প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
মুক্তিযুদ্ধের গল্প
পালকি ও একটি নাকফুলের কাহিনি
রেদওয়ান খান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর ॥ ৩য় পর্ব)
|আরো খবর
পালকির ঝাঁকুনিতে তার বমি-বমি, মাথাও ঘুরঘুর ঢুলঢুল-বিবাহের ধকল। এখন পুতলিকে কাছে পেয়ে মনে মনে ভেবেছে, আহারে বইনডারে অহন কে দেখবো? মায়ের কথা স্মরণে এসে আতুরিকে আরও একটু ব্যথিত করে। শাড়ির পাড়ের জরিতে ক’ ফোঁটা অশ্রু মোছার লৌকিক ছলনায় তার চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে, যেন সে এক ‘ওলাবিলি’-তবে পালকির ভেতর কেউ উঁকি মারে নাই।
হেমা মাঝি কেন আসছে না, কি হইছে-এইসব বৃত্তান্ত পালকিতে বসে শুনতেছে আতুরি। তয় পালকির দুয়ারে হাত রেখে আতুরি ভাবে, তার জামাইটা বেশরম, ক্ষেতের আইলে বইসা বিড়ি টানতেছে-লাল মোজায় চেনা যায়, শরবত খাওয়ানোর সময় একঝলক লালমোজা সে দেখেছিলো-মুখ দেখা যায় না। আতুরির নিজের পেটেও একটু চিনচিন ‘বেতা’ অনুভব হওয়ার মধ্যে সে চিন্তা করে কূল-কিনারা পায় নাই, পালকিতে চইড়া বউ-ঝি’রা হাগামুতার কি উপায় করে। অবশ্য নিজের বে-শরম চিন্তায় নিজেই সামান্য লজ্জিত না হয়ে পারে না।
তারপর, ঘুমে নেতিয়ে পড়া ছোটো বোন পুতলি’র চুলের কিলিপটি ঠিক করে দিতে দিতে আতরবানুর ইচ্ছে করেছে, পালকি থেইক্যা এট্টু বার অইতে পারলে দম ডা ফেলা যাইতো। মা গো মা! কি গরম পড়ছে!
বিবাহের নাকফুলটি-একরত্তি ‘সন্ন’-আতুরিকে এখন ভোগান্তিতে ফেলেছে। নাক চুলকাচ্ছে তার। খুব ছোটকালে, সুঁই দিয়ে ফুটা করার পর তার দাদি সুতা-চুন লাগিয়েছিলো। ছিদ্র যেন বুঁজে না যায়, এইজন্য আতুরির মা নারিকেলের শলা পরিয়ে রেখেছিলেন। সন্নের নাকফুল সে আগে পরে নাই।
ব্যথা করছে, তাই আঙ্গুল দিয়ে সন্ননির্মিত সূক্ষ্ণ শলা-চুঙ্গি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাকফুলের ভার সহনীয় করার অমোঘ প্রচেষ্টায় মনোযোগী। ঠিক তখনই কার যেন বাঁন্ধা গাইটি ‘হা ম্বা’-ডেকে উঠে চরাচরের নিস্তব্ধতা সহসা খানখান করে দেয়। এই আকস্মিকতায় আতুরি, নাসারন্ধ্রে নিজেরই নখের গুতো খেয়ে ‘উঃ!’ করে ওঠে। তখন অন্যান্য সকলেই সচকিত হয়ে উঠে দেখে-ঘাস খাওয়া ছেড়ে একটা কালো রুগ্ন গাই উদাস নয়নে কি যেন ভাবছে। সকলেই জেনেছিলো-পশুপাখিরা সব কিছু আগেভাগে টের পায়। উদাসী গাইয়ের ‘হাম্বা’ ধ্বনির ভেতর খেয়া নৌকার জন্য অপেক্ষমান অধীর, পালকি অনুগামী যাত্রীরা আসন্ন বিপদের সংকেত মনে মনে টের পেয়ে নিজ নিজ বিধাতাকে স্মরণ করেছিলো। নিরাকার বিধাতার স্বরূপ কল্পনায়, কখনও বা শিউরে উঠেছিলো। শরীরের রোমকূপ ফুলে উঠেছিলো।
অনেক দূরে, চরমেশার চরের বাঁকে একটা গুনটানা বজরা দেখতে পেয়ে শুক্কুর গাছি বলে, ‘ও অহিদ ভাই, অহন কি করা বলেন ত, হেমা ত আইতাছে না।’
‘কি করমু আমরা কন, শুক্কুর ভাই! গাঙখান ত কম বড় না, যে সাঁতরাইয়া পার হমু। লগে আছে বউ-‘নববধূ!’-কথাটি এমনভাবে বলে অহিদুল বাছাড় যেন তার অর্থ হয়-এই জন্মে বাছাড়িগিরিটাই ছাইড়া দিমু।
আভাস পাওয়া বজরাটিও বহুদূরে। যারা প্রায় ন্যাংটা হইয়া, জীবনের সমস্ত ধ্যান একত্রিত করে গুণ টানতেছে, তাদের অবয়ব শুক্কুরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গোচর, কিন্তু এইমাত্র বজরাটি নদীর অন্য গতিপথে মোড় নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে গলুই ঘুরিয়ে দিল। ফলে শুক্কুরের হতাশা এক্ষণে বিরক্তিতে পরিণত। ‘ধূরও-গণ্ডগোলের মইধ্যে বালের বিয়া শাদি’-মনে মনে বিড় বিড় করে সে।
কয়েকটি বড়ো খয়েরি-কালো মাছি ভোঁ কইরা শুক্কুরের কানে বাজনা তুইলা বটের ঝুরি-জটে মিলিয়ে গেলে, সে ভাবে, মিলিটারিরা যারে পাইতেছে তারেই মাইরা ফালাইতেছে, লগে আছে মরার পালকি, নয়াবউ।
এতক্ষণেও হেমা মাঝির টিকিটির আভাস না পেয়ে বৈবাহিক স্বপ্নচারিতা বিঘ্নিত-ক্ষুণ্ন হওয়ায়, রফিক জামাই, বিড়ির গোড়ায় শেষতম সুকটান মেরে ভেবেছে, মুজা পাগলার কথাই সইত্য অইবো। তিলক্ষেতেই রাইত কাটবো আইজ । বাড়িতে তার মা-জননী কাঁসার কলসী ভইরা গাইয়ের দুধ নিয়া হয়তো বইসা আছেন, পালকি থেকে নামিয়ে নয়া বউয়ের পা ধোয়ানোর জন্য-একথা মনে করে রফিক অস্থির। (চলবে)
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]