বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |  
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে 'আল্লাহু চত্বর'
  •   চাঁদপুর কণ্ঠৈর কলামিস্ট এএসএম শফিকুর রহমানের ইন্তেকাল
  •   নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পেল সেনাবাহিনী
  •   জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ প্রধান উপদেষ্টার ১০০ কোটি টাকার অনুদান
  •   মেঘনায় নিখোঁজ দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৪, ০০:০০

সাংবাদিকতা শিক্ষায় তিনিই আমার প্রধান শিক্ষক

মোহাম্মদ কামাল হোসেন
সাংবাদিকতা শিক্ষায় তিনিই আমার প্রধান শিক্ষক

প্রতিটি মানুষের জন্মের পর শিক্ষা অর্জন করার জন্যে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। তেমনি কর্মের জন্যেও ভালো প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা প্রধানের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বা কর্মচারীর ভবিষ্যৎ। সাপ্তাহিক থেকে পরবর্তীতে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ চাঁদপুরের সাংবাদিকদের জন্যে একটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে যিনিই ছাত্র হয়েছেন তিনিই প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক হয়েছেন। যেমন আমি নিজেই একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক এবং সাপ্তাহিক আমার কণ্ঠ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক হয়েছি। এমন আরো অসংখ্য রয়েছে। আর এর পেছনের মূল কারিগর দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট ইকবাল বিন বাশার এবং প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত।

আমার শিক্ষা জীবনে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জন করেছি এবং কর্মজীবনে আমি সাংবাদিকতার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। পেয়েছি প্রতিষ্ঠান প্রধানদের আদর, ভালোবাসা এবং শাসনও। আমার কর্মজীবনে জেলার সেরা সাংবাদিকতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’। আর ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেরা প্রধান সম্পাদক হলেন কাজী শাহাদাত। আর আমি তাঁরই হাতে গড়া ছাত্র। আমার যতো সুনাম বা খ্যাতি অর্জন আছে সবই সাংবাদিকতার সেরা শিক্ষক কাজী শাহাদাত ভাইয়ের কল্যাণে।

চাঁদপুর জেলায় বর্তমান সময়ে যারা সিনিয়র সাংবাদিক রয়েছেন তাদের ৮০ ভাগই দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ নামে সাংবাদিকতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক কাজী শাহাদাতের ছাত্র। তাঁর সততা, দক্ষতা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা অপরিসীম। এমন আরেকজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক চাঁদপুরে এখনো জন্মেই নি। তিনি জেলার অন্যতম প্রথিতযশা সাংবাদিক। যাঁর বিকল্প এখনো কেউ হতে পারেনি। যাঁর অসংখ্য সাংবাদিকতার ছাত্র জেলা-উপজেলায় রয়েছে। তিনি তৈরি করছেন তাঁর ছাত্রদেরকে তাঁর মতোই। তাঁরা সবাই সুনামের সাথে সাংবাদিকতা করছেন। কাজী শাহাদাত চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার বলাখাল গ্রামের ঐত্যিবাহী কাজী বাড়ির সন্তান। যাঁর বাবা, মা, ভাই ও বোনেরা স্ব স্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠত ছিলেন এবং আছেন।

আমার জন্ম ধনাঢ্য পরিবারে। আমার বাবা অনেক ধনী পরিবারের সন্তান। আমার বাবা ষোলশ’ শতাংশ জায়গার মালিক ছিলেন। আমরা ১০ ভাই-বোন। বাবা হাজীগঞ্জ হামিদিয়া জুট মিলে চাকরি করতেন। ওই টাকা দিয়ে সব খরচ চলতো না। হঠাৎ করে হাজীগঞ্জ হামিদিয়া জুট মিল বন্ধ হলে আমাদের পরিবারে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে বাবা তাঁর নিজ বাবার এবং তাঁর নিজের ক্রয় করা সম্পত্তি বিক্রি করে আমাদের সব ভাই-বোনকে লেখাপড়া করান কম-বেশি। ভাই-বোনদের মধ্যে আমি একটু রাগী। কেউ মিথ্যা বলেছে বা বেয়াদবি করেছে- এটা আমার পছন্দ হতো না। সাথে সাথে প্রতিবাদ করতাম। এটা অনেকে ভালো চোখে দেখতো না। তারপরেও আমি আমার প্রতিবাদণ্ডনীতি থেকে সরে আসিনি।

লেখাপড়া করার প্রয়োজনে আমার মেঝোভাই আলমগীর আমাকে চাঁদপুরে নিয়ে যান। প্রথমে সিংহপাড়া কালু কমিশনারের বাসায় থাকতাম এবং কিছুদিন পর প্রফেসর পাড়ায় আমাদের বাসা নেয়া হয়। বিকেল বেলা পত্রিকা পড়ার জন্যে বিভিন্ন দোকান বা জায়গা খুঁজতাম। কিন্তু ভালো জায়গা পেতাম না। ক’দিন পর নাজিরপাড়া কলেজ মসজিদের নিকটে জিলানী প্রিন্টার্সের অফিসে কিছু পত্রিকার সন্ধান পেলাম, যেগুলো একটা লোক বসে বসে পড়তেন। তখন সাংবাদিকতা বা সাংবাদিক কী বুঝতাম না। চাঁদপুর থেকে সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো। আমি দেখলাম টেবিলের ওপরে ২/৩ টা স্থানীয় আর ৪/৫টা জাতীয় পত্রিকা। আমি প্রায়শ সেখানে পত্রিকা পড়ি। একদিন চেয়ারে বসে থাকা লোকটি আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, তুমি এখানে বসছো কেন? আমি হা করে তাকিয়ে থাকি। তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বের করে দিলেন। আমি কিছু না বলে বের হয়ে আসলাম। পরের দিন আমি আবার গিয়ে দেখি লোকটি অফিসে নেই। আমি আস্তে গিয়ে আবারও পত্রিকা পড়তে থাকি। এভাবে ফাঁকে ফাঁকে পত্রিকা পড়তে যাই। আরেক দিন আমি পত্রিকা পড়ার সময় তিনি এসে বললেন, এই ছেলে তোমার বাড়ি কই? তুমি প্রায় এখানে ঢোকো কেনো? আর তুমি কী পড়, ছোট মানুষ। এ বলে আমার পরিচয় জানতে চান। আমি দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলি, আমার বাড়ি হাজীগঞ্জ। আমার ভাইয়ের সাথে থাকি লেখাপড়া করার জন্যে। তখন বললেন, তোমার ভাইয়ের নাম কী? তখন আমার মেঝোভাইয়ের নাম বললে তিনি বলেন, ওহ্ তোমার ভাইকে চিনি। সে হাজীগঞ্জ পৌরসভায় চাকরি করে।

পরের দিন আমি আমার ভাই আলমগীরকে বলি, আমি জিলানী প্রিন্টার্সে গিয়ে পত্রিকা পড়ার সময় আমাকে বকা দিয়েছে। আরো অনেক কথা বলেছে। ভাই আমাকে বলেন, তিনি কাজী শাহাদাত। তাঁর বাড়ি বলাখালে আমাদের বড়োবোনের বাড়ির উত্তর পাশে কাজী বাড়ি। আর তিনি চাঁদপুরের বড়ো সাংবাদিক। তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ ও একজন বড়ো মাপের সাংবাদিক। ঠিক আছে আমি বলে দিবো তুমি আমার ছোট ভাই। এরপর থেকে আমি সেখানে গিয়ে পত্রিকা পড়লে তিনি আর আমাকে কিছুই বলতেন না।

কম্পিউটার শেখার জন্যে চাঁদপুর রেলওয়ে হকার্স মার্কেটে ইউনিভার্সেল কম্পিউটার সেন্টারে ভর্তি হলাম। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম আবু তাহের। তিনি অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। কম্পিউটারে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। ৬/৭ মাসের মধ্যে আমাকে অনেক কাজ শিখিয়েছেন। আমি তাঁর বাণিজ্যিক কাজও করতে পারতাম। ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে একজন ভালো কম্পিউটার শিক্ষক ছিলেন। তাকে এবং আমাকে কম্পিউটার সেন্টারের মালিক আবু তাহের বললেন, একটা পত্রিকার কম্পোজের কাজ পেয়েছি। তোমরা যদি অনুমতি দেও তাহলে কাজ নিবো। সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠের অফিস তখন হকার্স মার্কেটে নেয়া হয়েছে। এখান থেকে পত্রিকা বের হবে। আমরা অনুমতি দেওয়ার পর সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠের কম্পোজের কাজ নেয়া হয়। আমরা দুজন এবং সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠের আরো দুজন (বর্তমানে যুগান্তরে কর্মরত যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার এবং আবু সাঈদ কাউসার) মিলে নিয়মিত কম্পোজ করতে শুরু করি। মাঝে মধ্যে দুজন থাকে, আবার কখনো তিনজন থাকে। এভাবেই চলছে। হঠাৎ একদিন আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি একা কাজ করার সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে বা ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে সকল কম্পোজ ডিলেট হয়ে যায়। পত্রিকাটি পরের দিন বের করার তারিখ। সকল কম্পোজ ডিলেট হয়েছে এ কথা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত শুনে রেগে খেপে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তিনি কম্পিউটার সেন্টারের মালিকের সাথে রাগারাগি করেন। আর মালিক আমার ওপর দোষ চাপিয়ে দেন। কাজী শাহাদাত ভাই আমাকে রাগারাগি করে এক পর্যায়ে বলতে থাকেন ‘তোমাকে দিয়ে জমির হাল চাষ করাও সম্ভব হবে না। কী শিখছো? ভালো করে শিখো’। আরও অনেক কথা।

কয়েক মাস পর সময়ের প্রয়োজনে হাজীগঞ্জে একেবারে চলে আসতে হয়েছে। কিছুদিন পরে আমি সাংবাদিকতা করার জন্যে চাঁদপুর কণ্ঠের হাজীগঞ্জ ব্যুরো ইনচার্জ জাকির মজুমদারের সাথে কথা বলি এবং কিছুদিন তাঁর সাথে চলাফেরা করি। এক পর্যায়ে চাঁদপুর কণ্ঠে সাংবাদিকতা করার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি আমাকে আবেদন করার জন্যে বলেন। আমি জাকির মজুমদারের সুপারিশসহ আবেদনটি নিয়ে চাঁদপুর রেলওয়ে হকার্স মার্কেটের চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে গেলে কাজী শাহাদাত ভাই আমাকে বললেন, তুমি ওই ছেলেটা না? আমি বলি, জি¦ ভাই। ওহ্ তুমি সাংবাদিকতা করবে ? ঠিক আছে আবেদনটি রেখে যাও। এরপর থেকে আমি নিয়মিত সংবাদ প্রেরণ করি। মাঝে মাঝে সংবাদদাতা দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হতো। যখন আমি জাকির মজুমদারের সহযোগিতা নিয়ে ভালো ভালো সংবাদ প্রেরণ করতাম, তখনই আমার নাম দিয়ে সংবাদ ছাপা হতো। আমি পর্যায়ক্রমে বড়কুল ইউনিয়ন সংবাদদাতা, উপজেলা সংবাদদাতা, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সহকারী ব্যুরো ইনচার্জ, ব্যুরো ইনচার্জ ও বিশেষ প্রতিনিধি হই।

২০০৪ সালে ধারাবাহিক শিক্ষাঙ্গন পরিক্রমা (শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা ও সম্ভাবনা সংক্রান্ত) শিরোনামের ধারাবাহিক লেখায় আমি চাঁদপুর জেলার প্রথম স্থান অর্জন করি এবং সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করি। এছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লেখার জন্যে পুরস্কার অর্জন করি।

আমি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে লেখালেখি করার পর থেকে হু হু করে পত্রিকার গ্রাহক ও পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক পত্রিকা হাজীগঞ্জে বিক্রি হতো। এমনকি ফটোকপি পর্যন্ত বিক্রি হতো। হাজীগঞ্জের এক ধর্ম ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে লেখালেখি করার কারণে এতো বেশি চাঁদপুুর কণ্ঠের সার্কুলেশন হয়েছে, যা অবাক করার মতো। পত্রিকার জন্যে সারাক্ষণ ফোন আর ফোন ছিল। পাঠকরা ফটোকপি করে পড়তেন। এর জন্যে আমি মামলাও খেয়েছি। পালিয়ে ছিলাম চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে। আরো অনেক ঘটনার সংবাদও লিখেছিলাম। মাসে ২০ দিন আমার লেখা সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম থাকতো চাঁদপুর কণ্ঠে।

২০০৯ সালে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের আয়োজনে পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু করা হয়। বিতর্ক কাকে বলে আমাদের মফস্বলের স্কুল শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের তেমন জানা ছিল না। পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক আয়োজকরা প্রশিক্ষণের আয়োজন করে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেন। এরপর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানেন বিতর্ক কাকে বলে। পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক আয়োজনে আমি সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে অংশগ্রহণ করাতে সক্ষম হয়েছি। এজন্যে আমি পুরস্কার পেয়েছি।

কী নেই দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে। আরো বহু কাজে চাঁদপুর কণ্ঠের অবদান রয়েছে।

নব্বইর দশকের শেষদিকে সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ প্রকাশিত হতো রেলওয়ে হকার্স মার্কেটস্থ অফিস থেকে। তখন কোনো এজেন্টের সাথে চুক্তি ছিলো না। কারণ সাপ্তাহিক পত্রিকাকে তেমন কোনো গুরুত্ব দিতো না এজেন্ট মালিকরা। তারপরেও আমরা প্রতি সংখ্যা মাথায় করে হাজীগঞ্জের দুটি এজেন্টের কাছে রাখতাম। এজেন্ট পত্রিকা একপাশে রাখতেন। কেউ কিনতেন বা কেউ এক নজর দেখার পর রেখে চলে যেতেন। অধিকাংশ পাঠক সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ পড়তেন বলাখাল কাজী বাড়ির কাজী শাহাদাতের কারণে। তারা মনে করতেন, আমাদের এলাকার মানুষের পত্রিকা।

পত্রিকার সার্কুলেশন কী জিনিস আমরা বুঝতাম না। সপ্তাহে একবার পত্রিকা পাঠায়, আবার সার্কুলেশন? হঠাৎ অফিস থেকে বলা হলো, হাজীগঞ্জে প্রতিটি অফিসে পত্রিকা পৌঁছাতে হবে। কর্মকর্তাদেরকে পত্রিকা পড়ানো বা চাঁদপুর কণ্ঠ নামে একটি পত্রিকা যে আছে তা বোঝাতে হবে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের খবরাখবরের জন্যে যেনো আমাকে ডাকে এ কৌশল অবলম্বন করতে বলা হলো। আমরা হাজীগঞ্জে যারা কর্মরত ছিলাম, তারা সবাই এ কৌশলে সপ্তাহে একবার উপজেলার প্রতিটি দপ্তরে কর্মকর্তাদের হাতে সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ পৌঁছে দেই। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর হাজীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন কর্মকর্তা আমাকে খবর দিতেন তাদের অনুষ্ঠানের খবর পত্রিকায় ছাপানোর জন্যে। তখন পত্রিকার সংখ্যাও বেড়ে যায়, আমাদের মূল্যায়নও বাড়ে। সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠের জন্যে আপেক্ষায় থাকতেন পাঠকরা।

অফিস থেকে আবার নির্দেশ আসলো, উপজেলা ও পৌরসভার প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা, ঠিকানা পাঠানোর জন্যে। আমি ঠিকানা সংগ্রহ করে অফিসে পাঠালাম। কিছুদিন পরে বলা হলো, প্রতিটি অফিসে সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ ডাকযোগে পাঠানো হয়েছে। উপজেলা প্রতিনিধি ব দায়িত্বপ্রাপ্তরা খোঁজ-খবর রাখবে ঠিকমতো অফিসার বা ডাক্তাররা পত্রিকা পান কি না। আমি সুযোগ-সুবিধা মতো যখন যে ইউনিয়নে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে যেতাম তখন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার বা অফিসারের সাথে আলোচনা করতাম। তারা বলতেন, ভাই আমরা পত্রিকা পাঠাতে বলিনি। কে বলছে পত্রিকা পাঠানোর জন্যে? পত্রিকার টাকা দিবে কে? আমরা বলতাম, আগে আপনি পত্রিকা পড়েন এবং পত্রিকার লেখা কেমন হয় আমাদেরকে জানান। তখন তারা বলেন, পত্রিকার লেখা বা সবকিছুই সুন্দর হচ্ছে।

আবার সিদ্ধান্ত আসলো, বছরে একবার পত্রিকার টাকা উত্তোলন করতে হবে। প্রথমে দায়িত্ব দেয়া হলো, প্রতিটি ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যিনি দায়িত্বে আছেন তার কাছ থেকে টাকা আদায় করা হবে। কিন্তু এভাবে টাকা আদায় করা কঠিন বিধায় চাঁদপুর কণ্ঠ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলো জেলা অফিসের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের অফিসার থেকে টাকা আদায় করা হবে এবং এ সিদ্ধান্ত মোতাবেক টাকা আদায় করা হয়। এরপরে অফিস থেকে আসলো সুখবর। সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। অপেক্ষায় থাকার জন্যে বলা হলো। কিছুদিন পরেই অফিস থেকে খবর আসলো সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠকে দৈনিক হিসেবে জেলা প্রশাসক ডিক্লারেশন দিয়েছেন। আবার শুরু হলো নতুন উদ্যমে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ পাঠকের হাতে পৌঁছানোর দায়িত্ব। আমিসহ আরো যারা দায়িত্বে ছিলেন সবাই মিলে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠকে প্রতিটি দপ্তরে এবং এজেন্টের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ, অল্প সময়ের মধ্যে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ জেলার সেরা পত্রিকা হিসেবে পাঠকের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং আমাদেরও মান-সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। চাঁদপুর শহরের পরে হাজীগঞ্জে সার্কুলেশন, বিজ্ঞাপন, সংবাদ পরিবেশনসহ সর্বক্ষেত্রে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের হলো জয়জয়কার। আজও কেউ চাঁদপুর কণ্ঠকে পেছনে ফেলতে পারেনি, পারবেও না। প্রতি বছর দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠকে বিজ্ঞাপন বাবদ যে ব্যবসা দেয়া হতো, তা চাঁদপুর জেলার কোনো পত্রিকা ১০ বছরেও পায়নি। অবশেষে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ নেয়ার জন্যে এজেন্ট চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে, যা এখনো চলমান রয়েছে।

অনেক কথাই বলেছি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ নিয়ে। কিন্তু যাঁর কারণে সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ এবং অল্প সময়ের মধ্যে জেলাবাসীর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় পত্রিকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, তিনি আমাদের সবার প্রিয় কাজী শাহাদাত ভাই। চাঁদপুর কণ্ঠকে নিজের সন্তান মনে করে লালন-পালন করেন। কর্মচারীদেরকে তাঁর সকল মেধা-বুদ্ধি দিয়ে পরিচালনা করেন।

প্রতিভাবান ব্যক্তির সংখ্যা খুবই কম। কাজী শাহাদাত চাঁদপুর জেলায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন বিদগ্ধ সাংবাদিক। জেলার যে যতো বড় নেতা বা সম্মানিত ব্যক্তি হোক, কাজী শাহাদাত ভাইকে দেখলে তাঁকে সম্মান দিয়ে কথা বলেন। তিলে তিলে কুমিল্লার সাপ্তাহিক রংধনু পত্রিকার বলাখাল সংবাদদাতা থেকে চাঁদপুর জেলার সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রধান সম্পাদক হওয়া অত্যন্ত কঠিন। এ কঠিন কাজটি তিনি নিজ যোগ্যতায় করেছেন।

কর্মচারীরাও কাজী শাহাদাত ভাইয়ের কথার বাইরে যান না। যেভাবে নির্দেশ দেন, সেভাবেই সবাই প্রাণ খুলে চাঁদপুর কণ্ঠের জন্যে কাজ করেন। কাজী শাহাদাত ভাই শুধু একজন সম্পাদকই নন, তিনি বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী এবং একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবে রয়েছে তাঁর কাঁড়ি কাঁড়ি সুনাম। কখনো অর্থের পেছনে ঘুরেন নি। ঘুরেছেন জ্ঞান অর্জনের জন্যে। আর এ জ্ঞান বিকশিত করেছেন চাঁদপুর কণ্ঠের মাধ্যমে চাঁদপুরবাসীর জন্যে। তাঁর প্রতিটি কর্মচারী বা প্রতিনিধি তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন। আর এ জ্ঞান দিয়ে তারাও আজ নিজ নিজ উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত। আমি নিজেও তাঁর জ্ঞান, কর্ম, আদর্শ ও সততা অর্জন করে এখন সাপ্তাহিক আমার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। এ ধরনের উদাহরণ পুরো জেলাতেই আছে। আমি এখনো সংবাদ সম্পাদনায় বসলে আমার প্রিয় সাংবাদিক-শিক্ষক কাজী শাহাদাত ভাইকে অনুভব করি। তিনি একদিন বলেন, ‘কখনো পত্রিকার মালিক বা সম্পাদক হলে কোনো প্রতিনিধি চলে গেলে তার ছবি পত্রিকায় ছাপাবা না। কারণ এটা হলো সবচেয়ে অপমানজনক কাজ। চলে গেছে যাক। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের এটাই হলো বড়ো বৈশিষ্ট্য। তুমি তা করবে।’ আমি পত্রিকা বের করার সময় অনেকে আমার সাথে ছিলো, কিন্তু নানা কারণে অনেকে চলে গেছে। আমি কাউকে পত্রিকায় ছবি দিয়ে বহিষ্কার করিনি, করবোও না। আরেকটা কথা তিনি বলতেন, ‘তুমি সৎ থাকলে তোমাকে কেউ হারাতে পারবে না। সাময়িক অসুবিধা করতে পারবে। তার স্থায়িত্ব থাকবে না। তুমি এগিয়ে যাবে’।

চাঁদপুর শহরের বহু প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন ও রয়েছেন কাজী শাহাদাত। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত। ইচ্ছা করলে চাঁদপুরের নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা কাজী শাহাদাত ভাইয়ের কর্মময় জীবন-ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে প্রতিজন আদর্শবান সাংবাদিক বা ব্যক্তি হতে পারবেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবো, তিনি আমার প্রিয় কাজী শাহাদাত ভাইকে যেনো সুস্থ রাখেন সবসময়। যেনো তিনি মানুষের কল্যাণে জ্ঞান বিকশিত করতে পারেন। আমিন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক, সাপ্তাহিক আমার কণ্ঠ; সাবেক সভাপতি, হাজীগঞ্জ প্রেসক্লাব; সাবেক ব্যুরো ইনচার্জ (হাজীগঞ্জ), দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়