রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

নবান্ন উৎসব ও একটি পাঞ্জাবি
মোঃ মোখলেছুর রহমান ভূঁইয়া

বাঙালির সংস্কৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের নান্দনিক উৎসব ‘নবান্ন উৎসব’। ঋতুবৈচিত্রের পড়তে পড়তে পোষাক-পরিচ্ছেদ, খাওয়া-দাওয়া, সামাজিকতা, ধর্মীয়, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে মেতে উঠে বাঙালি আপামর গণমানুষ। যে যার মতো করেই ব্যস্ত থাকেন দৈনন্দিন কাজকর্মের সাথে ঋতুভিত্তিক উৎসবে। অগ্রহায়ণ মাসে প্রাচীন বাংলার বাৎসরিক সূচনা সামাজিক উৎসব। ‘গোলা ভরা ধান’ মওজুদ করে কৃষক-কৃষাণীরা মনের আনন্দে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে বিশেষ করে পিঠা-পায়েশ খাওয়ার ধুম পড়ে যেতো। এই পিঠা-পায়েশ খাওয়া-দাওয়ার মাঝেই মুরুব্বিরা রসাত্মকভাবে ধাঁধাঁয় ধাঁধাঁয় বিচক্ষণতার সাথে অতিতের ঘটে যাওয়া ব্যক্তি, পরিবারের মান-অভিমান, ভুল-ত্রুটি ও সমাজের নানা অসংগতি সহজভাবে সমাধান করে দিতেন। ইতিবাচক মনোভাবে পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ ও ভ্রাতিত্ববোধ জাগ্রত হতো। একিভূত হতো সামাজিক দায়বদ্ধতা। নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালন হতো সম্প্রীতি ও সৌহাদ্যে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা চোখে পড়তো। বিশেষ করে যাত্রাপালা ও নাটকের মহড়া হতো পাড়ায় পাড়ায়। আজকের দিনে যা আজ শুধুই স্মৃতি। প্রাইমারি স্কুলেও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা করতো নাট, জারী-সারী গান। অথচ আজ সর্বাবস্থায় পরিবর্তন ও প্রাশ্চাত্যের হাওয়া। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে ‘র‌্যাগ ডে’। যা আমাদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কোনোভাবেই কোন প্রকারেই চিরচেনা ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য না। না। আমাদের ধারণ লালন-পালন করা সংস্কৃতি অক্ষুণœ রাখার দায়বদ্ধতা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকা প্রশাসনের সুস্থ ধারার মনমানসিকতায় ভরপুর কর্তাব্যক্তিরা এগিয়ে আসলে আগামীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের র‌্যাগ ডে’ নামক অপসংস্কৃতি নিবৃত করার জন্যে এখন থেকেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জোর সুপারিশ করার জোড়ালো আর্জি করছি।

শিক্ষাই সংস্কৃতির উপযুক্ত টেকসই ‘বাহন’। সেই বাহনেই আজ গর্বের লালিত সংস্কৃতি অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে! দৃশ্যমান অর্থনৈতিক মেরুদ-ের উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে বিপরীত ¯্রােতে দ্রুতগতিতে ‘অবনত/অবনম’ হচ্ছে আমাদের ঐতিহ্যের দায়বদ্ধতা। মেরুদ-হীনতায় নেতিয়ে যাচ্ছে সগৌরবের সাফল্যগাথা। আমার একান্ত ভাবনা প্রাশ্চাত্যের উন্মাষিকতায় বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তো আমরাই হারিয়ে যাবো অচিরেই।

জনপ্রিয় গানের ভাষায় ‘আ হা কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। ’৮০-র দশকের ধান কাটার উৎসবের আমেজ, আমার দেখা সেই সোনালি দিনের পটভূমিতে আজও পেছনে হারিয়ে যাই। নাইওরীদের (বিবাহিত মেয়েদের) বাপের বাড়িতে জামাইদের নিয়ে কয়েকদিন বেড়ানো ছিলো পারিবারিক আকর্ষণ। জামাইরা সামর্থ্যনুযায়ী দু হাত ভরে মাছ, পান, সুপারি শ^শুর বাড়িতে নিয়ে আসতেন। শ^শুর বাড়িতে আনন্দ-বিনোদনে দিন কাটাতেন। শ^শুর বাড়িতে পুকুরে মাছ ধরা, পানিতে ডুব দিয়ে মাছ ধরতে না পারলে শালা-সালিরা, দাদি-নানি ও ভাবিরা ঠাট্টার ছলে কুপোকাত করে দিতো।

তৎকালীন আমাদের পরিবারের প্রধান জীবিকা ছিলো কৃষি। দাদার জায়গা-জমিও ছিলো যথেষ্ঠ। হালের বলদ, কামলা (তৎকালীন ভাষায়) থাকতো সবসময়। ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক নিয়মিত কাজ করতো। ধান কাটার শেষদিন কে ‘দানি উঠছে’ বলতো। ওইদিন বাড়িতে হুজুর দিয়ে মিলাদ পড়ানো হতো এবং সব শ্রমিকদেরকে ভালো করে খাওয়ানো হতো। মাঝে মাঝে দেখতাম নতুন লুঙ্গি উপহার দিতো। নতুন লুঙ্গি পেয়ে শ্রমিকদের মুখগুলো থাকতো আনন্দে হাসিমাখা। বাড়ির উঠোনও ছিলো অনেক বড়-সড়। গরু দিয়েই ধান মারাই করা হতো। তার আগে ভোরবেলায় গরুর গোবর দিয়ে লেপন করে দিতো। সেই সময়ের সকাল বেলার উঠোনের গন্ধ/ঘ্রান আজও অনুভূতিতে অনুভূত হয়।

অগ্রহায়ণ মাসের পাকা ধানের মৌ মৌ ঘ্রানে জমির আইল দিয়ে হাঁটলে মনে হতো সোনালি বধু সেজে কুর্নিশ করতো, নতুবা লজ্জায় ঘোমটা মাথায় নুয়ে থাকতো। সেকি এক মনোরম দৃশ্য। গৃহস্থরা ধান নেয়ার পর অনেক ধানের ছড়া পড়ে থাকতো, ইঁদুরের গর্তে জমা থাকতো। এ ধানের ছড়া ভূমিহীন ও দরিদ্ররা প্রতিযোগিতায় সংগ্রহ করতো। কালের পরিবর্তনে আমাদের সমাজের ওই সময়ের হতদরিদ্র মানুষগুলো আজ বড় ভালো অবস্থানে জীবনযাপন করছেন। ধান কাটার পর ‘নাড়া’ আগুনে পুড়িয়ে দিতো। বিকেলবেলা খালি পায়ে কালো মেঘের ছাইয়ের গালিচার উপর দিয়ে হাঁটতাম। আহ্ কি মজা। সেই শৈশবের অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে যাই। সেই সময়ে ছিলো আমার গ্রামীণ জীবনের অগ্রহায়ণের শেষাংশের দৃশ্যাবলি। হয়তো অগ্রহায়ণের আমন ধানের ভালোবাসার লুকোচুরির ঐতিহ্য অন্যান্য স্থানে আজও ফুটে উঠে। কালের বিবর্তনে, কৃষি বীজ ও কৃষি যন্ত্রের বাহাদুরিতে, কৃষির আমুল পরিবর্তনের ন্যায় আমাদের জীবন-সমাজেও মোটা দাগের পরিবর্তন হয়েছে। সমাজ ও পারিপাশির্^কতায় ক্ষহিষ্ণুভাব প্রকোটভাবে ধরা দিয়েছে।

স¤্রাট আকবরের খাজনা আদায়ে বৈশাখ মাসকে গণনার ঘোষণার সাথে সাথে গ্রামীণ উৎসেও আস্তে আস্তে ভাটা পড়েছে। আজ যা শেষ সীমানার দারপ্রান্তে। বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘শেষ হয়েও হয় না শেষ’।

আমাদের সহজ-সরল প্রাণবন্ত জীবনধারা বাঙালি সমাজের মূল ¯্রােতে ফিরিয়ে আনার আজও চলছে নিরলস প্রচেষ্টা ও উদ্বুদ্ধকরণ। তারই ধারাবাহিকতায় চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী আয়োজন করেছে নবান্ন উৎসব। সাহিত্যের আবরণে নবান্নকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেন হারিয়ে যাওয়া জীবন সংস্কৃতি। আবহমান গ্রামবাংলার জীবনাচারণ ফুটে উঠেছে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ও তার প্রিয় স্বামী প্রফেসর একেএম জহুরুল হকের সহজ-সরল পারিবারিক কথোপকথনে। ধরা দেয়, বাংলার সরলপ্রাণ স্বামী-স্ত্রীর স্বকীয় ভালোবাসার সৌন্দর্য্য। প্রিয়তমার মমতায়ভরা একটি পাঞ্জাবি গায়ে মাখানোর অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাংলার ঐতিহ্যের পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধন। নিখুঁতভাবে ফুটে এসেছে স্বামী-স্ত্রীর অকৃত্রিম ভালোবাসা। পদ-পদবী নয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নয়। আমাদের চিরাচরিত পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে অক্ষুণœ রাখতে সর্বাপেক্ষা নিজ নিজ মনমানসিকতাই যথেষ্ট। প্রাশ্চাত্যের ভাবধারায় নিজেদের বিলিয়ে না দিয়ে নিজ নিজ সংস্কৃতি ধারণ-পালনের মাঝেই আছে আত্মার তৃপ্তি ও সর্বোত্তম সম্মান।

সরলবাক্যে বলা যায়, প্রাশ্চাত্যের জীবনবোধ আত্মমর্যাদা নয়; বরং আত্মহানি ঘটায়। আমাদের বাঙালিয়ানা, কৃষ্টিকালচার আমাদেরকেই বহন করতে হবে। এটাই হলো শেষ কথা। শেষ উপমা। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যায় আজও আমরা নেতিবাচকতায় নিমজ্জিত। সকল প্রতিবন্ধকতাকে এড়িয়ে সামনে এগুতে হবে। অপরূপ বাংলার সাজসজ্জা, নদী, পানি, গাছগাছালি, পাখির কণ্ঠে মন সুরভীত হবে তখনই, যখন আমরা নিজ থেকে নিজেদের ঐতিহ্য ধারণ করবো। অগ্রহায়ণ, হেমন্ত, নবান্ন সুতোয় সুতোয় নকশীকাঁথা। সেই নকশী কাঁথায় জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতেওÑও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি...।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়