প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৪, ০০:০০
ভালোবাসার আরেক নাম চাঁদপুর কণ্ঠ
চাঁদপুর কণ্ঠের ৩০ বছরপূর্তি। শুনেই মনটা আনন্দে দোল খেলো। ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ লঞ্চে বসে মোবাইলে মোটামুটি লেখাটি শেষ করেছিলাম। দুর্ভাগ্য! ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫টায় সদ্য কেনা মোবাইল ফোন, মানিব্যাগসহ সমস্ত কিছু চুরি হয়ে যায়। ফলে ৬ ফেব্রুয়ারি নতুন করে শুরু করতে হলো। আগের লেখার কিছুই থাকলো না এখানে।
আগেই বলেছি, চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার প্রথম প্রেমের কথা, যা মনে আছে নিশ্চয় আপনাদের। প্রেম শব্দটি শুনলেই আজকাল অনেকেই টাসকি খায়, লজ্জা পায়। পত্রিকার সাথে আবার কীভাবে প্রেম হয়! প্রেম হয় মানুষে মানুষে। আবার আজকাল আমাদের এতোটাই অধো-গতি হয়েছে যে, শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া প্রেম বুঝি না। প্রকৃতির সাথে প্রেম, বিশেষ জিনিসের প্রতি প্রেম, দেশের প্রতি প্রেমসহ হাজারো প্রেম আছে, যেটি না ছুঁয়ে, না ধরে অনুভব করা যায়।
সম্প্রতি একটি তামিল ছবি দেখেছিলাম, নাম ‘থালাইভি নেত্রী’। সেটি দেখেও বুঝবেন প্রেম কোথায়, কীভাবে হয়? উদাহরণ দিই। যেমন বেলি ফুলের গন্ধ আপনি কি ছুঁয়ে অনুভব করতে পারেন? খেয়ে অনুভব করতে পারেন? একদমই না। কিন্তু কতোটা প্রেম এই গন্ধের প্রতি। দোকানে গিয়ে পারফিউম খুঁজতে গেলে বেলি ফুলের গন্ধযুক্ত পারফিউম খুঁজি অথবা গোলাপের বা জুঁই ফুলের। অতএব, পত্রিকার প্রতি প্রেম এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
আমি যখন চাঁদপুর সরকারি কলেজে গ্রন্থাগার প্রধান ছিলাম, তখন প্রতি মঙ্গলবার অফিস সহায়ক রতন দা সমকাল পত্রিকা এনে বলতেন, আপনার গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা এসেছে, নেন। এখানে গাফ্ফার চৌধুরীর লেখার সাথে প্রেম।
মান্না দে গেয়েছেন, ‘বলো কাগজের মূল্যটা কত আর; যদি কালির আঁচড় না টানা হতো বুকে তার’। আর সেজন্যেই এই চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার সেই প্রেম। যখন চাঁদপুরের অধিকাংশ মানুষ এই পত্রিকার সাথে আছে, খুব ভোরে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের সাথে ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ চাই, তখন এই পত্রিকার সাথে প্রেম থাকাই তো বুদ্ধিমানের কাজ, কী বলেন? বিষয়টি অন্য জায়গায়। চলুন ৩০ বছর আগের গল্প শুনি।
তখন আমি পিটিআইতে। পিটিআই হলো প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। পিটিআইতে ম্যাগাজিন বের হবে। তখন আমি সবেমাত্র মা হয়েছি। বাচ্চার লালন-পালনের ওপর বিদেশি বই পড়ছি। আপনারা সবাই জানেন, পিটিআইতে শিশুদের অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ট্রেনিং করতে আসেন এবং ইন্টারমিডিয়েট পাস করেই তখন প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রার্থী হতে পারতো। এটা আমি এজন্যে লিখলাম, এই প্রশিক্ষণার্থীরা নিজেরাও আমার কাছে বেশ ছোট। আমি ভেবেছিলাম, মায়েদের করণীয়, বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয়তা, শিশুর প্রতি মায়ের দায়িত্ব-কর্তব্য ইত্যাদি নিয়ে একটি লেখা লিখি। মায়েরা-বাবারা সচেতন হবে। শিশু শিক্ষার্থীদের যত্ন নিবেন। যে ভাবা সেই কাজ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার লেখাটি ছাপা হয়নি। তখন থেকেই আমি চুপসে গেলাম। যেটা লিখি সেটা ডায়েরি পর্যন্ত।
১৯৯৭ সালে আমি ফেণী সরকারি কলেজ থেকে বদলি হয়ে এসে চাঁদপুর সরকারি কলেজে যোগদান করি। আমি লিখি। একজন লেখক তার লেখা অন্যকে না পড়িয়ে কোনোভাবেই শান্তি পান না। একদিন স্বপন দা (সঙ্গীত নিকেতনের কর্ণধার) পড়ে বললেন, নিভা, তোর লেখা অনেক ভালো, তুই লিখে যা। পত্রিকায় না ছাপালে অসুবিধা নেই।
একদিন চাঁদপুর সরকারি কলেজে আমি টেবিলে বসে হিসাব করছিলাম। পত্রিকা, ম্যাগাজিন, শিক্ষক/শিক্ষার্থীদের চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সময় আমার দুষ্টু-মিষ্টি শিক্ষার্থীরা এসে ঘিরে ধরলো, ম্যাম আপনার লেখা পত্রিকায় এসেছে, মিষ্টি খাবো। আমি বিশ্বাস না করে একই পজিশনে রইলাম। বলছে, সত্যি ম্যাম চাঁদপুর কণ্ঠে আপনার লেখা এসেছে। এবার আপনারাই বলুন, যেখানে আমি লেখা পাঠালাম না, যোগাযোগ করলাম না সেখানে লেখা যাবে--ভাবা যায়? ওরা নাছোড়বান্দা, তরুণ প্রজন্ম হলে যা হয় আর কি! পত্রিকা নিয়ে এসে আমার চোখের সামনে রাখলো। এবার আমার টাসকি খাওয়ার পালা। বড়োবড়ো হরফে লেখা ‘কী যে ভালো লাগছে আমার, তৃপ্তি সাহা’। শরীরে আনন্দের নাচন খেলে গেলো। যদিও প্রকাশ করলাম কম। কারণ ছেলে-মেয়েদের সামনে প্রকাশ করতে চাইলাম না, এটা আমার বিশাল পাওয়া। ওদের কী খাইয়েছি মনে নেই। কারণ ধারে কাছে মিষ্টির দোকান ছিলো না, হয়তো সিঙ্গারা খাইয়েছিলাম। কিন্তু আমার বিস্ময় কাটে না- কীভাবে হলো! চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত সাহেবের ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম, তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজের ম্যাগাজিনে আমার লেখাটা পড়েছেন। তার ভালো লেগেছে, তাই ছেপেছেন। এই গল্পটা করার কোনোই দরকার ছিলো না। কিন্তু একজন সম্পাদক যখন তার দৈনিক পত্রিকার প্রতিদিনের প্রুফ দেখা, অফিসিয়াল কাজের পরেও যখন অন্য কিছু পড়েন, খুঁজে বেড়ান ভালো কিছু- সেই পত্রিকাটি কতোটা মূল্যবান, আদর্শ, সৎ, পাঠকপ্রিয় পত্রিকা হতে পারে বলাই বাহুল্য। আর পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে মূল্যবান কালির আঁচড়ে। তাই প্রেম হয়ে গেলো চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে। শুধু কি তাই? প্রেম হয়ে গেলো এর উপর যারা কালির আঁচড় কাটে, তাদের সাথেও।
এর পরের কাহিনি খুব সোজা। আজকে যাকে আমরা গবেষক, লেখক, কবি হিসেবে চিনি, প্রশংসায় মেতে উঠি সেই মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের ওপর দায়িত্ব পড়লো আমার লেখা সংগ্রহ করার। কতো ছোটটি ছিলো মুহাম্মদ ফরিদ হাসান! ২য় বর্ষ বা ৩য়। কী মিষ্টি সরলতায় ভরা চেহারা! আমরা আপন হয়ে গেলাম। ওর লেখার ক্ষুরধার, জানার আগ্রহ, ওর স্বপ্ন সব কিছুর প্রেমে পড়লাম আমি। যে ছেলেটির আকাশসমান স্বপ্ন তাকে আটকানোর ক্ষমতা কারো নেই। পরিচয় হলো আহসান ভাই আর আলআমিন হোসাইনের সাথে।
চাঁদপুরের সাংবাদিকতা জগতে যাঁরা আছেন বা নাম করেছেন, যাঁরা লেখক, তাঁদের অনেকেরই এই প্রতিষ্ঠানেই হাতেখড়ি। মানুষ তৈরি করার কারিগর চাঁদপুর কণ্ঠ। আর যিনি এই নৌকার মাঝি, বৈঠাটি ধরে রেখেছেন, তিনি প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত। তাঁর হাত ধরেই পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার কার্যক্রম দীর্ঘ ১৫ (পনেরো) বছর ধরে চলছে। যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে নিজেদেরকে ঋদ্ধ করেন। শুনেছি খুব সম্প্রতি চাঁদপুর কণ্ঠ বির্তক একাডেমির কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে। জয় হক চাঁদপুর কণ্ঠের, জয় হোক জয় হোক বাঙালির, জয় হোক বাংলাদেশের।
রবীন্দ্রনাথের একটি গান দিয়ে শেষ করি-
‘যিনি সকল কাজের কাজী মোরা তাঁরি কাজের সঙ্গী।
যাঁর নানা রঙের রঙ্গ মোরা তাঁরি রসের রঙ্গী ॥
তাঁর বিপুল ছন্দে ছন্দে
মোরা যাই চলে আনন্দে’
লেখক : সাবেক গ্রন্থাগার উন্নয়ন কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং সাবেক গ্রন্থাগারিক, চাঁদপুর সরকারি কলেজ।