বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪  |   ৩২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুরে রাজনৈতিক মামলায় আসামীদের আটক অভিযান অব্যাহত। যুবলীগ, কৃষকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৫ নেতা-কর্মী আটক
  •   ছেঁড়া তারে প্রাণ গেল যুবকের
  •   চাঁদপুরে গণঅধিকার পরিষদের ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন
  •   রাজধানীতে কচুয়ার কৃতী সন্তানদের সংবর্ধনা
  •   সম্প্রীতির চমৎকার নিদর্শন আমাদের বাংলাদেশ --------------জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

ছোট মামার বাঘ শিকার

সাইফুল ইসলাম জুয়েল

ছোট মামার বাঘ শিকার
অনলাইন ডেস্ক

ছোট মামার ভয়ে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খায়। এমনকি, মামা যদি বলেন তো তারা এক ঘাটে বসে শীতের মধ্যে ফ্রিজের ঠাণ্ডা 3জুস পান করতেও দ্বিধা করবে না।

আমাদের ছোট মামা নিয়মিত বাঘের লেজ দিয়ে কান পরিষ্কার করে থাকেন। তিনি যদি চান তো, বাঘের দুধ, বাঘের চোখ সংগ্রহ করতে তার দুই মিনিটের বেশি লাগবে না।

এগুলো আমার মনগড়া কথা নয়। আমাদের ছোট মামা সত্যিই কেউকেটা কেউ নন, তোমরা যদি তার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে থাকো তো ছোট মামাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েই দেখো না!

প্রথম প্রথম আমরা মনে করতাম, মামা যা বলেন তার সবই বুঝি বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো, মানে বাইরে আড়ম্বর, ভেতরে শূন্য! তবে, মামা যে কি ‘জিনিস’ সেটা অবশ্য পরে ঠিকই টের পেয়েছি।

সেবার আমরা কাজিনরা মিলে যখন সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান আঁটছিলাম, মামা তখন মনে মনে আমাদের সাথে যাওয়ার প্রস্তুতি সেরে ফেলেছেন। এমনকি, এতগুলো পিচ্চি-কাচ্চির অভিভাবক হিসেবে তার গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের বাপ-চাচাদের কানও ভারি করে ফেলেছেন।

আমরা তখনও অবশ্য মামার এই কূটচাল সম্পর্কে কিছু জানতাম না। একদিন বাবা এসে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘ছোটদের একা একা কোনো ট্যুর নয়!’

‘ছোট মানলাম। কিন্তু আমরা কেউ তো একা যাচ্ছি না। দশজন পিচ্চি যাচ্ছি।’

‘এগারোজন না-হলে কি টিম হয়?’

‘এগারো নম্বর সদস্যটি এখনো পৃথিবীর মুখ দেখেনি। মা-খালাদের কাছে শুনেছি-তার আসতে আরও তিন মাস লেগে যাবে। ততোদিন কি অপেক্ষা করা যায়!’

‘চিন্তা করিস্ না, বয়সে ধাড়ী হলেও কাজে-কর্মে তোদের মতোই একজনকে তোদের সাথে পাঠাচ্ছি। এই যাত্রায় টিমটাও তাহলে ব্যালান্স হবে।’

এই ‘এগারো নম্বর পিচ্চি’টা কে-তা নিয়ে আমাদের মনের মধ্যে রাজ্যের কৌতূহল। কিন্তু বড়রা তার ব্যাপারে এেনা মুখে কুলুপ এঁটে রইলো!

যাত্রার দিন ছোট মামাকে দেখলাম বাঘের আড়ি দিয়ে আমাদের সঙ্গ নিয়েছেন!

‘ছোট মামা কেনো?’

‘এই ট্যুরে আমরা কেবল ছোট্টরাই যেতে চাই। মামা তো আর ছোট্টটি নন।’

‘ট্যুর ক্যানসেল।’

আমাদের এসব কথার প্রত্যুত্তরে বড়রা বললেন, ‘ওর আবদার ছোটদের চেয়েও বেশি। যাক না বেচারা। তোদের টিমটাও ঠিকঠাক হলো তাহলে...।’

আমার কেনো জানি মামার ওপর খুব করুণা হলো। আহারা বেচারা! কতো কিছুই না পারে। কিন্তু সুযোগটাই আসে না। কী হবে এতো এতো কর্মক্ষমতা নিয়ে বেঁচে থাকার, যদি সেসবে কোনো ফলই না আসে!

স্টিমার ছাড়ার আগ পর্যন্ত মামা কোনো টুঁ-শব্দটি করেননি। কিন্তু যেই না আমাদের মূল যাত্রা শুরু হলো, অর্থাৎ মামা যখন নিশ্চিত হলেন-এখন আর কেউ তাকে ফেলে যেতে পারবে না, স্টিমার ঘাট ছেড়ে বহুদূরে এসে পড়েছে, তখনই তার অন্য রূপ দেখলাম। একেবারে স্বমহিমায় আবির্ভূত হলেন তিনি। তার হুকুমের বাইরে কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবো না, তিনিই এখন আমাদের এই টিমের প্রধান-এমন কথা বলে বলে আমাদের সবার কান গরম করে তুললেন।

তারপর স্বগর্বে ঘোষণ দিলেন, এবার সুন্দরবন গিয়ে তিনি বাঘ শিকার করেই ছাড়বেন!

আমাদের ট্যুর সম্পর্কে মামা তখনও পুরোটা জানতেন না। আমরা একেবারে সুন্দরবনের ভেতরদিকে অর্থাৎ সর্বশেষ মানব বসতিতে গিয়ে আবাস গড়বো। ওই গ্রামের এক জুনিয়র সদস্যের সাথে আমার বন্ধুত্বের সূত্রেই এতো কিছুর আয়োজন।

একেবারে গহীন বনে ঢুকে দেখলাম, মামা জানি কেমন চুপষে গেলেন! আড় চোখে খালি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। এই বুঝি বাঘ ঘাড়ের ওপর হামলে পড়লো!

‘আমাদের ছোট মামা দক্ষ বাঘ শিকারি’-এই কথাটা ওখানে পৌঁছানোর অল্পক্ষণ বাদেই স্থানীয় লোকদের কানেও পৌঁছে গেলো। সারাদিন আমরা বাইরে ঘোরাঘুরি করলেও, মামা তাঁবুর বাইরে অব্দি বের হননি। বোধহয় বাঘ শিকারের প্রস্তুতিস্বরূপ এখন ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। বাঘের পিছু নিলে তখন তো খাওয়া-ঘুম সব মাথায় উঠবে।

পরদিন সকালে ওখানকার কয়েকজন এসে আমাদের ঘুম ভাঙালো। তারা ছোট মামার সাথে কথা বলতে চান।

‘কী ব্যাপার?’

‘লোকালয়ে মানুষ খেকো বাঘ হামলা করেছে। বড় কর্তার বাঘটাকে শিকার করতেই হবে।’

তাদের এমন কথার পরেও ছোট মামাকে তাবুর বাইরে আসতে দেখলাম না।

তাঁবুর বাইরে বসে আমরা গল্প করছিলাম। একটা বিড়ালকে দেখলাম সুন্দরি গাছের নিচে আরামে বসে আছে।

‘ছোট মামার কী হলো রে?’

‘মামা বাঘটাকে শিকার করে এখানকার লোকজনের কাছে আমাদের নাম রাখবেন তো?’

‘আমাদের ছোট মামা হলেন গিয়ে বাঘের মাসি, অর্থাৎ আরামপ্রিয় ব্যক্তি। বাঘ তিনি ঠিকই মারবেন, তবে একটু আরাম করে নিচ্ছেন-এই যা।’

হঠাৎ তাবুর ভেতর থেকে মামার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘এই, বিড়ালকে বাঘের মাসি কেনো বলা হয় রে? বিড়াল সত্যি সত্যিই বাঘের মাসি হয় নাকি?’

‘বাঘের মা ছোট বেলায় বিড়ালের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলো। জানোই তো-ছোট সময় ওরা দুজনই একরকম দেখতে ছিলো।’

‘মামা, বাঘও কিন্তু এক ধরনের বিড়াল। বাঘ হলেও জাতে তো সে আসলে বিড়ালই।’

মামা ‘হুম’ বলে চুপ হয়ে গেলো।

রাতে আমরা সবাই মিলে মামাকে চেপে ধরলাম, ‘মামা, তোমার কিন্তু এবার বাঘটাকে শিকার করতেই হবে।’

মামা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘বাঘের বদলে অন্যকিছু থাকলে বল। শিকার করি।’ তারপর হাতে তুড়ি দিয়ে বললেন, ‘সিংহ, হাতি... কী লাগবে বল, শিকার করতে মাত্র দু’মিনিট লাগবে আমার।’

আমরা অবাক। সুন্দরবনে বসে মামা সিংহ-হাতি মারতে চাইছেন! তবে, বাঘ কেন নয়?

কথাটা ছোট মামাকে বলতেই তিনি বললেন, ‘বাঘও তো এক ধরনের বিড়াল। আমি বিড়াল শিকার করি না। বাঘ শিকার করলে তখন তোরাই আবার টিপ্পনি কেটে বলবি-ছোট মামা সামান্য বিড়াল শিকার করেছে। ছিঃ!’

আমাদের কারোর মুখে কোনো রা নেই।

শেষে বললাম, ‘তাহলে ওদেরকে বলে দিই যে, তুমি বাঘটাকে শিকার করতে পারবে না। ওরা যাতে অন্য কাউকে ডাকে।’

পরদিন বনরক্ষীর পাহারায় আমরা বনের ভেতরে ঢুকলাম। ছোট মামা অবশ্য বাঘের আড়ি দিয়ে তাঁবুর ভেতরেই পড়ে রইলেন। সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখি মামা তার তাবুর ভেতরে বসেই স্থানীয় লোকগুলোর সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন। তাদের মাঝে কয়েকজন ফরেস্ট গার্ডকেও চোখে পড়লো।

ব্যাপার কী?

পরে শুনলাম, মানুষ খেকো বাঘ হামলা করেছে-এমন গুজব ছড়িয়ে কিছু চোর শিকারি বাঘ শিকার করে বেড়াচ্ছে। স্থানীয় সহজ-সরল লোকগুলো, এমনকি বনবিভাগের লোকজনও এই চক্রান্তটা ধরতে পারেনি। পেরেছেন আমাদের ছোট মামা। তারই পরামর্শে আজ ফরেস্ট ডিভিশনের গার্ডরা কয়েকজন চোরা শিকারিকে অ্যারেস্ট করেছে।

দ্বিধায় পড়ে গেলাম আমরা। মামার কাজ, সেখানে দুদিকেই শতভাগ সম্ভাবনা থাকে। হতে পারে ওরা সত্যিকারের চোরা শিকারি। কিন্তু, যদি সত্যি সত্যিই এখানে মানুষখেকো থেকে থাকে?

মামা জানালেন, ‘ফরেস্ট বিভাগের শিকারিদের দিয়ে এই এলাকার বাঘগুলোকে গুলি মারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

‘কটা মরলো?’

‘একটাও নয়। তবে, তিনটাকে গুলি মারা হয়েছে।’

‘তিনটাকে গুলি করলো, একটাও মরলো না। এ কেমন শিকারি!’

‘তাদের চেয়ে তুমিই ভালো ছিলে, মামা। অন্তত বাঘ না মরলেও বিড়াল তো মরতো।’

ছোট মামা বললেন, ‘আমি গুলি মারলে বাঘগুলো সত্যিই মরে যেতো রে। কিন্তু জানিসই তো-এখন বাঘের সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। বাঘ মারা ঠিক নয়। তাই বনবিভাগের লোকগুলোকে দিয়ে তিনটি বাঘকে গুলি মেরে ঘুম পড়ানো হয়েছে। ওদের মধ্যকার আহতগুলোকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। আর সুস্থগুলোকে লোকালয় থেকে অনেকদূরে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে।’

‘তুমি তাঁবুর ভেতরে শুয়ে-বসে এত্ত কিছু করলে?’ আমাদের চোখ ছানাবড়া।

মামা মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার কি বাঘ মারতে মাচায় উঠে বসে থাকা লাগে! আমার কথাই গুলি। কথা বললেই বাঘ মরে পড়ে থাকবে।’

মামার কথা হজম করতে কষ্ট হলেও প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারলাম না কেউ।

* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা

[email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়