প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর ॥ ৪র্থ পর্ব)
শৈশব-কৈশোরের খাবার-দাবার
আমাদের সময় বাইরের খাবার বলতে মিষ্টি, ফল, আইসক্রিম, চকলেট, বিস্কুট ইত্যাদি। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ঘরে খাওয়া দাওয়া মায়ের, ভাবীর অথবা আপনজনের হাতের রান্না খাওয়া হতো। হোটেল ছিলো। ওয়ান মিনিট, সুইট হোম, তৃপ্তি হোটেল, তাজমহল বোডিং, গাজী বোডিং এগুলোর কথা মনে পড়ে খুব। বাইরের থেকে যারা আসেন অথবা অফিস-আদালতের জন্যে হোটেলগুলোর ব্যবহার ছিলো বেশি।
নিত্যবাজারের খরচ
যার যার অবস্থা অনুযায়ী টাকা নিতো বাজারে। তবে ‘আয় বুঝে ব্যয়’ এটিই ছিলো প্রতিপাদ্য। বরং যাদের হাতে টাকা ছিলো তাদের দেখে বুঝায় যেতোনা তাদের অনেক আছে। তারা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে দান ধ্যান করতেন। প্রচারণাবিহীন। ৫০-৬০ টাকা নিলেই অনেকটা পরিমাণে বাজার করা যেতো। মাছ পাওয়া যেতো অনেক। কারণ নদীনালা, খাল-বিল, পুকুরের কমতি নেই মোটেও। বরফের কমতি এবং যাতায়াতব্যবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না। ফলে অনেক কম টাকা নিয়ে বাজার সদাই করা যেতো। দেশি শাক/সবজি পাওয়া যেতো প্রচুর পরিমাণে।
ইলিশ
ইলিশ পাওয়া যেতো ভালো। অবশ্যই গোয়ালন্দ, চাঁদপুর এসব জায়গায় বেশি পাওয়া যেতো। তবে চাঁদপুরের ইলিশ অবশ্যই পৃথিবীজোড়া সুস্বাদু মাছ ছিলো। তখন যোগাযোগব্যবস্থা নাজুক ছিলো। তাই আমরা অনেক বড় বড় ইলিশ খেয়েছি। কারণ রপ্তানির সুযোগ ছিলো না। যখন ঝাঁকে মাছ আসতো, তখন ১০ টাকা করে বড় সাইজের ইলিশ পাওয়া যেতো। দারুণ স্বাদের মাছ ছিলো। কিন্তু বরফের অভাবে ইলিশের ঝুড়িও খেতে হয়েছে অনেক। ঝুড়ি মানে পঁচা ইলিশ। তখন রান্নার ভ্যারাইটি অনেক ছিলো। অনেক নারিকেল, গরুর দুধ পাওয়া যেতো।
সকালের জল-খাবার বা নাস্তা
তখন আমরা পরোটা খেতাম, লুচি খেতাম কিন্তু সেগুলো প্রতিদিন নয়। মাঝে মাঝে, উৎসব-অনুষ্ঠানে। তা অবশ্যই বাসাতে। মায়ের হাতে তৈরি। লুচি পরোটার সাথে বেগুন ভাজি, আলুর দম, বুটের ডালনা, সুজির হালুয়া, পায়েস ইত্যাদি দারুণ সব খাবার। কিন্তু সাধারণত মুড়ি, চিড়া, খৈ খুব চলতো। সাথে নারিকেল, কলা, দুধ, দই, ক্ষির অথবা পায়েশ। রাব গুড় বা ঝোলা গুড় দিয়ে মচমচে মুড়ি খুব স্বাদ। ঘি, চিনি আর টাটকা মুড়ি মেখে খেতে অনেক মজা। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, লবণ দিয়ে মুড়ি খেতেও খুব মজা। ভাত চলতো দু-এক সময়। পান্তা ভাতও মাঝে মধ্যে চলতো।
চাঁদপুরের মুড়ি নামকরা ছিলো। ঘিগজ ধানের মুডির খুব নাম-ডাক। সংগীত গুরু ওয়াহিদুল হক প্রশিক্ষণ উপলক্ষে বা কোনো অনুষ্ঠানে এলেই চাঁদপুর থেকে মুড়ি নিতেন। মুড়ি কিন্তু রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় ছিলো। তবে রুটিটা যুদ্ধের পরে চালু হলেও আমাদের বাসায় হঠাৎ করে চালু হয়নি। যুদ্ধের পরে রেশন দেয়া হতো অনেক কিছু। গমের কথা মনে আছে খুব।
তৎকালে সাধারণ মানুষ বছরে ক’বার জামা-কাপড়
সাধারণত বছরে দুবার জামা-কাপড় কেনা হতো। সে যে কি আনন্দ ছিলো। উৎসব উপলক্ষে জামা-কাপড় কিনতাম। আমাদের জামা-কাপড়, সেটি আগে অন্য কাউকে দেখাতাম না। লুকিয়ে রাখতাম। উৎসবের দিন পরতাম। আজ সেসব মনে পড়লে হাস্যকর মনে হয়।
বেড়ানো
গ্রীষ্মের ছুটিতে। আম কাঁঠালের দিনে। তখন লম্বা ছুটি পড়তো বা অন্য কোনো উৎসব উপলক্ষে বেড়াতে যেতাম।
ঢাকায় যাতায়াত
ঢাকায় যাওয়ার জন্যে আমি বেঙ্গল ওয়াটার দেখেছি। ১৯৬৬ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত চালু ছিলো। ঠিক মনে নেই, তবে ধারণা করি ১৫ থেকে ২৫ টাকা ভাড়া হবে। অবশ্যই ১ম শ্রেণির। তারপর হেনা এক্সপ্রেস ছিলো। খুব ভোরে সম্ভবত সকাল ৫টায় বা ৪টা ৪৫ মিনিটে চাঁদপুর থেকে ছেড়ে যেতো।
পত্র-পত্রিকা
দৈনিক বাংলা, চিত্রালী, বিচিত্রা আর বেগম পত্রিকার কথা খুব মনে পড়ে। চিত্রালী আমাদের সবার খুব প্রিয় ছিলো। বেগম পত্রিকা মেয়েদের পত্রিকা ছিলো। পাক্ষিক বা মাসিক। আমাদের পিশি বেগম পত্রিকা পড়তেন। তাঁর খুব প্রিয় পত্রিকা ছিলো। দেহলভী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। আর চিত্রালীর প্রিয় নায়ক-নায়িকাদের ছবি কেটে খাতায় আঠা দিয়ে খুব করে লাগিয়ে রাখতাম আমরা। সবার ভিন্ন ভিন্ন খাতার অ্যালব্যাম তৈরি করতাম। বাসায় রাশিয়ান বই-ম্যাগাজিন দেখতাম। স্পুটনিক নামে একটি ম্যাগাজিন দেখতাম।
বিদ্যুৎ ও রেডিও
আমরা চাঁদপুর এসেই বিদ্যুৎ পেয়েছি। সাপ্লাই পানি পেয়েছি। রেডিও তো অনেক আগে থেকেই ছিলো। যুদ্ধের সময় রেডিও ছিলো আমাদের অন্যতম সঙ্গী। পরে টেপরেকর্ড ছিলো। ফিতার ক্যাসেটে গান শুনতাম।
তৃপ্তি সাহা : লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা,
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা