প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
আধাঘণ্টা হাঁটার পর আমরা চারজনেই বুঝতে পারলাম আমরা পথ ভুল করে ফেলেছি। বনের একেবারে গভীরে চলে এসেছি। তড়িঘড়ি করে রফিক জীপে এসে ঢুকলো কিন্তু এই ঘন বনে নেটওয়ার্ক পেলো না। অতঃপর সবাই নিজেদের মোবাইলেও চেষ্টা করলাম কিন্তু একই অবস্থা নেটওয়ার্ক নেই।
মন খারাপ হয়ে গেলো। ঠিক কোন্ দিকে চলে এসেছি বুঝতে পারলাম না। কোন্টা পূর্ব-পশ্চিশ সেটা বোঝাই যায় না। চারদিকে খুব ঘন গাছপালা। বিরাট উঁচু উঁচু শালগাছ। সূর্যও দেখা যায় না!
এখন বেলা এগারোটা। তবুও চারদিকে আবছা আবছা অন্ধকার। যেনো গোধূলি লগ্ন। সাকিব বললো, ওই যে পাহাড়টা ওটায় উঠলে আমরা রাস্তা খুঁজে পেতাম। অতঃপর আমরা কিছুক্ষণ হেঁটে পাহাড়টার কাছে এলাম। মহিম পাহাড়টা দেখেই বললো, ওই পাহাড়টায় উঠা কঠিন হবে। আমরা অন্য একটা ছোট বা সহজেই উঠা যায় এমন পাহাড় খুঁজলে ভালো হয়। অতঃপর সবাই মিলে পাহাড় খুঁজতে গিয়ে আরেকটা ভুল করে ফেললাম। আরো গভীর-প্রসস্ত বনে ঢুকে গেলাম।
বনের ভেতরে এসে পাহাড় পেলাম ঠিকই। কিন্তু এ পাহাড়গুলোতে উঠা আরো কঠিন হবে বলে কোনোটাই নির্বাচন করতে পারলাম না। বেশি বাছাই করতে গিয়ে ধরা গেলাম। পাহাড় একটার চেয়ে একটা ভেজা বেশি। খুব খাড়া। তাছাড়া আমরা ততোক্ষণে খুব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়োর কারণে বাসা থেকে আমরা দুজনেরই নাস্তা করে যাইনি। পাঁচ ঘণ্টা বাসের জার্নি করেছি। মাঝখানে শুধু একটা কেক খেয়েছি।
আমি হুট করেই রেগে গেলাম। বললাম, এখন থেকে আমি যা বলবো, তাই সবাই শুনতে হবে। কেউই দ্বিমত করার সাহস পেলো না। কেননা এর আগে যতোবার দ্বিমত করেছিলো ততোবারের তারা ভুল ছিলো। সময়ের সাথে তারা বুঝতে পারছিলো, আমার সিধান্তই সব সময়ে সঠিক ছিলো। তাদের জন্যেই এই বনে হারিয়েছি। পথ ভুল করেছি। তাই বাধ্য হয়েই সবাই আমার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করলো। কিন্তু এ প্রথম আমি ভুল সিধান্ত নিয়েছিলাম। তারা দ্বিমত না করার কারণেই আমাদের জন্যে আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করছিলো। আমি স্বৈরশাসকের মতো সকল সিধান্ত বাস্তবায়ন করতে লাগলাম। পেছনে ফিরে আসলাম না। আরো সামনে অচেনা পথের দিকেই অগ্রসর হতে লাগলাম। আমার দুটো যুক্তি ছিলো। এক, এই পুরো এরিয়াটা ছয় কিলোমিটারের বেশি নয়, আমরা একদিকে সরল পথে হাঁটা শুরু করলে অচিরেই পথ পেয়ে যাবো। দুই, ওই যে একটা ট্রাক চলাচলের রাস্তা, সেটা ধরে হাঁটলেই আমরা নিশ্চিত পথ পেয়ে যাবো। এই ঘন বন থেকে মুক্তি পাবো। প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে মাটি নরম ছিলো। তাই ট্রাকের চাকা মাটিতে ছয় ইঞ্চি ঢুকে গিয়েছিলো। প্রকৃতপক্ষে ওই রাস্তাটা ছিলো বনদস্যুদের কাঠ পাচারের চোরাই রাস্তা। যেই রাস্তাটা দিয়ে গেলে আমরা পথে আসতে পারবো ভেবেছিলাম। পরে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম এই রাস্তা আমাদের বনের আরো গভীরে নিয়ে এসেছে।
এখন ঘড়িতে একটা। প্রায় তিন ঘণ্টা পায়ে হাঁটার পর আমরা দুর্বল হয়ে গেলাম। পেটের জ্বালায় আমাদের মাথা ঘুরছে। যেনো আমরা শীতের মরা পাতা। যে কোনো মুহূর্তেই ধূলোয় পড়ে যাবো। বনের পথে থেকে নেয়া ছোট ছোট কাঁচা আনারস ও অজানা গোল গোল ফল খেলাম। শালবনে এগুলো পেয়ে আমরা সত্যই অবাক হয়েছিলাম।
পথে অবশ্য শুয়োর দেখলাম। খুব ময়লা দুর্গন্ধ স্থানে শুয়ে আছে। একেবারে কাদা মাটিতে। অথচ কাদা মাটি বোঝা যায় না। বোঝা যায় মিশ্র ময়লা পদার্থ।
একটু খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার আমরা সামনের দিকেই হাঁটা শুরু করলাম। একটু সামনে যেতেই হিংস্র পশুর নির্দশন দেখতে পেলাম। তড়িঘড়ি সবাই শপথ করলাম, জীবন থাকতে কেউ কাউকে রেখে দৌড়ে পালাবো না। যতো বড় দানবই হোক প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করবো। আমরা ভালো করেই জানি, একতাই বল। যদিও আমার কমান্ড তারা মানতে কষ্ট হচ্ছে। কেননা এতোক্ষণে তারা অনুধাবন করতে পেরেছিলো আমার রেগে গিয়ে সিধান্ত নেয়াটাও ভুল ছিলো। সাকিব একবার বললো, আমরা পেছনেই ফিরে যাই। বাকি দুইজন আমার মুখের দিকে চেয়েছিলো। আমি সোজা বললাম, পেছনে ফেরা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বিকেল চারটা। আমার নিজেরই পথ চলার শক্তি নেই। এখনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না! আরো অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। বনের চারদিক থেকে কেমন জানি অজানা শব্দ, অজানা পশুর সুর ভেসে আসছে কানে। মহিম শিয়াল ভেবে ভয় পাচ্ছিলো। ওরা মানুষের প্রতি আজন্ম আক্রমণ করে! অবশ্য আমার নিজেরও ভয় হচ্ছিলো। পা কাঁপছিলো। কিন্তু তাদের বুঝতে দিইনি। সবাইকে সাহস দিতে দিতে এগিয়ে চললাম।
আমি ভালো করে জানি, ভয় মানুষের মস্তিষ্ককে অকোজো করে দেয়। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এগিয়ে চললাম। একটু পরেই গাছপালা কমে গেলো। আকাশ পরিষ্কার। এতোক্ষণ পর আমরা সূর্য দেখতে পেলাম। কিন্তু জায়গাটা জঙ্গলায় ভরা। সাপ, জোঁক থাকতে পারে তা দেখেই বোঝা চায়।
দূরে পাহাড়ের উপরে কিছু সবজির চাষ হয়েছে বোঝা যায়। আখ খেতও চোখে পড়লো। একটু সাহস বাড়লো। মনে হচ্ছে পথ পেয়ে গেছি। পথ জয়ের আনন্দটা ছিলো মাত্র কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ করেই গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। এই ঘন বনে গুলির আওয়াজ। আমি অবাক হয়ে গেলাম। সাকিব বললো, আমরা হয়তো ভারত সীমান্তে চলে এসেছি। বড় ভাইয়ের কাছে শুনেছি এখানে বর্ডার আছে। রফিক বললো, সর্বনাম। ইন্ডিয়ার আর্মিরা খুবই খারাপ। ওরা কাঁটা তারের কাছাকাছি মানুষকে দেখেলেই গুলি করে!
এইবার মহিম বললো, আমাদের এগিয়ে যাওয়া আর ঠিক হবে না। আমি ভেবেছিলাম, এটা ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া হবে। আমি দালানের পেছনে সাইডটা দূর থেকেই দেখেছিলাম। যেখানে সেনাবাহিনীদের ট্রেনিং দেয়া হয়। কিন্তু সর্বশেষ সিধান্তটা আমার ভুল ছিলো। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো। তাই সাহস করে আর তাদের জোর দিয়ে কিছু বলিনি। আমিও বাধ্য হয়েই ধরে নিয়েছি আমরা ইন্ডিয়ার বর্ডারে চলে এসেছি।
এইবার একসাথে অনেকগুলো গুলির শব্দ হলো। আমরা চারজনেই ভয়ে আর সামনে এগুইনি। বরং অন্যদিকে ভোঁ দৌড় দিয়েছি।
আমি সবার পেছনে ছিলাম। ওরা একটা লম্বা বন্যদস্যুকে হারিয়ে যাওয়ার কথা বলে দিলো। ওরা ভেবেছিলো, লোকটা সেনাবাহিনীর সদস্য হবে। কিন্তু পরে জানতে পারলাম, লোকটি ডাকাত ছিলো। সে আমাদের একটা ভয়ানক রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলো। সেই পথটা আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে আনুমানিক দেড়শত মিটার নিচের দিকে। অর্থাৎ আমরা অনেক উঁচু পথ দিয়ে এতোক্ষণ হাঁটছিলাম! আমরা একটু হাঁটতেই রাস্তাটা অনেক ভয়ানক মনে হচ্ছিলো। আগের মতো রাস্তটা অন্ধকার আর ঘন গাছপালায় ভরা। সেখানের দুটো ছবি তুললাম। অতঃপর ভয়ে আবার উপরে উঠে এলাম।
আবার অন্যপথে হাঁটা শুরু করলাম। একটু হাঁটতেই এইবার দূরে দুইজন পথচারী দেখতে পেলাম। আমি ওদের বললাম, ওদের কাছে জিজ্ঞেস করি। তারা ভয়ে বললো, না, না। একটু আগে একবার বিপদে পড়ছি। তাছাড়া তোর কথা আবার শুনলে আরো বড় বিপদে পড়বো। আমি ওদের কথা শুনলাম না। আমি ওদের রেখেই সেই দুই ভাইয়ের কাছে যেতে লাগলাম। আমার মন বারবার বলছিলো ওরা ভদ্র। আমি আজন্মই আমার মনের কথা শুনি। তাছাড়া আমি সাইকোলজি পড়েছি। গবেষণা করেছি। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। চোখ দেখেই আমি মানুষ চিনতে পারি। তাদের একজনের হাতে হিন্দুদের চিহ্ন ছিলো। তাই ভরসা পেলাম। সব বললাম, তিনি বললেন, তোমরা সেই লোকের কথা মতো অঁই পথে যাওনি ভালো করেছো। অঁই রাস্তায় ডাকাতদের আস্তানা। আসো আমাদের সাথে। তোমাদের পথ দেখিয়ে দিবো। তাছাড়া আমরা অঁই দিকেই গরুর বাজারের দিকেই যাচ্ছি। বন্ধুরা আসতে চায়নি। হিন্দু ভাইটায় বন্ধুদের ভাব দেখে বললো, বিশ্বাসে স্বর্গবাসম আর অবিশ্বাসে নরকবাস। মুসলমান ভাই বললো, তোমরা কি জানো না বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া ভালো। বিশ্বাস করতে পারো। দিনশেষে আমরা সবাই মানুষ। দেখো না, আমরা দুজন হিন্দু-মুসলমান হয়েও আমরা একসাথে চলছি। কথাগুলো শুনে বন্ধুরা বাধ্য হয়েই পেছনে পেছনে আসছিলো।
অতঃপর দেখলাম, আমরা যেই জায়গা থেকে ভয়ে দৌড় দিয়েছিলাম সেখানেই ভাইয়েরা নিয়ে এসেছে! আরো দুই মিনিট হাঁটতেই দেখলাম এটাই কুমিল্লা ক্যান্টানমেন্টের মূল জায়গা। যেখানে সেনাবাহিনীদের গুলির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়! আমরা আইডিয়াটা ঠিক ভেবে মনে মনে ভালো লেগেছিলো। অনেক দূর থেকে তারা শুয়ে শুয়ে একটা বৃত্তকে গুলি করছিলো। প্রতি এক মিনিট পর পরই এক একজন গুলি করছে। আর আমরা সেটার ভয়েই তখন উল্টো দিকে দৌড় দিয়েছিলাম।
আমার কৌতূহল বেড়ে গেলো। মহিমকে বললাম, তাদের কিছু ছবি উঠাতে। একটা ছবি ক্লিক করতেই
একজন সেনাবাহিনী হুংকার দিয়ে উঠলো। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। আমি মহিমকে ছবি তোলার জন্যে ইশারা দিয়েছিলাম, তাদের একজন এটা দেখেছে। সেনাবাহিনীর একজন অফিসার আমাকে ঢেকে নিলো। দুই তিনজন ওদেন ঘিরে ধরলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় থেকে এসেছো তোমরা? আমার বুক কাঁপছিলো। ভয়ে কথা বের হচ্ছিলো না। জোর করেই বললাম, আমরা স্টুডেন্ট। ঘুরতে এসেছি। শালবন বিহারে ঘুরতে এসেছিলাম। কোটবাড়ি দিয়ে ঢুকছি। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ভুল করে গভীর বনে ঢুকে পড়েছিলাম। তারপর পথ পথ খুঁজতে খুঁজতে আপনাদের এখানে। তারা এই সত্যকথা বিশ্বাস করলো না। বন্ধুদের ডাকলো। আমাদের ব্যাগ চেক করলো। জামা-কাপড় ছাড়া কিছুই পেলো না। তবুও আমাদের মোবাইলের তথ্য অনুসন্ধান করলো! তাদের ছবি দেখে, ধমক দিলো। বললো, এগুলো কেনো তুলেছি। বললাম, প্রথমবার আপনাদের প্রশিক্ষণ কাজ থেকে দেখলাম। তাই ভালো লাগার কারণে তুলেছিলাম। বললেন, কেটে দাও। তাদের এরিয়ার সবগুলো ছবিই কেটে দিলাম বাধ্য হয়ে। ভাইদের বললেন, এদের পথ দেখিয়ে দিও। তারপর বললেন, তোমরা সোজা চলে যাও। সাবধান পেছনে তাকাবে না।
অতঃপর সেখান থেকে ত্রিশ টাকা ভাড়া দিয়ে বিশ্বরোড আসতে হয়েছিলো। রফিক বললো, চিন্তা করছিস্ না আমরা পনেরো কিলোমিটারের কাছাকাছি হেঁটেছি! আমরা অ্যাডবেঞ্চার হয়ে গেছি। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। সেই কি বৃষ্টি। এক একটা ফোঁটা যেনো পাথর পড়ছিলো। সন্ধার আগে বৃষ্টি শুরু হয়ে শেষ হয়েছিলো রাত আটটা! বন্ধুরা বাসে বসে বসে শুধুই ভাবছিলো, এখন যদি আমরা বনেই থাকতাম। যদি ওই ভাইদের না পেতাম তাহলে আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম না। আমি বললাম, রাখে আল্লাহ মারে কে? তাছাড়া অচেনা পথে হারিয়েছি বলেই তো পথ চেনার আনন্দটা চির স্মরণীয় হয়েই থাকলো।