প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০
চুপচাপ এসে পাশে দাঁড়াল হুমায়ুন কাকা। বিকেলের এই সময়টা সাধারণত আমি একাই বেলকনিতে হাঁটাহাঁটি করি। কেউ বিরক্ত করে না। জীবনের ব্যস্ততাকে ঝেড়ে ফেলে কিছুক্ষণের জন্য প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে চাই। একা একা শেষ বিকেলের আকাশ দেখি। কিছু বলবে হুমায়ুন কাকা? একটা মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। অনেক্ষণ ধরে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। এত করে বললাম, সে যেতে রাজি হচ্ছে না। তুমি বলোনি এই সময় কারও সঙ্গে দেখা করি না আমি? বলেছি, সে কিছুই শুনছে না। ঠিক আছে, ওনাকে চা-নাস্তা দাও, আমি আসছি। হুমায়ুন কাকা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ভক্তরা মাঝে মধ্যে এমন করে, হুটহাট চলে আসে। আমি আকাশের দিকে তাকাই, মেঘ জমেছে, যে কোনো সময় বৃষ্টি আসবে নিঃসন্দেহে। একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিল।
২.
আমাকে দেখে মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। নিচুস্বরে বললাম, ওঠার দরকার নেই, বসুন। শ্যামলা বর্ণের মেয়ে, মুখের বাঁ দিকে বড় একটা তিল সহজেই নজরে আসে। লম্বায় পাঁচ ফিটের মতো হবে। মিষ্টি কণ্ঠে বলে উঠল, আমাকে চিনতে পেরেছেন? মেয়েটির মুখে এমন কথা শুনে ভালো করে তাকালাম, হ্যাঁ কিছুটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায় দেখেছি? উত্তরটা মেয়েটিই দিয়ে দিল, গত বছর আপনার উপন্যাসটা যে প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল, বই মেলায় তাদের স্টলে আমি সেলসগার্ল হিসেবে ছিলাম। আপনার বই শুধু বিক্রিই করিনি, পড়েছিও, বলতে পারেন আপনার বড় একজন ভক্ত আমি। বাহ্, শুনে ভালো লাগল। অফিস করে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই, ওহ্ আজ আমার বার্থ ডে, জানেন তো?। মেয়েটি এক সঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে। নাহ্ জানি না, জানার কথাও না। মেয়েটির হাসি মলিন, হুম তাই তো। হ্যাপি বার্থ ডে। থ্যাংকস। জানেন আমার আরও একটা পরিচয় আছে আপনার কাছে। অনেকটা অবাক হলাম, বিস্ময় চোখে বললাম কী?। আমি আপনাকে রোজ দুটি করে কবিতার লাইন লিখে এসএমএস করি। আচ্ছা, তাহলে আপনি সে?। জি। আপনি একটা অদ্ভুত, কখনও উত্তর দেন না কেন? মেয়েটির এমন কথায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যাই। এমনিতেই। বুঝতে পারলাম মেয়েটির আমার কথা পছন্দ হয়নি। তো আপনার নাম কী?। যূথী, চটপটে উত্তর। সুন্দর নাম, তো যূথী আপনার বার্থ ডেতে কী গিফট করতে পারি। স্রেফ আপনার একটা অটোগ্রাফ দিলেই চলবে। তাই, হেসে উঠলাম ওর কথায়। অটোগ্রাফ নিয়ে মেয়েটি চলে গেল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অকারণেই মনের দেয়াল ভিজে যাচ্ছে আমার, আগে তো এমন হয়নি।
৩.
বাস থেকে নামতেই বুঝলাম পিকপকেট হয়েছে। মাথাটাই গরম হয়ে গেল, হেঁটে এত দূর যাব কীভাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে থামল আমার সামনে। ভেতর থেকে মিষ্টি একটা কণ্ঠ, আপনি তো সায়েন্সল্যাব যাবেন তাই না, উঠে পড়ূন, আমিও সেই দিকে যাব। ভালো করে তাকিয়ে দেখি যূথী; কিন্তু আমি সায়েন্সল্যাব যাব মেয়েটি কী করে জানে?। এত ভাবার সময় নেই, হাঁটার চেয়ে উঠে পড়াই ভালো। সারা রাস্তায় মেয়েটির সঙ্গে আর কথা হলো না। কেন যেন মেয়েটির চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মনের মাঝে অচেনা এক শিহরণ। সায়েন্সল্যাব নামতেই মেয়েটি বলল, আপনার মানিব্যাগটা আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রবেশী লোকটাই নিয়েছে। এরপর সাবধানে বাসে যাতায়াত করবেন। এই বলেই অটোরিকশাওলাকে বলল, চলুন। আমি হতবাক, কী বলব বুঝতে পারছি না। অটোরিকশা চলে গেল, আর আমি মার্বেলের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইলাম।
৪.
এসব কাকতালীয় হতে পারে, মেয়েটি কী করে জেনে যায় আমার বিষয়গুলো। যূথী বলেছে, আমার শেষ উপন্যাসটা হিট করবে, তাই করেছে। তারপর সেদিনের বিষয়টা! ওহ্ আর ভাবা যায় না। এখন মেয়েটির এসএমএসের উত্তর দেই আমি। কেন যেন ওকে ভালো লাগতে শুরু করেছে আমার। হোক না ও একটু খাটো, জয়া বচ্চন তো অমিতাভ বচ্চনের চেয়ে ঢের খাটো। এসব অনেক কথাই ভাবি আমি বেলকনিতে বসে। মেঘের প্রতিটি ভাঁজ যেন যূথীর উড়িয়ে দেওয়া আঁচল, যার শুরু আছে শেষ নেই।
৫.
হুট করেই মেয়েটির এসএমএস দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বিষয়টা মোটেও আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। নম্বরও বন্ধ। মেয়েটির ঠিকানাও আমার জানা নেই। তাই প্রকাশনীর মালিকের কাছে গেলাম, মেয়েটির ঠিকানা নিতে। আমার কথা শুনে মালিকের চক্ষু তালগাছে। কী করবেন আপনি সামান্য সেলস গার্লের ঠিকানা নিয়ে? দরকার আছে। শেষ পর্যন্ত দিল ঠিকানাটা। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে থাকে মেয়েটি। ঠিক সন্ধ্যায় মেয়েটির ঠিকানা মতো পৌঁছলাম। দরজায় নক করতেই একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখে বলল, আপনাকে ঠিক...। পরিচয় দিয়ে বললাম যূথীর কাছে এসেছি। ও আচ্ছা বসুন। আমাকে বসতে দিয়ে মেয়েটি ভেতরে চলে গেল। ছোট ছোট রুম; কিন্তু যূথীর স্বর কোথাও শুনতে পাচ্ছি না। খানিকবাদে মেয়েটি চা-নাস্তা নিয়ে এল। আমি কিছুই খাব না, যূথীর সঙ্গে দেখা করে চলে যাব। ও তো নেই। নেই মানে? ও বাড়িতে চলে গেছে, আর ফিরবে না। এই চিঠিটা আপনাকে দিয়ে গেছে। তাৎক্ষণিক চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলামথ
'আমি জানি আপনি আমার খোঁজ করতে আসবেন। কারণ আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। আপনি বেসেছেন বললে ভুল হবে, আমি আপনাকে বাসাতে বাধ্য করেছি। আসলে আমি মানুষের ভবিষ্যৎ দেখতে পারি। সেই সঙ্গে মানুষের মনকেও বশ করতে পারি। অর্থাৎ আমি যা চাইব সে তাই করবে। যেটা করা ঠিক নয়, এর আগে কখনও করিনি। আপনাকে করেছি শুধু। এটা ঠিক হয়নি আমার, অনেকটা জেদের বসেই করেছি কাজটা। কারণ আপনি আমার এসএমএসের উত্তর দিতেন না। কষ্ট লাগত তখন আমার কাছে। আসলে আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। সবই একটা গোলক ধাঁধা। এমন করার জন্য আপনার কাছে সত্যি ক্ষমাপ্রার্থী। আমি গ্রামে ফিরে যাচ্ছি, বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। জানেন আমার এই সংসারটাও টিকবে না। বাবা-মাকে অনেক বোঝালাম কিন্তু সবাই বলে এটা আমার পাগলামি। পাগলের বিলাপ সব। শেষ পর্যন্ত তাদের কথাই শুনতে হলো। আপনার সঙ্গে আর কখনও দেখা নাও হতে পারে। তবে আপনার দেওয়া অটোগ্রাফটা আমার কাছে সারাজীবন থাকবে। ভালো থাকবেন। ইতি-যূথী।'
চিঠিটা শেষ করতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। সামনে থাকা মেয়েটি বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনের দেয়ালটা আজ কান্নার বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। জানি, এই কান্নাটাও কোনো এক গোলাক ধাঁধার।