প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৪, ০০:০০
স্মৃতির পাতায় চাঁদপুর কণ্ঠ
দেখতে দেখতে বয়স ৩০বছর পূর্ণ করলো চাঁদপুর কণ্ঠ। পত্রিকাটির মাইলফলক দুঃসাহসিক অভিযাত্রার কয়েক বছরের সহযাত্রী ছিলাম আমিও। মফস্বল এলাকায় সাংবাদিক কিংবা লেখক তৈরির এক উর্বর ক্ষেত্র দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ। আমার জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে চাঁদপুর কণ্ঠ।
হে কণ্ঠ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ সমাজ ও জাতির কল্যাণকর কাজে তুমি পরিচয় দিয়েছ দক্ষতার, যোগ্যতার, সর্বতোভাবে শ্রেষ্ঠত্বের। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে বিন্দুমাত্র পক্ষপাত করোনি। পক্ষপাতহীনতা সত্যই তুমি সর্বদা প্রকাশ করেছ। দেশের কুশলের জন্যে অকাতরে উৎসর্গময় প্রচারে রয়েছে তোমার ভূমিকা। বস্তুনিষ্ঠতাই তোমার আদর্শ। তুমিই দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ। নানা চড়াই-উতরাই পার করে এখনও তুমি স্বমহিমায় টিকে আছ। তোমাকে প্রণতি জানাতেই হয়। কেননা, তুমি আমাকে লেখক হিসেবে গড়ে তুলেছ। তোমার মাঠে আমি কলম চালিয়ে জ্ঞানের আলো পেয়েছি। তুমিই আমার পত্রিকা জগতের প্রথম মাঠ। তোমা থেকে সৃষ্টি আমি। তোমার বয়স এখন ৩০বছর। আমার বয়স ৪৬।
২০০৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই স্বনামধন্য পত্রিকায় সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, কবিতাসহ নানা বিষয়ে লেখালেখি করেছি। পরে দীর্ঘ ৯ বছর চাঁদপুর কণ্ঠে লেখালেখি করতে না পারার বেদনা আছে মনে।
লেখালেখির শুরুটা আমার হয়েছিল ১৯৯৮ সালে আর্ট পেপারে দেয়াল পত্রিকার মাধ্যমে। শাল্লা সদরে ‘নবজাগরণ সাহিত্য সংসদ’ নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলাম তৎকালীন সময়। বর্তমানে এই সংগঠনটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০০২ সালে আমি সিলেটে চলে যাওয়ার কারণে সংগঠনটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। সাহিত্য চর্চায় উদরপূর্তি হয় না বটে, তবে সাহিত্যের চেতনা তৈরি হয় হৃদয় থেকে। কিন্তু পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে জরুরি। অনেক কষ্টে সিলেট সিটির সোবহানী ঘাটে চিত্রাঙ্কনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি জীবিকা নির্বাহের জন্যে। প্রতিষ্ঠানটিকে পরিচিত করতেই সময় লেগেছে দুবছর। ফলে সিলেটে লেখালেখির তেমন একটা সময় পাইনি। কিন্তু যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের আম্বরখানাস্থ শাহজালালের দরগাহে সন্ধ্যায় আসেন তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী। আমি ছিলাম দরগাহ গেটের অদূরেই। ভেতরে যাওয়ার জন্যে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো আমার হৃদয়। কেঁপে উঠলো পুরো সিলেট শহর। প্রাণভয়ে দিগি¦দিক ছুটতে থাকেন সাধারণ মানুষ। ব্যবসায়ীরাও দোকানপাট বন্ধ করতে লাগলেন। আমিও বুঝে না বুঝেই সবার সাথে দৌড়ে পালালাম। পরে খবর পেলাম শাহজালালের দরগাহে বোমা হামলা হয়েছে। এতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী গুরুতর আহত হন। বোমা হামলায় পুলিশসহ মারা যান বেশ ক’জন। আহত হয়েছিলেন প্রায় অর্ধশত। আমি ভাবলাম এই শহর আমার জন্যে নিরাপদ নয়। সারাদেশেই তখন কোথাও না কোথাও বোমা হামলার খবর পাচ্ছিলাম। দেশে এমন জঙ্গিবাদের উত্থানে ভাবছিলাম কোথায় যাবো?
এক্ষেত্রে আমায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কুমিল্লার রহিমপুর অযাচক আশ্রমের সম্মানিত অধ্যক্ষ ডাঃ যুগল ব্রহ্মচারী ও চাঁদপুর অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ কবিরাজ সুখরঞ্জন ব্রহ্মচারী। ২০০৪ সালে আমি চাঁদপুর শহরে ছোট একটি স্থানে রং-তুলির ব্যবসা চালিয়ে যাই জীবিকার জন্যে। তখন চাঁদপুর শহর ছিল বন্যার কবলে। শহরের রাস্তা পানির নিচে। মেঘনা-ডাকাতিয়া নদী ও শহর মিলেমিশে যেনো জলময়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরিচিতির জন্যে চাঁদপুর শহরের দেয়ালে দেয়ালে জনকল্যাণমূলক বাণী প্রচার করতে থাকি। এটি করতে গিয়েই চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত সাহেবের নজরে পড়ি। প্রথমেই তাঁর মাধ্যমে রোটারী ক্লাবের কিছু কাজ করি। পরে ২০০৮ সালে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ পরিবারের একজন সদস্য হওয়ার সুযোগ পাই। শুরু করি লেখালেখি। পূর্বের লেখালেখির কিছু শিরোনাম নি¤েœ তুলে ধরলাম-
দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়ে রাজনীতি, ব্লাকহোলে রাজনীতি : রণক্ষেত্র ঢাকা, ধর্মীয় ব্যক্তিদের কয়েকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড, মানব জীবনে মেডিটেশন, চরিত্র গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম, অনৈতিকতা আধুনিকতা নয়, ধাক্কা খেলো হেফাজতের ১৩ দফা, পণ্ডিত প্রবর কবি নজরুল, মেরুদণ্ড সোজা রাখুন ফল পাবেন বার্ধক্যে, মহাকুম্ভের কিছু কথা, প্রাইমারী থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত শিক্ষকের অনৈতিকতা, প্রাথমিক স্কুল সজ্জিতকরণ হতে পারে শিশুদের বিনোদনের উৎস, ব্লাকহোলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরী সাভার, রাহুল গান্ধীর ভীষ্মনীতি, জগন্নাথ রথযাত্রার ইতিকথা, অশ্রুনীড়ে মাকে স্মরণ, জীবন সায়াহ্নে বুদ্ধানন্দ, প্রতিদিন মাত্র তিন মিনিট ব্যায়াম করুন, কৃতী ফুটবলার ও সাবেক প্রশিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা অমল দত্ত অবশেষে আশ্রয় পেলেন, এ বর্বরতা সভ্যতার কলঙ্ক, দুর্নীতিবাজদের কুঠারাঘাতে বিপর্যস্ত দেশের ব্যাংকিং খাত, সমাজ সংস্কারক শ্রীশ্রী স্বরূপানন্দ, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে, স্বরূপানন্দের জন্মস্থান ও জন্মোৎসবের ইতিহাস, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহ, ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে হতাশা, ধর্ষণকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হোক, জাতিসংঘ কি ধাক্কা খেলো?, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মোৎসবের কিছু কথা, মুসাফির মোছরে আঁখি জল, শিক্ষক সাগর বিকাশ ভৌমিকের হাতে অশোভনীয় ক্রাচ, শিক্ষার অনুকূল ও চমৎকার পরিবেশে ফরক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজ, প্রাণায়াম করুন আয়ু বাড়ান, ছায়ানটের বিশিষ্ট নজরুল সংগীতশিল্পী বিজন চন্দ্র মিস্ত্রির সাথে ফোনালাপ, বিপন্ন শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে, সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হোক মানবতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করবেন না, রক্তস্নাত স্বাধীনতা, আওয়ামী লীগের জন্য অশনি সংকেত, প্রচারবিমুখ চিত্রশিল্পী অমল সেনগুপ্ত, চাঁদপুরে শুদ্ধ নির্ঝরের এক নান্দনিক প্লাটফর্ম সংগীত নিকেতন, মর্ত্যলোকে ঊমার আগমন, তোমার জন্মদিনে অভিনন্দন (চাঁদপুর কণ্ঠ), আজ সম্প্রীতির শারদ র্যালি, বড় কষ্টে জীবন কাটে কৃতী ফুটবলার ও সাবেক প্রশিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা অমল দত্তের, অনিয়ন্ত্রিত যৌবন বড়ই ভয়ঙ্কর, জানে সূর্যরে পাবে না অবুঝ সূর্যমুখী, মৃত্যু থেকে বেঁচে যাওয়া কলেজ, আমাদের বিশ্বজননী দেবী দুর্গা, হৃদরোগে আক্রান্ত চিত্রশিল্পী শম্ভু অধিকারী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বোমা বিস্ফোরণ উদ্বেগজনক নিন্দনীয় ঘটনা, একজন দায়িত্বশীল চেয়ারম্যানের কথা, আমার জীবনে স্বামী স্বরূপানন্দ, মানবিকতার গুরু ডাঃ যুগল ব্রহ্মচারী, শাল্লায় সালিস, হঠকারী তান্ত্রিক, হে বৈশাখ তুমি কাল হয়ে এসো না, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি ক্ষমার অযোগ্য, গুরু তোমায় মনে পড়ে, কলঙ্কের ছোঁয়া ক্রিকেট রাজ্যে, ব্রহ্মলোকে শ্রীমত স্বামী বুদ্ধানন্দ, তীর্থ তো নয় যেনো মরণ ফাঁদ, পেটের পীড়া হতে সাবধান, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও জীবনাদর্শ, মাদকাসক্তি এবং শিক্ষক, ধর্মের নামে ব্যভিচার, যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর হবে তো?, জয় হলো গণজাগরণের, রাজনীতিতে অভিনন্দন জয়, মাদকের আগ্রাসন দেশব্যাপী, মোদির হাতে যমদণ্ড, দুশ্চিন্তায় আদভানি, দুর্গা কাঠামোতে অসুরসৈন্য কেন?, আজ বিশেষ তিথি মহালয়া, ডাঃ যুগল ব্রহ্মচারীকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করা হোক, ধর্মান্ধতা আমাদের কাম্য নয়।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের স্মৃতির পাতায় জড়িয়ে আছে আমার এসব লেখা। আরো বহু লেখা আমার সংগ্রহে নেই। যে কারণে সেগুলো তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। যাঁর জন্যে এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়, তিনি হলেন চাঁদপুর কণ্ঠের স্বনামধন্য প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত সাহেব। চাঁদপুর শহরে অস্থায়ীভাবে বসবাস করার সুবাদে জেলার বহু গুণীজনের সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পাশাপাশি সহকর্মী, লেখক, সাহিত্যিক, কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলো আমার। আমি এই ক্ষুদ্র পরিসরে সবার নাম উল্লেখ করতে পারলাম না বলে ক্ষমা করবেন। তবে সঙ্গীত গুরু শীতল ঘোষাল এবং স্বপন সেনগুপ্তের নাম উল্লেখ করতেই হয়। কেননা তাঁরা দুজনই আমার সঙ্গীত জগতের শিক্ষাগুরু। শীতল ঘোষাল প্রয়াত হয়েছেন অনেকেরই জানা আছে। স্বপন সেনগুপ্ত এখনো জীবিত আছেন। কৃতী ফুটবলার অমল দত্ত নেই। হয়তো বেঁচে নেই আরো অনেক গুণীজন। যা আমি এখন জানিও না। কারণ আমি এখন স্থায়ীভাবে বসবাস করছি আমার জন্মস্থান সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলায়। ফলে চাঁদপুরের সংবাদ তেমন একটা পাই না। প্রযুক্তির বদৌলতে যতোটুকু সম্ভব ততোটুকুই।
সমাজ পরিবর্তনে যা অর্জন করলাম চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে : ২০১২ সালে আমার নিজ গ্রামে একটি সালিস সভায় আমার বড়োভাইকে একঘরে করে রাখার রায় দেয়া হয়। কারণ ২ হাজার টাকার বিনিময়ে ৮ শতাংশ চারাভূমি দলিল করে এক প্রভাবশালীকে দিতে বলেন গ্রামের সালিসে নেতৃত্ব দেন এমন শতাধিক প্রভাবশালী। আমার বড়োভাই ২হাজার টাকা সুদে আসলে দিতে চাইলেন। বিচারকরা মানতে রাজি নন। সভায় রায় হয়েছে দলিল করে দিতেই হবে। আমার বড়োভাই সেই রায় অমান্য করে বললেন, জমি আমার। আমি সুদে আসলে টাকা পরিশোধ করতে চাইছি, আর আপনারা রায় দিলেন জমি দলিল করে দিতে। আমি দলিল করে দিব না। ব্যস্ খেপে গেলেন বিচারকরা। ঘোষণা হলো একঘরে থাকতে হবে। খবর পেয়ে আমি সুনামগঞ্জ এসে একটি মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানাই। এরপরই নড়েচড়ে বসে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। শুরু হয় মাতব্বরদের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশন। সমাজে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। উপজেলার প্রতিটি গ্রামীণ বিচার ব্যবস্থায় এসব অমানবিকতা এখন আর নেই। ‘শাল্লায় সালিস’ এ বিষয়ে চাঁদপুর কণ্ঠে একটি লেখাও আছে আমার।
২০১৫ সালে আমি চাঁদপুর থেকে চলে আসি শাল্লায়। দু-একজন সোর্স থাকলেও কোনো সাংবাদিক নেই শাল্লায়। থাকার কথাও নয়। কেননা, এসব হাওরবেষ্টিত দুর্গম এলাকায় সাংবাদিক না থাকাটাই স্বাভাবিক। ২০১৭ সালে ৭জন সদস্য নিয়ে গঠন করি শাল্লা উপজেলা প্রেসক্লাব। প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আমাকেই। ক্লাবের সদস্য সংখ্যা এখন ১৭জন। সবারই সংবাদ শেখার হাতেখড়ি আমাকেই দিতে হয়েছে। ২০১৬ সালে পল্লী বিদ্যুতের খুঁটির ক্যারিং বাবদ পরিবার প্রতি ৫শ’ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছিল। উপজেলায় ১১৯ গ্রামের মধ্যে পরিবার রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। বিষয়টি আমার নজরে আসে। আমি সংবাদ করে কোটি টাকা বাঁচিয়ে দেই উপজেলাবাসীর। কিন্তু এলাকায় গুজব ছড়ানো হয় আমি বিদ্যুৎ আসা বন্ধ করে দিয়েছি। স্থানীয় নেতারা খেপিয়ে দেন সাধারণ মানুষকে। এলাকাবাসী আমার বিরুদ্ধে সালিস ডাকেন। আমি যথাসময়ে সালিস সভায় উপস্থিত হলেও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন না। পরে ৪ বার তারিখ পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু সালিস সভায় কেউ আসেন নি। আমি তখন আবার স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক সুনামকণ্ঠে ‘সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সালিস ডেকে উধাও প্রভাবশালীরা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করি। এতে আরো খেপে যায় মাতব্বররা। অথচ আমি উপজেলার কোটি কোটি টাকা যেখানে বাঁচিয়ে দিলাম, ধন্যবাদের পরিবর্তে নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হতে লাগলাম। মাসখানেক পরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটি ফৌজদারি মামলায় আমাকে জড়িয়ে ফেলে। ১১দিন জেল হাজতে থাকতে হয়েছে আমাকে। যদিও মামলাটি স্থায়ী হয়নি তিন মাসও।
এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ না পাওয়ার অপবাদ আর নেই। ৭ বছর পর সাধারণ মানুষের ভুল ভেঙ্গেছে। ততক্ষণে আমার ক্ষতি হয়ে গেছে প্রভূত। একই বছর উপজেলার কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল খালেকের ছেলে আমেরিকা প্রবাসী জুবায়ের আহমেদ হেলিকপ্টার যোগে শাল্লা সদরে আসেন। তার আসার উদ্দেশ্য তার পিতার নামে সদর সংলগ্ন একটি মাজার তৈরি করা। কারণ বীর মুক্তিযোদ্ধারা তার পিতা ও কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল খালেককে সদরের নিকটবর্তী কলাকান্দি নামক গ্রামের পাশে হত্যা করেন। ২০১৬ সালে জুবায়ের আহমেদকে আমার মুখোমুখি হতে হয়। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েই ধরা পড়েন তিনি। পত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হওয়ার পরই ভেস্তে যায় রাজাকারের নামে মাজার তৈরির পরিকল্পনা। সংবাদের পরই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল টিম আসে তদন্তে। মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। জেলেও যায় রাজাকারের ছেলে জুবায়ের আহমেদ।
২০২১ সালে হেফাজতের তৎকালীন নেতা মামুনুল হক আসেন দিরাই উপজেলার সানে রিসালাত নামে একটি অনুষ্ঠানে। তিনি সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশ সরকারকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেন। এর বিপরীতে শাল্লার নয়াগাঁও গ্রামের ঝুমন দাশ নামের একটি যুবক ফেসবুকে একটি বিতর্কিত স্ট্যাটাস দেন। এই স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে নয়াগাঁও গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। সেখানেও সর্বপ্রথম আমার ভূমিকা ছিলো। পরে সেটি দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। নড়েচড়ে বসে সরকার। জেল খাটে শতাধিক হামলা ও লুটপাটকারী। যদিও সেই মামলাটি বর্তমানে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। বাদী একেবারেই নিষ্ক্রিয়।
২০১৮ সালে ৫১ জন সদস্য নিয়ে শাল্লা সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করি। যারও প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতির দায়িত্বে আমি নিজেই। সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি উপজেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ শাল্লা শাখার। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করতে হচ্ছে দীর্ঘ ৭ বছর ধরে। প্রেসক্লাবের প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠান আমার হাত ধরেই হয়েছে। যদিও প্রেসক্লাবের এখনো স্থায়ী কোনো ভবন হয়নি। ভাড়ায় চলছে ক্লাবের কার্যক্রম।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনটি প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনৈতিক জীবনের আলোচিত মাঠ। স্বাধীনতার পূর্বে ও স্বাধীনতার পরেও এই আসনটিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিপরীতে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় এখনো তিনি তাঁর সংসদীয় আসনটিতে ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁরই হাতেগড়া রাজনৈতিক শিষ্য বর্তমান পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাহেবের ছোট ভাই চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (আল আমিন) উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে নৌকা প্রতীক নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিণী ড. জয়া সেনগুপ্তার কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন। সেই নির্বাচনে দিরাই-শাল্লা দুটি প্রেসক্লাবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
উন্নয়নের কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয় শাল্লা একেবারেই বিচ্ছিন্ন একটি অনুন্নত উপজেলা। এখানে মানুষ একমাত্র বোরো ফসল আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সারা বছরের সম্বল এই বোরো ধান। এটিই কালবৈশাখীসহ পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকিতে থাকে। এলাকায় দারিদ্র্যের হার বেশি। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমানে অনেকটাই এগিয়ে গেছে হাওরাঞ্চলের মানুষ। ২০-২৫ বছর আগে উপজেলায় ৪টি পেশাদার চোরের গ্রাম ছিল। যাদের ভোটার আইডি কার্ডে পর্যন্ত পেশা চৌর্যবৃত্তি উল্লেখ ছিল। এলাকায় ঘরবাড়ি কাঁচা হওয়ায় শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, স্বর্ণালঙ্কার ও গরু চুরি করতো তারা। নিরীহ মানুষ একেবারেই অসহায় ছিলো তাদের কাছে। এ নিয়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা গড়ায়। যদিও এখন তারা এই পেশা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ভিন্ন পেশায় গেলেও উল্লেখ করতে চাই না। তবে অনেকেই কৃষিকাজ করছেন। অন্যরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেছেন।
সুনামগঞ্জ জেলার এটি একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হলেও সাহিত্য-সংস্কৃতির দিক দিয়ে আমরা অনেক উন্নত। আউল বাউলের জেলা এটি। যেমন বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম, গীতিকার প্রতাপ রঞ্জন দাশ, পণ্ডিত রাম কানাই দাশ, সঙ্গীত শিল্পী সুষমা দাশ, সাম্প্রতিক সময়ে সাহিত্যে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শাল্লা উপজেলা প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য সুমন কুমার দাশসহ আরও অনেক গুণীজন আলোর দিশারী হয়ে রয়েছেন আমাদের সুনামগঞ্জ জেলায়। তাঁরাই আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথপ্রদর্শক। বামপন্থী রাজনীতিবিদ কমরেড বরুণ রায়কে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ আমাকে করতেই হবে। স্মরণ করছি ভারতের আসাম থেকে আমাদের সিলেট বিভাগকে যিনি বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত করার নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই অক্ষয় মিনিস্টারকে।
বর্তমানে আমি দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় শাল্লা উপজেলা প্রতিনিধি, সিলেট থেকে প্রকাশিত দৈনিক উত্তরপূর্ব ও সুনামগঞ্জ জেলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুনামকণ্ঠ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে নিষ্ঠার সাথে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে আসছি। দৈনিক উত্তরপূর্ব পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক বর্তমান সাংসদ। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বপালন করে আসছেন তিনি। অন্যদিকে দৈনিক ভোরের কাগজের প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরী বর্তমানে মাননীয় মন্ত্রী। পাশাপাশি ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদক শ্যামল দত্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক।
আমার উপজেলায় সামাজিক এবং সাংবাদিকতার জগতে আমার নেতৃত্ব প্রদানের জন্যে কৃতিত্ব দিতে হয় চাঁদপুর কণ্ঠ ও এর সম্মানিত প্রধান সম্পাদক জনাব কাজী শাহাদাত সাহেবকেও। তিন দশকপূর্তি উপলক্ষে পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সকল কলাকুশলীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের আরো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও সাফল্য কামনা করি। পরিশেষে চাঁদপুরবাসীর প্রতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধার পাশাপাশি ভালবাসা জানাই। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল সম্প্রদায় এবং সকল প্রাণীকুলের সুখী জীবন প্রার্থনা করি। চাঁদপুর কণ্ঠ জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিক সবার মধ্যে।
আমাকে তৈরির করার জন্য স্যালুট চাঁদপুর কণ্ঠ তোমাকে। স্যালুট গুরু কাজী শাহাদাত সাহেবকে।
জয়ন্ত সেন : সভাপতি, শাল্লা উপজেলা প্রেসক্লাব; সাবেক প্রতিবেদক ও কম্পিউটার অপারেটর, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।