প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২১, ০০:০০
আজ সকাল থেকে আকাশের মেঘের ঘনঘটা। হয়তো যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। বাতাসও বইছে। মেঘের গর্জনও কিন্তু কম নয়। উত্তর কোণের ঝড়ো বাতাসে যেনো সারি সারি সুপারি বাগানের গাছগুলোর ডগা মাটি স্পর্শ করছে। বাতাসে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। সন্ধ্যার আগেই প্রবল ঝড়ণ্ডবাদল শুরু হলো।
নিজের কক্ষের পড়ার টেবিলে একা একা বসে বই পড়ছিলো হিমেল। ঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ হয়ে গেলো। প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়ার টেবিলে বসে বই পড়ছিলো হিমেল। রাত যতোই গভীর হচ্ছে ঝড়ের গতি ততোই বাড়তে লাগলো। শেষ রাতের আগেই ঝড় থেমে এলো। সকাল হতে না হতেই হিমেল ঘর থেকে বাইরে আসতে ভয় পাচ্ছিলো। কেননা ঝড় থামলেও কিন্তু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সাহস করে হিমেল দরজা খুলে ঘর থেকে উঠোনে নেমে এলো। গাছগাছালির ডালপালা ভেঙে পড়ে আছে। পাশের বাড়ি থেকে কান্নার করুণ সুর ভেসে আসছে। হিমেল গিয়ে দেখে কটি ঘর ভেঙ্গে পড়ে আছে। গৃহহীন পরিবারগুলো কান্না করছে। এভাবে ভয়ে ভয়ে কাটে সেদিনের সকালটা হিমেলের। মেঘ কেটে যায়। হিমেলের কেটে যায় সকল ভয় আর আতঙ্ক। ভাবে এটাই তো মানুষের জীবনের গল্প।
বাগানে কত ফুলই তো ফোটে। অনেক ফুলের কেউ খোঁজও রাখে না। তাছাড়া ফুলকে কে না ভালোবাসে। কেউ আবার বাগানের ফুল তুলে এনে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখে। তেমনই হিমেলও তার ছোট বাাগান থেকে বেশ কিছু ফুল তুলে এনে তার পড়ার টেবিলে ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখেছে। ফুলের মতো সুন্দর আর নিষ্পাপ তরুণীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে হিমেল। হিমেল গ্রামের ছেলে হলেও শহরের জনকোলাহলে বড় হয়েছে। তাই তো হিমেল কলেজ ছুটি হলে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যেতো। শহরে সে কলেজে পড়ালেখা করে। বিনোদনের জন্যে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে। অর্থাৎ থিয়েটার তার খুব পছন্দের। কলেজ কিংবা থিয়েটারে সে বেশ অভিনয় করে। তাই হিমেলের বিচরণটা ছিলো শিল্পকলা প্রাঙ্গণে বেশি। শহরে থাকাবস্থায় হিমেল যখন থিয়েটার পাড়ায় আড্ডা দিতো, ঠিক তখনই কোনো এক গ্রামের শ্যামলা বরণ তরুণীর দেখা মিলে। তাকে নিয়েই হিমেল স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। হিমেল ভাবে শ্যামলা বরণ হয়েছে তাতে কী? সেও তো, বিধাতার সৃষ্টি, হিমেল একদিন থিয়েটার পাড়া থেকে বের হয়ে চায়ের ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছে। দেখে তরুণীটি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো। দুজনার চোখ এক হয়ে যায়। হিমেল বুঝতে দিলো না সে তরুণীকে দেখেছে।
কখনোই তরুণীর সাথে হিমেলের কথা হয়নি। দূর থেকে এসে সে চলে গেলো। হিমেল চায়ের ক্যান্টিনে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পর সেই তরুণী আবার আসে। হিমেলকে দেখে চোখের ভাষায় কী যেনো বলে। হিমেল আবারো দেখে ও না দেখার ভনিতা করে। দেখতে দেখতে কেটে যায় কয়েক মাস। হিমেল বাসায় গিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়ায় মন বসাতে পারছিল না। যেন বারবার শ্যামলা বরণ তরুণীর অবয়ব চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকলো। আর ভাবতে থাকলো ও যেন বাগানে ফোটা একটি সুন্দর ফুল। একদিন সকলের কথা। হিমেল সকালে মর্নিংওয়ার্কে বের হয়েছে। এমন সময় দেখতে পেল সেই তরুণীটি একটি শিশু শিক্ষা নিকেতনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হিমেল এর চোখে চোখ পড়ে, আজ বুকে সাহস নিয়ে ওর কাছাকাছি যেতেই সে চলে যেতে লাগল। হিমেল পিছন থেকে বলার আগেই সে বলে আমি চিনি বলতে হবে না। ঘণ্টা খানেক পর আসছি। হিমেল হাত ঘড়িটার দিকে তাকায়। দেখে সকাল ৯টা বাজে ও আসবে ১০টায়। হিমেল পিছু পিছু হাটতে লাগল। কিছু দূর গিয়ে দেখে সেই তরুণী বাসার পথে চলে যাচ্ছে। হিমেল পিছন থেকে তরুণীকে ডাকে। থমকে দাঁড়ায়। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বলে এক ঘণ্টা পর চলে যায় তরুণী। হিমেলও বাসায় চলে যায়। ফ্রেস হয়ে হিমেল বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পেছন থেকে তা বৌদিদি ডাকে হিমেল কোথায় যাচ্ছ শুনে যাও। পরে শুনবো কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বৌদিদি মনে মনে ভাবে ওকে দিয়ে বাজার থেকে সদাই আনবে কিন্তু কী হলো ওতো কোনো দিন কথার অবাধ্য হয়নি।
আজ কী হলো বৌদিদি আবার ভাবে এ বয়সে ছেলেরা এমন হয়েই থাকে। হিমেল আবারো সেই স্কুলের সামনে এসে দাঁড়ালো। হাত ঘড়ির দিকে বারবার তাকাচ্ছে। তখনো ১০টা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। দূরে তাকিয়ে দেখতে পেল সেই তরুণী আসছে। কাছে আসতেই তরুণী হিমেলকে দেখে হাসতে লাগল। হিমেলের বুক ধরপর করছি, কী বলবে তরুণীকে। এই প্রথম কোনো মেয়েকে প্রেমের কথা বলবে। তরুণী বলল আসেন, একটু দূরেই ডাক বাংলোর ফুল বাগান। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দু’জন কথা বলছিল। আচ্ছা আপনার নাম জানতে পারি। উত্তরে তরুণী বলে মেঘলা। আপনার নাম হিমেল। মেঘনা বলে আপনি কী এতই ঠাণ্ডা যেন হিমেল। আচ্ছা আপনার কী বাসা এখানেই না কোনো এক পল্লী গ্রামে। আমি এখানে নিকট আত্মীয়ের বাসায় থাকি বলে মেঘলা। কে স্কুলে পড়ে। আমার ছোট ভাই। হিমেল বাগান থেকে একটি ফুল ছিড়ে মেঘলার খোপায় গুজে দেয়। এটাই হিমেল আর মেঘলার প্রথম প্রেমের সূত্রপাত। যেখান থেকে ওয়া বলে যায় সরু নদী পাড়ে নির্জনে হেটে হেটে গল্প করে। স্কুল ছুটি সময় হয়ে এলো। হিমেলের কাছ থেকে মেঘলা বিদায় নিয়ে বলে বলি কাল এ সময় কথা হবে। হয়তো বিকেলে থিয়েটাার পাড়ার সামনে দেখা হতে পাারে। হিমেলের মনে আজ বেশ আনন্দ। এই প্রথম কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছে। বিকেলে হিমেল নাটকের মহড়া দিতে থিয়েটার পাড়ায় যায়। মহড়ার ফাকে চায়ের ক্যান্টিনে এসেছে। চা খাওয়ার এক ফাঁকে দেখতে পেল মেঘলার মতো এক তরুণীকে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় হিমেল। কিন্তু সে তো মেঘলা না। তবে হ্যা কয়েক মিনিট পরই মেঘলা ঠিকই তুলো। হিমেল ওকে দেখে তাকিয়ে থাকলো। মেঘলা চোখের ভাষায় ডাকলো। হিমেল লোক চক্ষুর ভয়ে কাছে আর গেল না। শুধু পেছন থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো।
জমে উঠেছিল হিমেল আর মেঘলার প্রেম ভালোবাসা। এভাবেই কেটে যায় ওদের কয়েক মাসের সম্পর্ক। পহেলা বৈশাখ বালুময় নদীর তীরের বেলা ভূমিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো বন্ধু মহলের পক্ষ থেকে। মেঘলা সেই সিলেট আঞ্চলিক গান আইলারে নয়া দামান, আসমানেরও তেরা, বিছানা বিছাইয়া দিলাম, শাইল ধানের নেরাণ্ডদামান্দ বওণ্ডও দামানণ্ড কও রে কথাণ্ডযাইবার কথা কও যদিণ্ডকাইট্টা রাখুম কানণ্ডদামান্দ বওণ্ডদামান্দ বত্ত দারুণভাবে সারা পেল। আর অন্যদিকে হিমেল আর মেঘলা দু’জনে গান গাইল সর্বত্র মঙ্গলো রাধেণ্ডবিনোদিনী রাইণ্ড বিন্দাবনে বংশিধারী ঠাকুরো কানাইণ্ডএকলা রাতে যমুনাতে জল ভরিতে যায়ণ্ডপিছন থেকে কৃষ্ণ তখন আড়ে আড়ে চায়। জল ভর জল ভর রাধে অ গোয়ালের ঝি কলস আমার পূর্ণ করো রাধে বিনোদিণ্ডকালো মানিক হাত পেতেছে চাঁদ ধরিতে চায়, ব্রামণ আর হাত বাড়ালে চাঁদের দেখা পায়। দারুণভাবে বৈশাখী অনুষ্ঠান চলে। এতে করে হিমেল আর মেঘলার ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে যায়। অনুষ্ঠানে দু’পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিল। রাতে যখন হিমেল বাসায় ফিরে তখন ওর বৌদিদি জিজ্ঞাসা করে হিমেল মেয়েটা কে রে। হিমেল বলে কোনো পল্লীগ্রামের মেয়ে। শহুরে বসবাস করে। বৌদিদি জানার জন্য চাপাচাপি করতে লাগল। না তোদের দু’জন কে যা মানিয়েছে না হেব্বি। বৌদি বাজে কথা রাখো। বলো অনুষ্ঠান কেমন হয়েছে। রাতে খাবার খেতে বসে হিমেল বলে বৌদি সেদিন সকালে ডেকেছিলে না, তাড়াহুরো করে চলে গেছি। ওর সাথে সেদিনই প্রথম কথা হয়। ও আমাকে ভালোবাসে, ও তোমাকে ভালোবাসে আর তুমি, নেকা ষষ্ঠি। দেবর বৌদি হাস্যরস করে।
একদিন বিকেলে হিমেল শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে হাঁটছে। এ সময় ওর বৌদির সাথে দেখা হয়ে যায়। সাথে সাথে মেঘলারও দেখা যায়। তখন হিমেল ওর বৌদিকে দেখে লুকানোর চেষ্টা করে। তখন বৌদি ডাকে এই হিমেল শোন। তখন কাছে এসে দাঁড়ায়। কেরে ও হিমেল মাথা নিচু করে রাখে। কথা বল, তখন হিমেল মেঘলাকে ডেকে কাছে এনে পরিচয় করিয়ে বলে বৌদি সে দিন তোমাকে ওর কথাই বলেছিলাম। কী নাম তোমার? ও বলে মেঘলা। সুন্দর নাম তোমার, মূল বাড়ি কোথায়। মেঘলা বলে কোনো এক পল্লীগ্রামে। এখানে বাবাসহ মামার বাসায় থাকি। আমার বাবা একটি প্রাইভেট হাসপাতালে প্যাথলজিষ্ট এর চাকুরি করে। কোথায় গিয়েছিলে তুমি? বৌদি মন্দিরে গিয়ে ছিলাম পুজো দিতে। আচ্ছা তোমরা কথা বলো, আমি একটু কেনাকাটি করি। মেঘলা বলে তোমার বৌদি অনেক ভালো। হিমেল বলে ওনি আমার বৌদিদি হলেও মায়ের মতোন। আমাদের পরিবারে এসে বৌদি আমাকে পেয়েছেন অনেক ছোট। মেঘলা রাত হয়ে এসেছে বলি বাসায় চিন্তা করবে কাল একটা পরিকল্পনা করি। কী পরিকল্পনা জানতে চায় মেঘলা। আমরা ঘুরতে যেতে পারি। কোথায় যাবে? নদীতে নৌকা ভ্রমণ করি। মেঘলা রাজি হলো। পরদিন বিকাল চারটায় ওরা চলে গেলো নৌকা ভাড়া করে নদীতে ঘুরতে। নৌকা ভ্রমণ করে বিকেলের সময়টুকু কাটিয়ে সন্ধ্যার পূর্বে যে যার মতো বাসায় ফিরে যায়। এই যাওয়াই হলো হিমেল আর মেঘলার শেষ যাওয়া।
মেঘলা একদিন বিকেলে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। অনেক দিন সে তার মাকে দেখতে না পেয়ে। আর মেঘলা বাড়িতে গেলে তাকে গৃহবন্দি করে রাখে। যেন যে শহরে সে কিশোর বয়স কাটিয়েছে সেখানের কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে। অর্থাৎ হিমেলের সাথে মেঘলার সম্পর্কের কথা ওরা জেনে গেছে। তাই তো মেঘলাকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পর বন্দি করে রাখে। বছর পার হয়ে যায়। হিমেলের সাথে মেঘলার কোনো যোগাযোগ নেই। হঠাৎ একদিন মেঘলার একটা চিঠি আসে যেন পহেলা বৈশাখে দেখা করি। পহেলা বৈশাখ মানেই হিমেল আর মেঘলার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। এ দিনেই নাচ আর গান করে ওরা অনেক আপন হয়ে কাছে গিয়েছিল। আজ অনেকগুলো দিন পর মেঘলার খোঁজ এলো। পহেলা বৈশাখের দিন হিমেল মেঘলার কথা মতো দেখা করতে যায়। হাজার মানুষের ভিড়ে হিমেল মেঘলাকে খুজে ফিরে। মেঘলা দুপুরের পর হিমেলকে দেখতে পেল। চোখের ইশারায় ডাকলো। হিমেল মেঘলার ডাকে সাড়া দিয়ে ওর কাছে গেলে। নির্জনের দাঁড়িয়ে কিছু সময় বান্ধবীদের সাথে নিয়ে মেঘলা গল্প করে হিমেলে সাথে। বান্ধবীরা হেসে হেসে দুষ্টমী করে জামাইবাবু বেশ। না ভাই কেউ কারো হতে পারিনি। মেঘলা বলে তুমি কিছু একটা করো। বাড়িতে আমাকে আটকে রেখে পাত্র দেখা হচ্ছে। তুমি আমাকে রক্ষা করো। হিমেল বলে চবলো আজি আমরা বিয়ে করি ফেলি। মেঘলা বাদ সাজে। তারপর হিমেল বলে বিকেল হয়ে এসেছে চলে যেতে হবে। মেঘলা বলে চলে যাবো কেন? কী করবো, কিছু বলে গেলে না। হিমেল চলে আসে বিদায় নিনেয়। বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ। কেটে যায় সপ্তাহ, মাস এমনকি বছর। হঠাৎ একদিন হিমেলের ব্যক্তিগত ঠিকানায়য় উড়ে এলো একটা নিমন্ত্রণ কার্ড। হিমেল কার্ড খুলে দেখলো বিয়ে দাওয়াত। তাও আবার মেঘলার বিয়ে। হিমেলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। যে মেঘলা এতদিন হিমেলকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখেছে। সেই মেঘলা আজ কেমন করে ভুলে গেল। তবে কী মেঘলা এতদিন হিমেলের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করেছে। হিমেল অশ্রু ঝড়িয়ে ভাবে আর বিরহের গান শুনে...
হিমেল আজ ব্যর্থ এক প্রেমিক। যাকে ভালোবেসে স্বপ্ন দেখেছিল সেই প্রিয়া আজ হৃদয় মন্দির ভেঙ্গে অন্যের পূজারী হয়ে চলে গেছে বহু দূরে। হায়রে নিষ্ঠুর প্রিয়তমা মেঘলা আজ অনেক দূরে। হিমেল আজো মেঘলার স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছে। তারপরও হিমেল দু’ চোখে ঘৃনার দৃষ্টি। মনে মনে বলে বেঈমান তুই মেঘলা, বড়ই বেঈমান।