প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
বেশিদিন হয়নি নতুন রুমে এসে উঠেছি। এরই মধ্যে পিঁপড়ার সাইজের অতিশয় ক্ষুদ্র এক নেংটি ইঁদুরের উৎপাতে রাতের ঘুম হারাম হতে বসেছে। প্রতি রাতেই সে রুমে প্রবেশ করবে। কীভাবে প্রবেশ করে সেটা বুঝে ওঠা সাধ্যের বাইরে। এরপর তার খুশিমতো সারারাত ধরে রুমে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করে সবকিছু একেবারে তছনছ করে তারপর ক্ষান্ত হবে।
বাড়ি থেকে আসার সময় মা এবার খুব কায়দা করে বস্তায় মুড়ি ভরে দিয়েছিলেন। আমিও রুমে এনে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলাম, সারা রুম মুড়ি দিয়ে ভর্তি। ঘটনার কিছুই আমার বোধগম্য হলো না। রুমমেটকে বললাম, 'ব্যাপারটা কী হলো? রুমে এভাবে মুড়ি ছড়িয়েছে কে? কোনো পাখিকে খাবার দিয়েছ নাকি?'
আমার কথা শুনে সে মুখ টিপে হাসতে লাগল। আমার ভারি বিরক্তি লাগল।
‘হাসার কী হলো? রাত্রে কী করেছ সেটা আগে বলো।’
‘আমি আর কিছু করিনি। যা করার সেটা ইঁদুর বাবাজিই করেছে।’
হাসতে হাসতে জবাব দিল রুমমেট এমরান।
মাথা খারাপ হওয়ার দশা। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আবারও জায়গা বদলানো লাগবে।
সেদিন মুড়ির ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। তাই কোনো কিছু রাখার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত বলে মনে করলাম। বাজার থেকে শক্ত এক ধরনের মিষ্টি কিনে এনে কিছুটা খেয়ে বাকিটা পড়ার টেবিলের ওপর রেখে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, এখানে ইঁদুরের আসার সাধ্য নেই। ও মা! দুপুরে ক্লাস শেষ করে এসে দেখি কম্ম সাবাড়। আমার মিষ্টির প্যাকেট থেকে মনের সুখে সে মিষ্টি খেয়ে পালিয়েছে। সেদিন রাতের অন্ধকারে কাজ সেরে পালিয়েছিল; আর আজ একেবারে দিনের আলোতে কাজ সারল! ভারি মুশকিলের ব্যাপার তো!
‘আমাদের দ্রুত একটা ফয়সালা করা দরকার।’
মারমুখী ভঙ্গিতে এমরানকে বললাম।
‘কোন ব্যাপারে?’
এমরান কোনো একটা কাজ করছিল। আমার প্রশ্ন বুঝতে পারেনি। ব্যাপক রাগ হলেও তাই চেপে গিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, 'তোমার ইঁদুর বাবাজির ব্যাপারে।'
‘তাকে তো চোখে দেখাই মুশকিল। ধরবে কীভাবে?’
‘ইঁদুরের বিষ প্রয়োগ করলে কেমন হয়?’
আমি বেশ আশাবাদী হয়ে উঠি।
‘বিষে কাজ হবে না। ভেজালে ভর্তি।’
‘সব কিছুতে খালি ভেজাল খুঁজে বেড়াও কেন? প্রয়োগ করে দেখেছ কখনও?’
‘দেখিনি আবার! ইঁদুর তো সেদিন বিষ নিয়েই পালিয়েছিল!’
এই পুঁচকে ইঁদুরের কারসাজিতে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাহলে তাকে আটকানোর কোনো উপায়ই নেই!
দিন দিন আমাদের ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। রুমে বইয়ের কোনো অভাব নেই। যেদিন সামনে কোনো খাবার না পায় ইঁদুর মশাই সেদিন তার তীক্ষষ্ট ফলার মতো দাঁত দিয়ে বইয়ের ওপর নির্যাতন চালায়। বাধ্য হয়ে পরদিন তাই খাবার এনে রাখতে হয়। কতদিন যে তাকে ধরার জন্য সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করেছি দু'বন্ধু মিলে, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু তার চেহারা দেখতে পেলে তো! জিন-ভূত নাকি, আবার তা কে বলবে!
দিনের পর দিন যখন ইঁদুরের অত্যাচার বেড়েই যেতে লাগল, তখন আর চুপ করে বসে থাকা সমীচীন নয়। আমি একদিন হুঙ্কার ছেড়ে বললাম, 'এই শয়তানের হাড্ডিটাকে যেভাবেই হোক ধরতেই হবে।
‘তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো। আমি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছি।’
‘কিন্তু সামান্য একটা ইঁদুরের কাছে এভাবে পরাজয় স্বীকার করা যায়?’
‘দেখ চেষ্টা করে।’
নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলল এমরান।
বুঝতে পারলাম, ইঁদুর বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা বৃথা। সে আগেই হেরে বসে রয়েছে। যা করার আমার নিজেকেই করতে হবে।
কুট... কুট... কুট...
দুপুরে ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছি। হঠাৎ কোনো কিছু কাটার শব্দ পেয়ে চমকে উঠে বিছানায় বসে পড়লাম। আগে অনুমান করে নিলাম শব্দটা কোথা থেকে আসছে। নিশ্চিত হলাম, দেয়ালে ঝুলানো একটা প্যাকেটের ভেতর থেকেই আসছে। এমরান ওতে খাবার ঝুলিয়ে রেখেছিল। যা বোঝার তাতেই বুঝে গেলাম। আজকে তোমাকে হাতের নাগালে পেয়েছি বাছা! এত সহজে কি আর ছাড়ছি!
খপ্ করে ধরে প্যাকেটের মুখ একেবারে বন্ধ করে দিলাম। এবার পালাবে কোথায়! বাংলা সিনেমার ভিলেনের মতো অট্টহাসি দিয়ে বললাম, ‘এবার তোকে কে বাঁচাবে রে শয়তান! তোকে আমি একেবারে আলুভর্তা বানিয়ে ছাড়ব।’
‘দয়া করুন মহারাজ। আমি খুবই ছোট। তাই আমাকে ভর্তা বানিয়ে আপনার বিশেষ কোনো লাভ হবে না। তাতে আপনার পেট তো ভরবেই না, বরং মাঝখান থেকে আমাকে মরতে হবে।’
আমি দারুণ চমকে উঠে বললাম, ‘কে কথা বলল, কে?’
‘মহারাজ, আমি ইঁদুর কথা বলছি।’
‘তোর কথা বলা ছোটাচ্ছি আজকে।’
জোরে চাপ দিলাম। ইঁদুর কঁকিয়ে উঠল ভেতরে। তারপর বলল, 'দয়া করুন আমার প্রতি। আমার ভুল হয়ে গেছে।'
‘এখন দয়া চাচ্ছিস কেন? আমার যে পরিমাণ ক্ষতি তুই করেছিস তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে শুনি! পারবি ক্ষতিপূরণ দিতে?’
প্যাকেটের ভেতর থেকে কোনো জবাব পাওয়া গেল না। আমি আবার হুঙ্কার ছেড়ে প্রশ্ন করলাম, 'কী রে, জবাব দিচ্ছিস না কেন?'
‘মহারাজ, আমাকে একটু বাইরে বের হতে দেবেন? ভেতরে দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
ব্যাটা তো ভারি চালাক। আমি বাইরে বের করি আর সে এক দৌড়ে হাওয়া হয়ে যাক আর কি!
‘বাইরে বের করলে তো তুই পালিয়ে পগার পার হয়ে যাবি!’
‘না, মহারাজ আমি পালাব না। কথা দিচ্ছি আপনাকে।’
ক্ষীণ স্বরে বলল সে। আমার মনে দয়া এসে ভর করল। মুখ খুলে বাইরে বের করে দিলাম। টেবিলের ওপর বসিয়ে দেখি সত্যিই পিঁপড়ার সাইজের।
ইঁদুর খুব ন¤্র স্বরে বলল, ‘ধন্যবাদ মহারাজ।’
‘তুই বারবার আমাকে মহারাজ বলছিস কেন?’
ধমক মরলাম আমি।
‘আমাদের সমাজে বড়দের এটাই বলার নিয়ম। ইঁদুরের সাম্রাজ্যে তারা খুবই নিয়ম মেনে চলে।’
‘তা তুইও কি নিয়ম মেনে চলিস? অন্যের রুমে গিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করাই কি তোদের নিয়ম!’
‘না, মহারাজ। পেটের দায়ে এই পথে আসতে বাধ্য হয়েছি। ঘরে বউ, ছেলেমেয়ে আছে তো!’
পরিবারের কথা বলতে লজ্জায় একেবারে যেন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে নেংটি ইঁদুরটা। আমি বললাম, 'এখন তোকে নিয়ে কী করব বল?'
‘আপনার যা ইচ্ছা হয় মহারাজ। তবে শুনেছি সৃষ্টিজগতের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে বেশি দয়ালু। যদি একটু দয়া করতেন...’
‘ভারি চালাকি করা শিখে গেছিস দেখছি! তোকে ছেড়ে দিলে তখন তো আমার পুরো সর্বনাশ করে ছাড়বি।’
‘না, মহারাজ, আমরা উপকারের কথা কখনও ভুলি না।’
মনে মনে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এতটুকু একটা ইঁদুর মেরে কী আর লাভ হবে!
‘যা তাহলে। আর ভুলেও রুমের এদিকে আসবি না।’
‘জো হুকুম মহারাজ।’
*
‘তোর রুমে ইঁদুর মারা বিষ আছে?’
পাশের রুম থেকে বন্ধু মালেক এসে বলল।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, 'কেন? ইঁদুরের উৎপাত হচ্ছে নাকি?'
মালেক হতাশার সুরে বলল, 'আর বলিস না। ক'দিন থেকে কয়েকটা ইঁদুর রুমে এসে বেশ জ্বালাতন করছে।'
‘নেংটি ইঁদুর নাকি?’
‘হ্যাঁ। তুই জানলি কেমন করে?’
মালেক পুরোপুরি অবাক হয়ে গেল। আমি তার প্রশ্নের জবাব দিলাম না। আমার শুধু ইঁদুরের বলা সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ছে। সে বলেছিল, 'আমরা উপকারের কথা কখনও ভুলি না।'
এই কাহিনি তো আর মালেককে বলার উপায় নেই! মনে মনে ইঁদুরের কারসাজির কথা চিন্তা করে একচোট হেসে নিলাম।
* পাঠক ফোরামে লেখা পাঠানোর ই-মেইল : [email protected]