প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর ॥ ৩য় পর্ব)
ছোটবেলার খেলাধুলা
১৯৬৮ বা ১৯৬৯ সালে আমরা রাজশাহী ছেড়ে চাঁদপুরে চলে এলাম। ১৯৭০ সালে মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলাম। চারদিকে, স্কুল, কলেজের বিশাল বিশাল মাঠ।
স্বাধীনতার পর গোল্লাছুট, কেরাম বোর্ড, কাবাড়ি, বৌচি, দড়ি লাফ, কড়ি, দাবা, লুডু, বর্ষা নিক্ষেপ, গোলক নিক্ষেপ, হাইজাম্প, লংজাম্প, রিলে দৌড়, সাঁতার, বাঁশ নিত্য এসব খেলতাম। কিন্তু বাসায় মেয়েরা-বৌ জামাই, দড়িলাফ, কড়ি, লুডু, পলান্তি-পলান্তি বা লুকুচুরি লুকুচুরি খুব খুব খেলতাম। বৌ-জামাই খেলা দারুণ জমতো। শেষ হতো না সহজে। সেই বিয়ে, পোলাউ মাংস রান্না করে পুতুলের বিয়ে দিতাম। সুন্দর সুন্দর কাপড়চোপড় পরাতাম বৌ আর জামাইকে। ধুমধাম করে বিয়ে হতো, বাচ্চা হতো পুতুলের। ঘুম পাড়াতাম পুতুলদের।
সেই খেলাগুলো এখনকার অবস্থা
এখন দাবা, কেরাম, লুডু, বর্ষা নিক্ষেপ, রিলে দৌড়, গোলক নিক্ষেপ কিছু নির্দিষ্ট সময়ে শোনা যায়। অন্যান্য খেলা তেমন নেই। কারণ আশির দশক থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নেই খেলার মাঠ, নেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র গ্রন্থাগার, নেই জাতীয় সংগীত, নেই সেলাই, কৃষিকাজ, নেই অ্যাসেম্বলিতে যে শরীরচর্চা হতো, তার পাঠও চুকে গেছে বললেই চলে।
সপ্তাহে খেলাধুলার ক্লাস অর্থাৎ মাঠে এবং ক্লাসে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা হতো তারাও শিক্ষক ছিলো। কিন্তু মাঠের খেলা বন্ধ করে দিয়ে ক্লাসে খেলার বই পড়ানো হতো না, এই রকম অপচেষ্টা বাংলাদেশের শিক্ষার মান কমানোর জন্যে যথেষ্ট। যিনি খেলাধুলা করাবেন তিনিও শিক্ষক, তাঁকে কোন্ যুক্তিতে খেলাধুলা না করিয়ে বই পড়াতে হবে? পড়ার একঘেয়েমি দূর করা এবং শারীরিক ফিটনেসের জন্যে মাঠে খেলা হতো বা ইনডোর গেম হতো। কখনো শিক্ষার্থী খেলার নিয়মকানুন পড়ানো হতো না। হাতে-কলমে শিখতে গিয়ে নিয়মকানুন এমনিতেই শিখতো। গ্রন্থাগার ক্লাস, সেলাই ক্লাস হতো। রান্না, কৃষি কাজ সবই হাতে-কলমে শিক্ষা। এখন তো সবাই নিজেদের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত করতে গিয়ে বাচ্চাদের উপর বই চাপিয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম এর সাথে জড়িত, সবাই শিক্ষক।
শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত হচ্ছে, আগ্রহ হারাচ্ছে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে। পিঠে এতো বেশি বইয়ের বোঝা! আনন্দ থেকে বঞ্চিত করছি শিশুদের।
বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। কারণ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন-সোনার মানুষ, সোনার দেশ। আশা করি, ভ্রান্ত পথের অবসান হবে। সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্যে জীবনে অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে। যেটা যেভাবে প্রয়োগ করতে হবে, সেভাবেই হবে।
ওহ! তখন চাঁদপুরে বাদশা মিয়া নামে একজন সাঁতারু ছিলেন, যিনি ২ দিন ১ রাত লেকের পানিতে ছিলেন। আমরা স্কুলে যাওয়া-আসার পথে দাঁড়িয়ে দেখতাম। স্কুলে ম্যাজিক, কাগজ দিয়ে নানাবিধ জিনিস তৈরি করে দেখানো হতো। এমনকি টেলিভিশনও দেখানো হতো। আমার মনে আছে রুনা লায়লার গান দেখেছি স্কুল টেলিভিশনে। তখন শুনেছিলাম রুনা লায়লা পাকিস্তান থেকে এসেছে বলে অনেকে আপত্তি করেছিলো। রুনা লায়লা শিশু হাসপাতালে ১৭টি বেড দিয়েছিলেন।
পড়াশোনার হাতেখড়ি
মায়ের কাছে অবশ্যই। বাবা মাঝে মাঝে খোঁজখবর নিতেন। সবাইকে নিয়ে মাঝে মাঝেই বসতেন। সবাইকে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন করতেন।
প্রথম স্কুল
চাঁদপুর এসে ১৯৭০ সালেভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হই মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। শেষ করি ১৯৮০ সালে।
শিক্ষকদের শাস্তির ধরন
বেত ছিলো, নীল-ডাউন করিয়ে, বারান্দায় কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখার মতো শাস্তি দিতেন। লো-বেঞ্চেও দাঁড় করিয়ে রাখতেন। সেটি খুব লজ্জার ছিলো। তবে গায়ে হাত দিয়ে মারতেন এমনটা মনে পড়ে না।
স্কুলের পরিবেশ
অনেক অনেক ভালো ছিলো। এতো বড় একটি, কোথায়ও দুটি খেলার মাঠ। যেমন : আমাদের মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ও লেডী প্রতিমা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সামনে-পেছনে দুটো মাঠ।
খেলাধুলা, গল্পের বই পড়া, হাতে-কলমে রান্না শেখা, সেলাই শিখা, ল্যাবরেটরিতে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন প্রস্তুত, ধর্ম, গুণাবলি এগুলো আমাদের টিচাররা করিয়েছেন।
কিন্তু এখন খবর নেন, কত ধরনের সুবিধা সরকার দিচ্ছে, অথচ ল্যাবগুলোতে শিক্ষার্থীদের ঢোকার ব্যবস্থা নেই। কেউ বলছে না, যদি সন্তানের উপর খারাপ প্রভাব পড়ে। পাসতো করছেই। সার্টিফিকেট পাচ্ছে। সার্টিফিকেট শিক্ষার একমাত্র মানদণ্ড হতে পারে না।
তখনকার দিনে শিক্ষকদের মর্যাদা ছিলো অনেক বেশি। তাদের স্মার্টনেস, কথা বলার স্টাইল, শাড়ি পরার স্টাইল, চলনে-বলনে সত্যিই অনুসরণ করার মতো ছিলো। পড়ার জন্যে মারতেন, আদরও করতেন। যদিও মারাটা কোনো সমাধান নয়-এ কথা শতভাগ ঠিক।
তৃপ্তি সাহা : লাইব্রেরি উন্নয়ন কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]