প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
করোনা মহামারির শুরুর দিকে চাঁদপুরে জেলা প্রশাসন ‘লকডাউন’ ঘোষণা করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অনলাইনে পুরো খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। পৌঁছে যায় থানা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত। ফেসবুকে উঠে আসে ‘লকডাউন’ শব্দ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমলোচনা। কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী বিভিন্ন ধরনের ট্রল করে। অন্যদিকে গ্রামের দোকানগুলোতে চায়ের কাপে ঝড় উঠে। সাধারণ মানুষদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
একদিন পরেই খবর মিলে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ করোনার রোগী পাওয়া গেছে। সেখানে অবস্থানকারী ফরিদগঞ্জের শ্রমিকেরা আতঙ্কে গ্রামে চলে আসে। তার একদিন পরেই ফরিদগঞ্জে করোনার রোগী শনাক্ত হয়। ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন লকডাউন ঘোষণা করে। খবরটা শোনামাত্রই প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণির মানুষেরাও আতঙ্কে পড়ে যায়। গ্রামে চলে আসে ভয়, আতঙ্ক।
এর দুদিন পরেই আমি রাতে গোসল করলাম। ফলে পরের দিন আমার সর্দি লেগে যায়। আমি জানি এটা করোনাভাইরাসের কারণে হয়নি। অসময়ে গোসল করার কারণেই হয়েছে। তবুও মা ভয় পেয়ে গেলেন। ছোট ভাই ভয়ে সেই সকালে বের হয়েছে আর ঘরে ফিরেনি। মাকে বললাম, আমার কিছু হয়নি। তবুও আপনারা যখন ভয় পাচ্ছেন, তাহলে হুজুরের কাছে যান, পানি পড়া নিয়ে আসেন। খেয়ে ভালো হয়ে যাই। হুজুরকে সব বলবেন। কিন্তু কেউ যাতে না জানে। তাহলে গ্রামের মানুষ ভুল বুঝবে। ফাঁকে দিয়ে আমি মুসলমানের শ্রেষ্ঠ কাজ করে পানাহ চাইলাম আল্লাহর কাছে।
মা এতোটাই ভয়ে পেয়েছিলেন যে, বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর কাছে পরামর্শ চাইলেন। তিনিও বলছিলেন, কারো কাছে মা যেনো এ খবর না বলেন, তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে। মা আচ্ছা বলে চলে আসলেন। হুজুরও একই কথা নাকি বলেছিলেন। অথচ ঘণ্টাখানেক পরেই ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যায়! পুরো ১০নং ইউনিয়ন হয়ে যায় ইয়াছিন দেওয়ানের ‘করোনা’ হয়েছে। খবরটি জনে জনে ছড়িয়ে যায়। বাড়ির পাশের চায়ের দোকানগুলো থেকে আমার নামে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে যায়। আমার ভাইকে নাকি অনেকেই বলেছে, আমরা যাতে ঘর থেকে বের না হই। গ্রামের মেম্বার পর্যন্ত গুজব ছড়িয়েছে! আমাকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ঢাকা হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে ইত্যাদি.. ইত্যাদি...।
আমি নিজের রাগকে আর কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। সরাসরি মেম্বারকে ফোন করে সব বললাম। উল্টাপাল্টা খবর যেনো না ছড়ায়।
ইতিমধ্যে করোনার গুজবটা অনেকেই বিশ্বাস করে ফেলেছে। আমি বাধ্য হয়েই দোকানের কাছে গেলাম। কিন্তু সবাই আমার থেকে দূরে চলে গেলো। একজন বললো চতুরা (ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করে আসতে।
যখন তাদের বোঝাতে পারলাম না, আমার কিছু হয়নি। গত রাতে গোসল করেছিলাম তাই সামান্য সর্দি লেগেছে। একসময়ে বাধ্য হয়েই হাসপাতাল গেলাম। চিকিৎসক সব শুনে আমাকে ভর্ৎসনা করলেন। বললেন, আমি হাসপাতাল না এলেও পারতাম। এখানে একটু আগে করোনা রোগী এসেছে। সামান্যই সর্দি হয়েছে। আমার ধারণাই ঠিক। গোসলের জন্যেই এমনটা হয়েছে। আমি এখানে এসে শুধু শুধু বিপদ বাড়িয়েছি। তারপর কিছু ওষুধ দিলেন। বললেন, যদি রাতে হাঁচি না কমে তাহলে যেনো ফোনে যোগাযোগ করি।
বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথেই মানুষগুলো আমাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিলো। তাদের কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না, আমার কিছু হয়নি। একপর্যায়ে চিকিৎসকের স্লিপ দেখানোর পরে অধিকাংশকে বিশ্বাস করাতে পেরেছি। কিন্তু কেউ কেউ বললো, তবুও এক সপ্তাহ তুই ঘর থেকে বের হবি না। বুঝলাম, গ্রামের মানুষগুলো ভয়ে আছে। তাদের জন্যে কিছু করা দরকার।
সেদিন বিকেলেই সর্দি ভালো হয়ে গেলো। প্রতিবেশীদের ভুল ভাঙলো। একদিন পরে আমার সামাজিক প্রতিষ্ঠান ‘মধ্যবিত্ত কল্যাণ পরিষদ’ থেকে জনসচেতনতামূলক প্রচারপত্র, মাইকিংসহ, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা শুরু করে দিলাম। যাতে মানুষ ভয় না পায়। সচেতন হয়। আমি বুঝেছিলাম, সচেতনতাই আতঙ্ক দূর করতে পারে। যার ফলশ্রুতি, এখন পাশের বাড়ির কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে, বলে, ‘ও আচ্ছা...তাহলে উনিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন’। মানুষ এখন কতটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে! অথচ সেদিনও মানুষের মনে কত ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ছিলো। যা হোক, প্রত্যেকটা বাড়িতে গিয়ে মাস্ক দিলাম। এর মধ্যেই সরকার প্রথমবারের মতো সারাদেশে এক সপ্তাহ লকডাউন ঘোষণা করছে! তা শুনে দিনমজুরদের আহাজারি, আর্তনাদ, কান্না, অসহায়ত্ব ভোলার মতো না। সরকার ঘোষণা করেছে প্রত্যেকে ত্রাণ পাবে। কিন্তু সকলে তা পায়নি। গণমাধ্যমগুলোতে আমরা দেখেছি বস্তায় বস্তায় সরকারি চাল পাওয়ার তথ্য। একজন জনপ্রতিনিধির বিছানা নিচ থেকে বিপুল পরিমাণ সরকারি ত্রাণের তেল পাওয়া গেছে! এরই মধ্যে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় সরকার লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষের কান্না সহ্য করতে পারলাম না। ধার করে কিছু কিছু ত্রাণ দিয়েছি। একসময়ে উপলব্ধি করলাম, গ্রামের মানুষগুলো ভালো নেই।
আতঙ্ক এড়াতে বাড়িতে বাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করলাম। ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম থেকে ১৪০ জনকে খাদ্যসামগ্রী প্রদান করলাম। এলাকার মানবসেবায় যুব সংগঠনের থেকে ৬০ জনকে ত্রাণ দিলাম।
করোনা আরও বেড়ে গেলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীদের উপহার দিবেন, প্রণোদনা দিবেন। কিন্তু সেই প্রণোদনা এসেছে কিনা জানি না। নাকি সেই চাল চোর, তেল চোরেরারাই লুট করে নিয়ে গেছে তা-ও জানি না।
ফরিদগঞ্জে একুশজন সদস্য নিয়ে ‘বাজার বাড়ি’ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সৃষ্টি হলো। বিনা যাতায়াত খরচে কল করলেই গ্রাহকদের জরুরি ওষুধ, যে কোনো পণ্য পৌঁছে দেয়া হলো। তাতে পুরো ফরিদগঞ্জে ব্যাপক সাড়া মিলে। আমিও তাদের একজন ছিলাম। চতুর্থ দিনের মাথায় উপলব্ধি করলাম আমার ১০নং ইউনিয়নের গ্রামের মানুষেরা ভালো নেই। তারাই বেশি সমস্যায় আছে। তাদের জন্যে আলাদা ‘বাজার বাড়ির মতো’ সংগঠন দরকার। তাই ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমিও তৈরি করলাম, ১১ জন সদস্য নিয়ে ‘বাজারের ডাক’ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আমাদের স্লোগান ছিলো ‘ঘরের মানুষ ঘরে থাক, পৌঁছে যাবে বাজারের ডাক’।
তিনটি মোটরসাইকেল, পাঁচটি বাইসাইকেল দিয়ে আমরা টানা চল্লিশ দিন এ সেবা প্রদান করেছিলাম। পরবর্তীতে সরকার লকডাউন তুলে নিলে আমরা সেবা প্রদান বন্ধ করে দিই। আমাদেন গ্রাহকসংখ্যা ছিলো বারশ। অর্থাৎ আমরা ১২০০ পরিবারকে সেবা প্রদান করে করেছিলাম। আমরা তেমন স্পন্সর পাইনি। ফলে আমার পকেট থেকে টিউশনির জমানো এগারো হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
টাকাগুলো আমি জমাচ্ছিলাম লেখালেখির জন্যে কম্পিউটার কিনবো বলে। কিন্তু স্বপ্নটা আজও স্বপ্নই রয়ে গেলো। কেননা এ সেবা প্রদান করতে গিয়ে আমার টিউশনিগুলো চলে যায়। আর তারপর থেকেই গত এক দেড় বছর বেকার রয়েছি। কেননা স্কুল-কলেজ বন্ধ। তাই নতুন করে আর টিউশনি পাইনি! তবে আনন্দের খবর হলো, সেই চল্লিশ দিনে আমাদের গ্রামে করোনার রোগী শনাক্ত হয়নি বা আমাদের থেকে যারাই সেবা নিয়েছে বা আমরা যারা সেবা দিয়েছি তাদের কারোই করোনা হয়নি। এটাই আমার প্রাপ্য।
সরকার দ্বিতীয়বার লকডাউন দিলে আমার ব্যক্তিগত ‘বাজারের ডাক’ সেবা চলে। এক পর্যায়ে ১৭ দিনের মাথায় টাকার অভাবে সেবাটি চালিয়ে যেতে পারিনি। তবে দুঃখগুলোর মাঝে একটু আনন্দ লাগে। যারা আমার সমলোচনা, গুজব ছড়িযেছিলো তারাই এখন পথে দেখা হলেই বলে, ‘কিও মানবতার ফেরিওয়ালা কেমন আছো?’ আমার মনে তখন শান্তির বাতাস বয়ে চলে।