প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর ॥ ৫ম পর্ব)
প্রথম টেলিভিশন ও অনুভূতি
আমরা আদালতপাড়ার খান মঞ্জিলে প্রথম থেকেই থাকতাম। তখন আমাদের নিচতালায় সুনীল নামে এক যুবক ছিলো। মাঝে মাঝে তার বাবা এসে থাকতো। পরে শুনেছি এটি তার পালিত পুত্র ছিলো। তার বন্ধু ছিলো প্রফেসরপাড়ার রাজু ভাই। তাকেও দেখতাম মাঝেমধ্যে। তার বাসায় টেলিভিশন দেখি মুক্তিযুদ্ধের আগেই। সেখানে আমরা টেলিভিশন দেখেছি। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পেছনে মানুষ নেই, জন নেই তবুও মানুষের উপস্থিতি! তাজ্জব বিষয় মনে হতো। কোনোভাবেই মিলাতে পারতাম না বিষয়গুলো। তার ক্যাসেট প্লেয়ারে ৬০-এর দশকের ৭০-এর দশকের সুন্দর সুন্দর গান শুনতাম।
যুদ্ধের পর যখন চাঁদপুর এলাম। আমাদের বাসার সামনেই পুলিশ সেকশন। আগেই বলেছি সামনে পেছনে বড় মাঠ। পেছনের মাঠে একট বিশাল বটগাছ ছিলো। তার পেছনে খালি মাঠে বড় পর্দায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কর্মকা-ের ডকুমেন্টারি দেখাতো। প্রথমদিকে বোবা টকির মতো ছিলো। পরে শব্দযোগ হলো। আমরা দেখতে যেতাম। মনে আছে ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ ছবিটি দেখিয়েছিলো এই মাঠে।
যাই হোক, বাসায় আমাদের টেলিভিশন কিনেছিলো ১৯৮০ সালে। ন্যাশানাল টেলিভিশন। ইমপোর্ট করা খুব ভালো টেলিভিশন ছিলো। ছাদে অ্যান্টেনা ছিলো। অনেক সময় অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছবি ক্লিয়ার করতে হতো। তবে অনুষ্ঠানগুলো তখন খুব ভালো মানের, শিক্ষণীয়, পরিবারের সাথে উপভোগ করার মতো ছিলো। তখন শুধু বিটিভি ছিলো। মাসিক নাটক, সাপ্তাহিক নাটক, সিরিয়াল নাটকগুলো দারুণ জনপ্রিয় ছিলো। গোলাম মোস্তফা, সুবর্ণা মোস্তফা, আফজাল, আসাদুজ্জামান নূর, ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার, আবুল হায়াৎ, ফাল্গুনী হামিদ, ম হামিদ, সারা যাকের, আলী যাকের, হাসান ইমাম, হুমায়ুন আহমেদ, ডলি আনোয়ার, নাজমা আনোয়ার, মমতাজউদ্দিন, রাইসুল ইসলাম আসাদ, ডলি জহুর, দিলারা জামান, মামুনুর রশীদ, শম্পা রেজা প্রমুখ। অনেকের নাম মনে আসছে না, এদের অভিনীত নাটকগুলো সত্যিই মনে রাখার মতো ছিলো। মোস্তফা নূরুল ইসলামের একটি মুক্তবাক (সম্ভবত) নামে একটি অনুষ্ঠান হতো। নিয়মিত দর্শক/শ্রোতা ছিলাম আমি।
তৎকালীন গ্রামের কৃষি
আসলে গ্রাম বলতে যা বুঝায় আমি সে পরিবেশে ছিলাম না। এ ব্যাপারে আমার ধারণা খুবই কম। তবে আমার মনে হয়, মানুষের মান্যতা ছিলো। গ্রামগুলো ফুল, ফল আর বিভিন্ন ধরনের কাঠগাছে প্রাণবন্ত ছিলো। কৃষকেরা, গৃহস্থ কৃষক ছিলো। একজন আরেকজনকে মান্য করতো। শিক্ষক, ডাক্তার বা জ্ঞানী মানুষকে সকলে মান্য করতো। বিশেষ করে শিক্ষকদের মর্যাদা খুব বেশি ছিলো। কৃষকদের ঘরে পালাপার্বণের কমতি ছিলো না ।
নারী শিক্ষা
নারী শিক্ষা ছিলো। হয়তো হার কম ছিলো। বেশির ভাগ নারীদের ভাগ্যে বেশিদিন বা উচ্চশিক্ষার জন্যে যে সময় দেয়া উচিত, তা জুটতো না। তবে গল্পের বই খুব পড়তো। যেমন আমাদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অনেক বই পড়তেন। জ্ঞানী, প্রেরণা দায়ী, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক, দৃঢ মনোবলের অধিকারী ছিলেন তিনি। অধিকাংশ অভিভাবকদের সে মানসিকতা ছিলো না। বিয়ে দেয়ার জন্যে যতোটুকু না পড়ালেই নয় ততোটুকু পড়াতো। মেয়ে অনেক পড়াশোনা করবে, চাকুরি করবে তেমনটা নয়। করলেও শিক্ষকতা। বড় কিছু হবে তেমন ভাবনা খুবই কম ছিলো অভিভাবকদের মধ্যে। ফলে মেয়েরা সাধারণত বড় স্বপ্ন দেখতে শিখতো না। বর্তমানে যা থেকে অনেকেই বের হয়ে এসেছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবেও নারীদের উন্নয়নের জন্যে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আরও হওয়া উচিত।
চিঠি টেলিগ্রাম
চিঠির প্রচলন তো প্রচুর ছিলো। সেটি শৈল্পিক পর্যায়ে ছিলো। চিঠির সুন্দর নকশা করা প্যাড (খাতা) কিনতে পাওয়া যেতো। চিঠির মধ্যে ফুলের পাপড়ি, সুগন্ধি দেয়া হতো। প্রত্যেকটি পাড়ার মুখে একটি লাল রঙের ডাক বাক্স ঝুলানো থাকতো। বিদেশে যেসব চিঠি যাবে সেগুলো সাধারণত প্রধান ডাকঘর কার্যালয়ে গিয়ে দেশভেদে টিকেট দিতে হতো, কিন্তু দেশের ভেতরের চিঠি, পঁচিশ, পরে পঞ্চাশ পয়সা, পরে এক টাকা টিকিটযুক্ত খামে করে ডাকবাক্সে ফেলে দিলেই চিঠি গন্তব্যে পৌঁছে যেতো। জায়গা এবং দূরত্বভেদে ৭/৮ দিন থেকে ১৫/২০ দিনও লেগে যেতো চিঠি পৌঁছাতে। পোস্টকার্ড ছিলো আরও কম খরচের। পোস্টকার্ড মানে খোলা চিঠি।
টেলিগ্রাম একান্ত জরুরি প্রয়োজনে খবর পাঠাতো দূর-দুরান্তে। অতি অল্প সময়ে খবর পৌঁছে যেতো প্রাপকের কাছে। সাধারণত একেবারেই জরুরি মুহূর্তে টেলিগ্রাম ব্যবহার হতো। কারণ টাকার ব্যবহার ছিলো, ‘আয় বুঝে ব্যয়’। যেমন : Mother /father serious. Come sharp. এই ধরনের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হতো।
সামাজিক সমস্যা
আসলে সবকালেই সব ধরনের সমাজের মধ্যে কিছু সামাজিক সমস্যা একেকভাবে বিরাজ করে। তৎকালীন যেমন অনেক সামাজিক সমস্যা ছিলো আজও অনেক ধরনের সমস্যা আছে। তখন যাতায়াতব্যবস্থা খুব অপ্রতুল ছিলো। সেই সময়ে প্রতিষ্ঠানিকভাবে নারী শিক্ষার অভাব ছিলো, ফলে চাকুরির ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান ছিলো অনেক কম। বাল্যবিবাহ ছিলো প্রচুর পরিমাণে। যাদের কপাল ভালো তাদের স্বামীরা পড়ার সুযোগ দিয়েছেন। সেসব নারীরা অবশ্যই সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন খুব ভালোভাবে।
ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন হতো অনেক বেশি। নারীরা নিরবে নির্যাতন সহ্য করতেন। যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলো না তাছাড়া সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকেই অনেক কিছু সহ্য করতেন। মিডিয়া ছিলো অপ্রতুল।
আমাদের সেই সময়ে সমাজে মদের প্রচলন ছিলো না বললেই চলে, খুব সীমিত পর্যায়ে ছিলো। এক খুব উচ্চ পর্যায়ে আর ছিলো একদম নিচের পর্যায়ে।
সিগারেটের ব্যবহার ভালোই ছিলো। কিন্তু এখন যে ধরনের নেশার কথা শোনা যায়, মোটেও তা ছিলো না। মদ একমাত্র সিনেমাতেই দেখতাম।
তখন ইভটিজিংও ছিলো, কিন্তু সহনীয় পর্যায়ে। প্রেমপত্র, রাস্তায় দাঁড়িয়ে বড় জোর গানের লাইন, কবিতার লাইন বলা, খুব পাজি হলে শিষ দেয়া বা বইয়ের মধ্যে চিঠি দেয়া।
সহিংসতার পর্যায়ে একেবারেই ছিলো না। তখনতো মানুষ দেবদাস, মেমসাহেব, বিরাজ বৌ, শেষের কবিতা, আনন্দ মঠ ইত্যাদি বই পড়তো। ফলে তার মানুষিক মন সেভাবেই গড়ে উঠতো।
তৃপ্তি সাহা : লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা