শনিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৪, ০০:০০

ছায়ামূর্তি ও রবীন্দ্রভক্ত বালক

আকিব শিকদার
ছায়ামূর্তি ও রবীন্দ্রভক্ত বালক

পড়ার টেবিলে বসে আবিদ নতুন কেনা চকচকে চটি খাতাটায় কী যেন লিখছিল। হাতের কলমটার পেছনে ময়ূরের পালক লাগানো, আগেকার দিনে কবি-সাহিত্যিকদের কলমে যেমন থাকত। রাত তখন ১২টা, সাড়ে ১২টা। যত লেখে, তার চেয়ে বেশি ভাবে।

ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের রাজ্যের পরিরা আবিদের চোখের পাতা বন্ধ করে দিয়ে গেল, তা সে বুঝতে পারেনি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। টেবিলের ধবধবে সাদা খাতাটা থেকে শুরু করে নিজের গায়ের গোলাপি শার্ট, ঘন অন্ধকারে ঢাকা পড়ল সব।

এমন সময় নির্জনতা ভেঙে মানুষের পায়ের আওয়াজের মতো শোনা গেল একটা খসখস শব্দ। মনে হয়, শব্দটা দক্ষিণ দেয়ালের জানালার ভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে আসছে। ভয়ে আবিদের গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইল, ‘কে? কে ওখানে?’

একটা অদৃশ্য কণ্ঠ বলল, ‘আমি, আমি তোর অতিথি।’

আবিদ বলল, ‘আমার অতিথি! কী চান আমার কাছে? আমার ভীষণ ভয় করছে।’

অদৃশ্য কণ্ঠ অভয় দিয়ে বলল, ‘ভয় পাস নে।’

এবার ঘরের দক্ষিণ কোণে ঝাপসা আলোয় দেখা গেল অনেকটা মানুষের আবছায়ার মতো অদৃশ্য কণ্ঠের মানুষটা। আবিদ দেখতে পেল লোকটার ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, গায়ে ঢিলেঢালা জামা। ধূসররঙা চাদরে সারা শরীর ঢাকা।

আবিদ ছায়ামূর্তি দেখে আরো বেশি ভয়ে চিৎকার করতে লাগল—‘আপনার পায়ে পড়ি, আমাকে মারবেন না, ছেড়ে দিন। আমি বাঁচতে চাই, মরতে চাই না।’

ছায়ামূর্তিটা বলল, ‘কী সব বলছিস? স্থির হ...শান্ত হ...’

আবিদ বলল, ‘আপনি যা চাইবেন, তা-ই দেব। তবু আমাকে ছেড়ে দিন। আমার ক্রিকেট ব্যাট, ফুটবল, নাটাই-ঘুড়ি, আমার গল্পের বই, যা চাইবেন, তা-ই দেব। তবু আমার জীবন নিয়ে খেলা করবেন না।’

ছায়ামূর্তি বলল, ‘চুপ কর। তোর জীবন নিয়ে খেলা করলাম কই!’

আবিদ ভীত স্বরে একটানা বলেই যাচ্ছে—‘আমার টুপি, চশমা, নতুন কেনা পাম শু, সোনালি ফিতার হাতঘড়ি; কোনটা চাই আপনার? এই নিন, এই নিন। সব নিয়ে যান, তবু আমাকে মুক্তি দিন।’

ছায়ামূর্তি বলল, ‘কী সব আবোল-তাবোল বলছিস! এসব দিয়ে কী করব! আগে বল এতক্ষণ কী লিখছিলি?’

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবিদ বলল, ‘না, না, ও কিছু না। অঙ্ক করছিলাম; বীজগণিত, ইংরেজি স্যারের অনেক পড়া। লিখতে লিখতে হাত ব্যথা করে। খাতায় এসবই লিখছিলাম।’

ছায়ামূর্তি রাগত স্বরে শাসাল—‘মিথ্যা বলিস! তা-ও আবার আমার সঙ্গে! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা...’

আবিদ মাথা নিচু করে মিনমিন করল—‘না, না। আপনার সঙ্গে মিথ্যা বলব না। এখনই দেখাচ্ছি। এই দেখুন, এই দেখুন কবিতা লিখছিলাম। আমার পাঠ্য বইয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে। তাঁর কবিতা পড়লেই কেমন জানি মাথায় ভাব চলে আসে। কবি হতে ইচ্ছা করে। কবিতা লেখা কি অপরাধ? আমাকে ক্ষমা করবেন।’

ছায়ামূর্তি কৌতূহলী ভঙ্গিমায় জানতে চাইল—‘কবিতা লিখিস! লিখতে পারিস? না অন্যদের নকল করিস?’

আবিদ বলল, ‘মিথ্যা বলার অভ্যাস আমার আছে, তবে কবিতা নকল করার অভ্যাস নেই। তা ছাড়া কবিতা নকল করলে সেটা নকল হয় না। আমি রবীন্দ্রনাথের ভীষণ ভক্ত। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা, উপন্যাস একটাও বাদ দিইনি পড়া থেকে। ওই দেখুন, আমার আলমারিতে রবীন্দ্রনাথের কত্ত বই।’

ছায়ামূর্তি আলমারির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুম, দেখলাম।’

আবিদ আবার বলতে লাগল- ‘এই দেখুন, আমার কলমণ্ডখাতা, আমার লেখা কবিতা, আমার হাতে আঁকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। দেখলেই বুঝবেন আমি রবীন্দ্রনাথকে কত ভালোবাসি।’

ছায়ামূর্তি মুচকি হাসল—‘কলমের মাঝে এটা কী গুঁজে রেখেছিস?’

‘এটা ময়ূরের পালক। রবীন্দ্রনাথ পাখির পালকযুক্ত কলম দিয়ে লিখতেন। আমিও তাঁর মতো হতে চাই। এই দেখুন, আমার খাতার পাতায় পাতায় আতরের ঘ্রাণ। এটা তাঁরই অনুকরণে করেছি।’

ছায়ামূর্তি হু-হু করা শব্দে হাসল।

আবিদ বলেই চলছে- ‘এই যে দেখুন, খাতার ভেতর গোলাপ ফুলের শুকনা পাপড়ি। রবীন্দ্রনাথও নাকি এমন করতেন। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় রং ছিল নীল। নীল রংটা আমারও প্রিয়। দেখছেন না, প্রতিটা কবিতাই নীল কালিতে লেখা?’

ছায়ামূর্তি অট্টহাসি হেসে বলল, ‘বুঝলাম।’

আবিদ বলল, ‘আজকালকার লেখকরা কী সব লেখে, পড়ে স্বাদ পাই না। আমি চাই রবীন্দ্রনাথের মতো লেখক হতে, যাতে পাঠক আমার বই পড়ে আত্মহারা হয়। কিন্তু মা-বাবা আমাকে কবিতা লিখতে দেয় না। বলে, লেখাপড়া করগে। অথচ আমি চাই রবীন্দ্রনাথ হতে।’

ছায়ামূর্তি বলল, ‘লিখে যা, লিখে যা। দেখিস একদিন...’

আবিদ জানতে চাইল- ‘রবীন্দ্রনাথ হতে গেলে কী করতে হবে? তাঁর লেখা গানগুলো খুব প্রিয়। আমি কি তাঁর মতো গান লিখতে পারব?’

ছায়ামূর্তি এবার আবিদকেই প্রশ্ন করল- ‘জানিস, আমি কে?’

আবিদ ভয়ে ভয়ে বলল, ‘না, আমি জানতে চাই না।’

ছায়ামূর্তি রাগের স্বরে বলল, ‘কী, জানতে চাস না আমি কে?’

আবিদ বলল, ‘অবশ্যই জানতে চাই। আপনি নিশ্চয়ই আমার কাছের আত্মীয়। আমাকে মারবেন না। আমাকে ছেড়ে দিন।’

ছায়ামূর্তি বলল, ‘আমি রবীন্দ্রনাথের আত্মা। তুই আমার আত্মীয়ই বটে। যারা আমাকে এত বেশি ভালোবাসে, আমি তাদের আত্মীয় ছাড়া আর কী হব বল?’

আবিদ ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রবীন্দ্রনাথের আত্মা!’

ছায়ামূর্তি বলল, ‘হ্যাঁ, আমি রবীন্দ্রনাথের আত্মা। যারা আমাকে ভালোবাসে, আমাকে গুরু বলে মান্য করে, আমার পথ অনুসরণ করে, আমি তাদের কাছে এমন করেই ধরা দিই।’

আবিদ হাতের কাছে যেন চাঁদ পেল- ‘গুরু, আপনি আমার গুরু। আপনাকে চোখের সামনে পেয়ে আজ জীবন ধন্য। এই যে দেখুন, দেয়ালে আপনার ছবি টাঙিয়ে রেখেছি। আপনাকে এমন করে কাছে পাব, ভাবিনি কোনো দিন। আপনার পদধূলি মাথায় নিয়ে জ্ঞানভাণ্ডার আরো সমৃদ্ধ করতে চাই। আমাকে সুযোগ দিন গুরু।’

ছায়ামূর্তি একটু সরে গিয়ে বলল, ‘এই, কী করছিস? কী করছিস?’

আবিদ ছায়ামূর্তির দিকে একটু ঝুঁকে বলল, ‘গুরু, আপনি সরে যাবেন না। আমি যেতে দেব না। আপনার কাছ থেকে লেখালেখির কৌশলটা না শেখা পর্যন্ত আপনাকে ছুটি দেব না।’

ছায়ামূর্তি ছাদের দিকে তাকিয়ে হু-হু করে হাসছে।

আবিদ বলল, ‘গুরু, আপনি কোথায়? কোথায় আপনার পবিত্র পা? আপনার পা দুটিকে স্পর্শ করতে দিন। গুরু, ও গুরু, কোথায় আপনি?’

এমন সময় খট করে ঘরের দরজা খুলে গেল এবং আবিদের মা ঘরে প্রবেশ করলেন।

‘আবিদ! এই আবিদ! ঘরে লাইট জ্বালিয়ে টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিস? উঠ, রাত অনেক হয়েছে, এবার বিছানায় শুতে যা।’

মায়ের ডাকে আবিদের ঘুম ভাঙল। সদ্য ঘুম ভাঙা লাল লাল চোখে আবিদ দেখতে পেল টেবিলের ওপর খাতা, কলম, চশমা—সব ঠিকঠাক আছে, এমনকি খাতায় লেখা অসমাপ্ত কবিতাটাও তেমনি অসমাপ্তই আছে; কেবল ঘরের দক্ষিণ কোনায় রবীন্দ্রনাথের ছায়ামূর্তি অনুপস্থিত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়