প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৩, ০০:০০
সামাজিক যোগাযোগের অনলাইন মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। ভার্চুয়াল বাস্তবতায় এ মাধ্যমের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। নিজের অভিমত-প্রতিক্রিয়া মুহূর্তেই অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায় বলে ফেসবুকের প্রতি আকৃষ্ট মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফেসবুক যেহেতু সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম আধুনিক মাধ্যম, তাই এটির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে সামাজিকতার কতটুকু রক্ষা হয় সেটি বিচার্য। ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট, বন্ধুর সংখ্যা, লাইক ও কমেন্টের হিসাব কি ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারক হতে পারে? পারস্পরিক যোগাযোগে অতিমাত্রায় যন্ত্রনির্ভরতা মনের সংযোগকে কি গৌণ করে দেয়?
ফেসবুক দূরের বন্ধুদের কাছে এনে দেয়। প্রায় ভুলতে বসা মানুষটি হুট করে উদয় হয়ে পুরনো সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। ফেসবুকের পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, প্রণয় এবং পরিণয়ের ঘটনা এখন আর বিস্ময় সৃষ্টি করে না। তবে যোগাযোগের ভার্চুয়াল মাধ্যমগুলোকে কখনও জ্যান্ত মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে দেখে দুর্ভাবনায় আক্রান্ত হতে হয়। সুদূরের অজানা মানুষটিকে কাছে টেনে আনায় দোষ নেই। কিন্তু কাছের মানুষটিকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার দায় অস্বীকার করা যায় না। অস্বীকার করা যাবে না, তরুণ প্রজন্মকে খেলার মাঠের সঙ্গীর চেয়ে ফেসবুকের বন্ধুরা বেশি টানে। প্রাকৃতিক নৈসর্গ থেকে দূরে সরে মুঠোফোন অথবা কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে ওঠা চিত্রে মগ্ন হয়ে তাদের সময় কেটে যায়। পোস্ট করা মন্তব্য (স্ট্যাটাস), ছবি ও ভিডিওচিত্রে কতগুলো ‘লাইক’ পড়ল আর কতজনে ‘কমেন্ট’ করল তা জানতে বারবার ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুঁ মারে। এমনও হয়, সামনে জলজ্যান্ত বাবা-মা বসা কিংবা বসে আছে দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ পাওয়া শৈশবের বন্ধুটি অথবা শ্রদ্ধেয় শিক্ষক; তাদেরকে উপেক্ষা করে হাতের সক্রিয় সেলফোনে চলে যাচ্ছে মনোযোগের সবটুকু। রক্তমাংসের মানুষের চেয়ে যখন ফেসবুকে বন্ধুর ছায়া প্রধান হয়ে ওঠে তখন প্রশ্ন জাগে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমটি স্বাভাবিক অনুভূতিকে যান্ত্রিকতায় মুড়ে আমাদের অসামাজিক করে তুলছে না তো!
যে কোনো পরিবর্তনে ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশেল থাকবেই। তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর সচেতনতা ও সদিচ্ছার ওপর। মুঠোফোন অতঃপর ইন্টারনেটের আবির্ভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং রীতি অনেকটাই বদলে গেছে। মোবাইল ফোন আসার আগে বন্ধু-প্রিয়জনের সঙ্গে সশরীরে দেখা করা বা পত্র আদান-প্রদানই ছিল যোগাযোগের উপায়। এখন বেশিরভাগ মানুষের হাতে সেলফোন। তাতেও কণ্ঠ শোনার চেয়ে ‘চ্যাটিং’ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে অনেকে! কেবল ‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’ দিয়ে মনের আবেগের প্রকাশ ঘটে না। কেউ সত্যিই কোনো বিষয় পছন্দ হলে ‘লাইক’ দেয়, নাকি লোক দেখানোর জন্য নির্বিচারে 'লাইক' দিয়ে থাকে তা বোঝার তেমন উপায় আছে কি? বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনলাইন কার্যক্রম নিয়ে গবেষণায় সান ডিয়েগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কেভিন লুইস ও তার সহযোগীরা জানিয়েছেন, ফেসবুকের 'লাইক' আসলে কোনো ধরনের বাস্তব পছন্দ বা অঙ্গীকার প্রকাশ করে না। আগ্রহের বাইরেও অনেকে অনলাইনে অচেনা-অজানা বিষয়ে শুধু আন্তরিকতাহীন বাহ্যিক সংহতি প্রকাশ করতে ‘লাইক’ অপশনে ক্লিক করে বা সহানুভূতিমূলক ‘কমেন্ট’ করে। কণ্ঠ, মুখদর্শন কিংবা আনন্দণ্ডবেদনামিশ্রিত বাস্তব আবেগ ফেসবুকের মাধ্যমে অনুভূত হতে পারে না।
সময়ের দাবি মেনে নতুন প্রযুক্তির প্রতি উৎসাহ দেখানোই স্বাভাবিক। বর্তমান সময়ে ফেসবুক ব্যবহারের বিরুদ্ধে যাওয়াও হাস্যকর। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সেটির ব্যবহার সমীচীন নয়। ফেসবুক ব্যবহারের প্রবণতায় পরিমিতিবোধটুকু থাকলে মানবিকতা, প্রেম, সহানুভূতি কখনও যান্ত্রিক হবে না। ঘটবে না ফেসবুককেন্দ্রিক প্রতারণা বা অনভিপ্রেত ঘটনা। মানুষের প্রয়োজনে যে প্রযুক্তির আবির্ভাব, মানবিকবোধের ওপর তার প্রভুত্ব কাম্য হতে পারে না। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট থাকার চেয়ে আবেগ-অনুভূতির কোষগুলো বাঁচিয়ে রেখে আচার-আচরণে সামাজিক হওয়া কম গুরুত্বের নয়, এটি অনুধাবনের সময় এসেছে।