প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৩, ০০:০০
আমার আবার ঘুমের সমস্যা আছে। হয়তো চোখ বুজে পড়ে আছি কিন্তু চোখে ঘুম নেই। রাতের পর রাত এমন সমস্যা আমার কাছে বিচিত্র নয়। এ এক ভারি অদ্ভুত ব্যাপার।
শোনা যায়, লেখকদের নাকি ঘুমের সমস্যা হয়। আমি কোনো লেখক-টেখক নই, সে আপনারা ভালোই জানেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেখার টেবিলে বসে কলমের পেছন দিক কামড়াতে কামড়াতে সাবাড় করে দিলেও আমার মাথায় দু-একটা লাইন কখনও আসে না।
টানা তিন দিন নির্ঘুম অবস্থায় কাটানোর পর আজ রাতে চোখে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। কী নিয়ে যেন একটা স্বপ্ন দেখতেও শুরু করেছিলাম। হঠাৎ কানের কাছে কামান দাগার মতো শব্দ পেয়ে চমকে গিয়ে উঠে পড়লাম। একপ্রকার চিৎকার করেই প্রশ্ন করলাম, 'কে? রাতদুপুরে কে এমন বিকট আওয়াজ করে?'
আমার চিৎকার শুনে বিকট কণ্ঠের অধিকারী হয়তো খানিকটা ভয়ই পেয়ে গেল। তারপর মিনমিনে গলায় বলল, 'উস্তাদ আমি। মশাপুর থেকে এসেছি।'
তাকিয়ে দেখলাম আমার নাকের ডগায় একটা ইঁদুর ভেসে বেড়াচ্ছে। ভালোমতো তাকাতেই আমার ভ্রম কেটে গেল। এটা ইঁদুর নয়; বিরাট সাইজের একটা মশা। আমি আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম, মশাপুর থেকে তো মশা মিয়ারই আসার কথা! ব্যাটা মশারির মধ্যে ঢুকল কীভাবে! এত কায়দা করে মশারি টাঙানো তাহলে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গেল! মশাটার যে সাইজ তাতে এমন বিকট আওয়াজ করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়।
গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর রেখেই বললাম, 'আমার কাছে তোমার কী দরকার?'
মশা যেন আমার কিছুটা কানের কাছে চলে এলো। তারপর অপরাধীর সুরে বলল, 'গতকাল আমার বউ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে।'
আমি রাগত স্বরে বললাম, 'সেজন্য আমি কী করতে পারি?'
মশার হাসি যেন এবার খানিকটা চওড়া হলো। দাঁত বের করে হেসে বলল, 'শুনলাম, আপনার বউও নাকি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। তাই আপনার কাছেই এলাম।'
'এই সংবাদ তুমি কোথায় পেলে? এটা তো কারও জানার কথা নয়!'
মশা তার মুখের হাসি আরও চওড়া করে বলল, 'মশাপুরে মশার কোনো অভাব নেই। আর যে কোনো সংবাদ বাতাসেরও আগে পৌঁছে যায়।'
মশার কথা শুনে আমি ভারি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এটা চিন্তার বিষয়ই বটে!
এই সংবাদ কোনো মানুষের কানে গিয়ে পৌঁছেছে কি-না কে জানে! তাহলে আর মান-সম্মানের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
মশার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, 'সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুমি আমার কাছে এসেছ কেন?'
মশার গলার স্বর এবার যেন খানিকটা দুঃখী হয়ে উঠল। সে বলতে লাগল, 'বউ চলে যাওয়ার পর মশার সাম্রাজ্যে আমাকে নিয়ে নানান ধরনের কথাবার্তা শুরু হয়েছে। আমার আর লজ্জার কোনো সীমা নেই। তাই ভাবলাম আপনার কাছেই যাই। আমার দুঃখ কেবল আপনিই বুঝতে পারবেন।'
বুঝলাম শেষের কথাটা আমাকে খোঁচা মারার জন্যই বলা হয়েছে। তবুও গায়ে মাখলাম না। সামান্য একটা মশার সব কথা গায়ে মাখতে হবে কেন?
আমি প্রশ্ন করলাম, 'তা বাপু, তোমার বউ তোমাকে ছেড়ে চলে গেল কেন?'
'সে ভারি আজব ব্যাপার! মশাদের রাজ্য মশাপুরে আর ক'দিন বাদেই নির্বাচন। আমার বউ চায় আমি যেন নির্বাচনে দাঁড়াই। তার ধারণা একবার দাঁড়ালেই আমি প্রেসিডেন্ট-ট্রেসিডেন্ট কিছু একটা হয়ে যাব। আপনিই বলুন, এটা কি এতই সোজা?'
আমার মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠল। আমার কেসও তো প্রায় একই! ক'দিন বাদে নির্বাচন। আমি চেয়েছিলাম নির্বাচনে দাঁড়াব। এলাকায় আমার বেশ সুনাম আছে। কিছু সাগরেদও জুটিয়ে নিয়েছি। প্রচার-প্রচারণার কাজ তারাই করে দেবে। বউকে গিয়ে বললাম, 'নির্বাচনে দাঁড়াতে চাই। তুমি কী বলো?'
অবাক হলে মানুষের চোখ নাকি কপালে উঠে যায়। আমি স্পষ্ট দেখলাম আমার কথা শুনে বউয়ের চোখ মাথার চাঁদিতে উঠে গেল। সেই অবস্থায় বউ আমাকে বলল, 'তুমি নির্বাচন করবে!'
'অবশ্যই। কেন নয়? আমাকে কি নেতা বলে মনে হয় না?'
'তোমাকে ভোট দেবে কোন পাগলে?'
এই কথা শুনে আমি খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম। এসব কী বলছে আমার ঘরের বউ! আমি ভীষণ রেগে গেলাম। তারপর বললাম, 'কেন দেবে না?'
বউ বলল, 'এটা তো বহু পরের বিষয়। আমি নিজেই তো তোমাকে ভোট দেব না। তোমার মতো অযোগ্যকে...'
বউ তার কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই আমি রণহুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালেই ব্যাগ গুছিয়ে সে চলে যায়।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মশা বলল, 'কী ব্যাপার, কিছু বলছেন না যে!'
আমি তবুও চুপ করে রইলাম।
মশা দাঁত বের করে হেসে বলল, 'প্রাইভেট ব্যাপার হলে বলার দরকার নেই। আপনি এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি যাই।'