সাথে সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করলাম। কিছুদিন পর নতুন আইডি কার্ড পেলাম, যেখানে লেখা ছিলো সহ-সম্পাদক বা সাব-এডিটর।

সেই থেকে শুরু। গুয়াখোলা রোডের মাথার অফিস থেকে চলে আসলাম প্রেসক্লাব সংলগ্ন রেড ক্রিসেন্ট ভবনে। একাধারে ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পত্রিকা অফিসে কাজ করে আসলাম। পত্রিকায় নিয়মিত সহ-সম্পাদক পদে কাজ করার পাশাপাশি পাঠক ফোরাম, শিক্ষাঙ্গন, চিকিৎসাঙ্গন, বাজার কড়চাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় সম্পাদক পদে কাজ করলাম বেশ কিছু বছর। ২০১০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর পেশাগত উন্নয়নের জন্যে ব্যবসায় মনোযোগী হই, কিন্তু পত্রিকার সাথে সম্পর্ক ছাড়িনি কখনোই। নিয়মিতভাবে না পারলেও অনিয়মিতভাবে পত্রিকায় সংবাদ প্রেরণ, বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্য মাধ্যমে পত্রিকার সাথে যুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি সবসময়। ২০১৮ থেকে ২০২০ করোনা মহামারির আগ পর্যন্ত পুনরায় পত্রিকা অফিসে সাব-এডিটর পদে কাজ করেছি। তবে গত দু-তিন বছর নানা কারণে পত্রিকা অফিস থেকে অনেকটাই দূরে সরে থাকলেও শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত স্যার আমাকে ভুলেননি। তিনি বারবার বিভিন্ন উপলক্ষে আমাকে পত্রিকায় লেখালেখি করাসহ অফিসে নিয়মিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন এবং গত বেশ কিছুদিন আগে তিনি ফেসবুকে আমার একটি ছবি দেখে আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, যতো কাজই করো না কেনো পত্রিকায় লেখালেখি ও কাজ করার প্রতি তোমার যে মেধা রয়েছে সেটা কেনো কাজে লাগাচ্ছো না ? মাঝে মধ্যে কিছু লেখালেখি, ছবি পাঠানোসহ পত্রিকা অফিসের সাথে সম্পর্ক রাখলে তোমার কী এমন ক্ষতি হয়ে যায়? আসলেই আমি নিজেও বুঝি না মাঝে মাঝে সম্পর্কটা তো রাখাই যায়। আমি কেমন যেনো নিয়মিত থাকতে পারি না কোথাও। সত্যি আমার প্রতি শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত স্যারের এমন আগ্রহ আমাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। আজকের এই লেখাটিও তাঁর অনুরোধেই লেখা।

আমার মনে আছে, তিনি একবার বলেছিলেন, কোনো একটি দুর্নীতির নিউজ সংক্রান্ত বিষয়ে। আমাকে নিয়ে যখন সংবাদে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রধান সম্পাদকের নিকট আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে আসলেন, তখন প্রধান সম্পাদক মহোদয় তাদের উপর এতোটাই উত্তেজিত হয়েছিলেন যে, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করাটাই আমাদের জন্যে বিড়ম্বনাকর হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তিনি উত্তেজিত অবস্থায় তাদেরকে বলেছিলেন, পারভেজ খান দীর্ঘদিন আমার সাথে কাজ করছে, সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য হলেও পারভেজের বিরুদ্ধে অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ আমি বরদাস্ত করতে পারি না। কারণ আমি তাকে খুব ভালো করেই চিনি। সত্যি সেদিন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়েছিলো। সম্ভবত এই কারণেই সাংবাদিকতা পেশায় আমি টিকে থাকতে কিংবা এগিয়ে যেতে পারিনি। সাংবাদিকতায় সবাই অসৎ নয়, আবার অধিকাংশই সৎ নয়। বর্তমানে জীবন-জীবিকার তাগিদে শতভাগ সততার সাথে দায়িত্ব পালন করা আসলেই অনেক কঠিন। আর ঠিক এই কারণেই আমি সম্ভবত এই পেশায় নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে পারি না। নিয়মিত এবং অনিয়মিত সময় ধরলে বিগত ২ যুগ আমি চাঁদপুর কণ্ঠ তথা গণমাধ্যমের সাথে জড়িয়ে আছি। কিন্তু অবাক করা সত্যটি হচ্ছে, এই শহরে কাজ করছে এমন অনেক সাংবাদিকই আমাকে চিনেন না। আমার দায়িত্বকালে পাঠক ফোরামে হালকা লেখালেখি করেছেন কিংবা গল্প-কবিতা লেখায় যাদেরকে আমি উৎসাহ প্রদান করেছি, তাদের অনেকেও আজকে অনেক বড়ো বড়ো সাংবাদিক হয়েছেন। এমন বিষয়গুলো ভাবতে খুব ভালো লাগে। এই শহরে এক সময় পত্রিকা প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছিলো। কে কার চাইতে আধুনিক পত্রিকা বের করতে পারে তেমন তোড়জোড় কম যায়নি। এমনও হয়েছে, আমাকে সেসব পত্রিকায় কাজ করার জন্যে মোটামুটি বেতন দেয়ারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। কারণ একটাই, আমি চাঁদপুর কণ্ঠের লোক। এক সময় এই শহরে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রশাসনে ও রাজনৈতিক মাঠে চাঁদপুর কণ্ঠের ডিমান্ড ছিলো আলাদা। বর্তমানে অসংখ্য পত্রিকার ভিড়ে সেই ডিমান্ড কী অবস্থায় আছে তা হয়তো হলফ করে আমি বলতে পারবো না। তবে এতোটুকু বলতে পারবো, কাজী শাহাদাত যতোদিন এই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক, ততোদিন চাঁদপুর কণ্ঠের অবস্থান আর কেউ নিতে পারবে না।

সুদীর্ঘ পথচলায় আমি চাঁদপুর শহরে শুধু এমন একজন সাংবাদিককে দেখেছি যিনি একাধারে একজন সম্পাদক, একজন সাংবাদিক তৈরির কারিগর, একজন সমাজহিতৈষী, একজন সামাজিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক এবং ভিন্নধর্মী সামাজিক ও শিক্ষানুরাগী কার্যক্রমে অগ্রণী। তিনি কাজী শাহাদাত, যাঁর হাত ধরে এই শহরে একাধারে শত সাংবাদিক যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি অসংখ্য সামাজিক সংগঠন ও সংগঠকও তৈরি হয়েছে। তিনি চাইলে জাতীয় পর্যায়ে বড়ো কোনো পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বও পেতে পারতেন। কিন্তু কী এক অজানা কারণে, কী এক ভালোবাসার মোহে তিনি এই চাঁদপুরেই থেকে গেলেন। তাঁর কাছ থেকে সাংবাদিকতা শিখে এই শহরে পত্রিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকে। বলতে গেলে চাঁদপুর শহরে অধিকাংশ পত্রিকার সম্পাদক একসময় তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর হাত ধরে এই শহরে অনেকেই উপরে উঠেছেন, অনেকেই অর্থকড়ির মালিক যেমন হয়েছেন, তেমনি সামাজিকভাবে মর্যাদাশীল অবস্থানেও পৌঁছেছেন। আমার দেখা এমন অনেক ঘটনাই আছে, যা এখানে লিখলে হয়তো অনেকে বর্তমান অবস্থানে অসম্মান বোধ করতে পারেন। কারণ এই সমাজ ব্যবস্থায় কারো হাত ধরে কেউ উপরে উঠলে সেই হাতটির পরিচয় তারা দিতে রাজি থাকেন না।

পরিশেষে শুধু এটাই বলবো, লেখালেখি করি বা না করি, সাংবাদিকতায় যুক্ত হই বা না হই শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত এবং চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার সম্পর্ক থাকবে আজীবন।

লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়