প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। নতুন বছরে দ্বিতীয় সপ্তাহ বলতে জানুয়ারি ১-১৪ তারিখ বুঝালাম। ভেঙ্গে বললে আবারও বিপদ হতে পারে। এই ভেঙ্গে কথা বলা গিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। একবার আমার এক বন্ধু খুব করে এক মেয়ের বদনাম করছিলো। আর তার বদনাম রটানোর পাশাপাশি এমনভাবে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথাগুলো বুঝাচ্ছে, যেনো মনে হয় ক্লাসে গণিতের শিক্ষক সর্বোচ্চ পন্থায় গণিত শিখাচ্ছেন। তো চিরন্তর সত্য বলে একটা কথা আছে, আর সে হিসেবে প্রতিটা গ্রুপে একজন গুপ্তচর ধরনের বন্ধু থাকে যার কাজ হচ্ছে এট কথা ওর কাছে গিয়ে লাগানো। আর যথারীতি তা-ই হলো বন্ধুটাও বদনাম শেষে বান্ধবীর নাম উল্লেখ করলো, আর তা-ও আবার সেই গুপ্তচর সম্বোধন করা বন্ধুর সামনে। আর ওই গুপ্তচর টাইপের বন্ধ সেই ঘটনা গিয়ে বদনাম কেন্দ্রীয় ব্যক্তিকে যতটুকু রসালোভাবে উপস্থাপন করা যায়, তার প্রায় সবটুকু দিয়েই উপস্থাপন করে বুঝিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে। আর তারপর যা কিছু হলো তা আপাতত পাঠকদের না জানলে চলবে। কারণ এরপরের ঘটনা দিয়ে রীতিমতো একখানা উপন্যাস লিখে ফেলা সম্ভব। তো সে হিসেবে আমিও পরীর সঠিক নাম কিংবা জন্মতারিখ উল্লেখ করতে চাচ্ছি না, হতে পারে নাম উল্লেখের কারণে, আমার অবস্থাও ওই বন্ধুর মতো হবে, আর তারপর আরো একখানা উপন্যাস রটে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে জীবনের পাতায়।
দেখতে দেখতে স্কুলজীবনের শেষ বছরে এসে উপস্থিত হলাম। সেবার মনে হলো, এটাই বুঝি স্কুলজীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়। ভাবতেই অবাক লাগে তখনও আমার ধারণার প্রসার খুবই ছোট ছিলো৷ প্রিয় মানুষটার জন্মদিন মনে রেখে রেখে বছরের প্রথম সপ্তাহ কাটিয়ে ফেললাম। তারপর-ই দেখতে দেখতে এসে গেল তার জন্মদিনের তারিখ। অবশ্য তার দু মাস আগে থেকে ফেসবুকেও রীতিমতো যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই তার জন্মদিনটা একটু মুগ্ধতায় বেঁধে, তারপর শুভেচ্ছা জানাতে চেয়েছিলাম। ইচ্ছানুসারে সবটাই হলো। বরাবর রাত বারোটা বাজার সাথে সাথেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালাম। জন্মদিন ছিলো ওর কিন্তু সেদিন আমার কাছেই কেনো জানি অনেক খুশি খুশি লাগছিলো। কি কারণে সেদিন খুশি হয়েছিলাম তা অবশ্য জানা নেই৷ অনেকটা রহস্যের মতো কাজ করেছিলো সেই রাত। তখন অবশ্য এতকিছু ভাবিনি বলে এর গভীরে প্রবেশ করতে পারিনি। তবে আজও প্রায়-ই সেই খুশির রহস্য খুজতে চেষ্টা করি, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ-ই যে, যতবারই রহস্য উদ্ঘাটন করতে যাই ঠিক ততবারই অশ্রুসিক্ত নয়নে বাধ্য ফিরে আসি।
আমিতো অনায়াসে বারোটা অবধি জেগে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম কিন্তু, এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে বা এত রাতে তাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কেউ অপেক্ষা করে আছে, এমনটা সে কখনোই ভাবেনি। আর তাই তো সেদিন তাকে অনলাইনেই পেলাম না। বুঝলাম রাত জেগে কোনো লাভ হলো না। তবে মনে মনে এক-আধটু স্বস্তি অনুভব করলাম। বোকা শব্দটার নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। এইতো অনলাইনে এতোকিছু অথচ বাস্তবতার জগতে ওর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতেও লজ্জা লাগে। গত সাত বছর ওর প্রতি আমার ভালোবাসা সম্পূর্ণ গোপন ছিলো। কিন্তু এই শেষ বছর আর তা গোপন রাখতে চাইনি। খুব আগ্রহের সাথেই সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে তাকে নিজের মনের কথা জানানোর খুব ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু নিজের গাধা ধরনের মনোভাবের কারণে ওর সামনে দাঁড়ানোর সাহসই সঞ্চার করতে ব্যর্থ হই। কিন্তু কিছু করার নেই, যেভাবেই হোক তাকে আমার মনের কথা জানাতেই হবে। রাতভর অনেক চিন্তা-ভাবনার শেষে করে ঠিক করলাম, নিজে বলতে পারি আর না পারি বন্ধুকে দিয়ে বলাতে পারবো! আর এটাতে আমারও তার সামনে যেতে হবে না, ভয়ও পেতে হবে না। হ্যাঁ এটাই ঠিক হবে। কিন্তু কাকে দিয়ে বলাবো? আরিফ! হ্যাঁ আরিফকে দিয়ে বলালেই হবে, ও-ই এই ঠিকঠাক ভাবে করতে পারবে। ওকে দিয়েই সবকিছু বলাতে হবে। তাহলেই পরীর সামনে না গিয়েই, আমার কাজ করা হয়ে যাবে।
পরের দিন স্কুল শুরুর দু ঘণ্টা পূর্বে স্কুলে এসে উপস্থিত হলাম। বেশ আগ্রহ আর উত্তেজনায় সারা শরীর জব্দ হয়ে আছে। যেহেতু ও আমার খুব ভালো বন্ধু সুতরাং সাত বছর চেপে রাখা অনুভূতির প্রকাশ অবশেষে ওর কাছেই প্রথমবার ভাগ করলাম। এবং এটা যে পছন্দের মানুষটাকে জানাবো সেটাও জানালাম। সে বুঝলো, আস্থা রাখতে বললো। আর মাধ্যমে হিসেবে তার কাজ করতে রাজি হয়ে গেলো। আচার-আচরণে বুঝলাম কাজটা ও বেশ আগ্রহের সহিতই করবে। অবশ্য এর আগেও আমার অনেক বন্ধুকে আরিফ এসব কাজে বেশ সাহায্য করে দিয়েছে। বলা চলে, যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক।
তিন.
ক্লাসমেট হিসেবে আমার নামটা পরীর কাছে অজানা ছিলো না। বেশ ভালোভাবেই জানতো, মনেও রাখতো সহজেই, বিশেষ করে স্যারেদের কাছে তো, আমার পরিচয় দুষ্টু-বাদর বলেই চলে আসছে। তাই নামটা কমবেশি সবারই মনে থাকা চাই। আর এই বাদরামির জন্যে পরী প্রায়ই এটা-ওটা বলে আমার সাথে দুষ্টামি করতো। কিন্তু বন্ধুকে দিয়ে সেদিন অনুভূতি প্রকাশের পর পরির দুষ্টামিটুকু বন্ধ হয়ে গেছে। প্রেমের কথা জানানোর জন্য সেদিন আরিফকে পরীর কাছে পাঠিয়েছিলাম ছুটির পর পর। আমার বিষয়ে ওরা দুজন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ১০ মিনিট কথা বললো। আমি অবশ্য দূর থেকে যতটুকু সম্ভব নজর রাখে পরিস্থিতি আন্দাজ করার চেষ্টা করেছিলাম। অবশেষে দশ মিনিট পর আরিফ ফিরে এলো। চোখে মুখে অস্বস্তিকর ছাপ। কোনো রকম আনন্দ উত্তেজনা দেখতে পেলাম না। ও আসার সাথে সাথে কি হয়েছে, কি বলেছে, জানার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। কিন্তু ও ভালো-মন্দ কিছু জানালো না। বললো বাসায় যা কাল কথা বলবো। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বাধ্য ছেলের বাসায় চলে আসলাম।
পরদিন যথারীতি স্কুলে গেলাম। গতকালকের বিষয়টা নিয়ে মনে যে চাপা উত্তেজনা ঝড় তুলেছিলো! সেটার প্রভাব এখনও মনের মধ্যে বিদ্যমান। ক্ষণিকের জন্যে স্থির থাকলেও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। সুতরাং মনের ছটফটানিতে বুঝলাম, এখন সেটা বোধহয় আবারও উঁকি দিতে চাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই চলে আসলো আরিফ। ও আসার সাথে সাথে গিয়ে চেপে ধরলাম। ধরেই প্রথম প্রশ্ন, কিরে বেটা কাল কিছু বললি না কেন?
-এমনিই বলিনি। আয় ক্লাসে গিয়ে ব্যাগ রেখে আসি।
-আচ্ছা ঠিকআছে যাবো কিন্তু কালকে ওর সাথে কি কি বললি; ও তোকে কি কি বলেছে সেটা বল! ওর অঙ্গভঙ্গিতে বুঝতে পারলাম, ও বলতে চাচ্ছে না। ঘটনা পজিটিভ হলে অবশ্যই বলতো, শুধু বলতো না আনন্দের সাথে বলতো। সুতরাং ঘটনা ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো।
-ও তোর সাথে প্রেম করতে চায় না কথাটা একটানে বলে ফেললো আরিফ। কথাটা শোনার পরপরই, সেটার চাপ নিতে রীতিমতো হোঁচট খেতে হয়েছে। কয়েক মিনিট বজ্রপাতে ঝলসানো গাছের মতো একদৃষ্টে দাঁড়িয়েছিলাম।
অনেক চেষ্টা করলাম নিজের মনকে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু না, ভেতরের সুপ্ত ঝড় আবারও আঘাত হেনেছে, এবার আর আগের মতো ভয়ংকর নয়; বরং তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর রূপে। নিজের মনের অবস্থা নিজের কাছে রেখে বাহিরটা স্বাভাবিক রাখালাম। মনের অবস্থা আরিফকে বুঝতে দিইনি। একটু স্বভাবিক হলাম। শুকনো মুখেই ঢোক গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আর কিছু বলেছে?
-হ্যাঁ বলেছে।
-কি বলেছে বলে?
-বললো তুই যে এমন কাজ করবি, সেটা ও নাকি কল্পনাও করেনি।
সাত বছরের প্রেম সাত মিনের কথায় দাফন হতে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত তাই না! পাঠক হয়তো ভাবনইনি যে, ঘটনায় এমন পরিস্থিতিও তৈরি হবে। যারা ভেবেছেন তারা অবশ্য এ রকম ঘটনার সাথে যথেষ্ট পরিচিত। আর যারা ভাবেননি তারা তো দেখলেনই অনুভূতি প্রকাশ, আর তার অবিশ্বাস্য পরিসমাপ্তি।
সেদিনের পর থেকে পরী আর কখনো আমার সাথে ক্লাসে দুষ্টুমি করে। দুষ্টুমি তো দূরে থাক আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। বুঝলাম তার চোখে-মুখে আমার জন্যে ঘৃণার আসর বসেছে। নিজেই নিজেকে গালি দিতে লাগলাম। কি দরকার ছিলো এই সামান্য কথাটুকু এতো বছর চেপে শেষ পর্যায়ে এসে প্রকাশ করার! গত সাত বছর যা অপ্রকাশিত ছিলো, তা আর সাত মাস অপ্রকাশিত থাকলেই তো চলতো, এতো বলার কি দরকার ছিলো। বললেই কি প্রেম হয়ে যায় আর না বললে কি হয় না? নিজের কাছে নিজের রাগান্বিত প্রশ্ন। তবে কোনো উত্তর নেই। ‘মন তো মগজ দিয়ে চলে না, বরং মগজই মন দিয়ে’। সুতরাং মন থেকে আসা প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর মনের কাছে ছিলো না। ছিলো নিশ্চুপ আর নিরবতার জানান।
‘একটু উষ্ণতার জন্য’ উপন্যাসে বুদ্ধদেব গুহ যে লিখেছিলেন, ব্যর্থ প্রেম আর ব্যর্থ প্রেমিক বলতে কিছু নেই। আর প্রেমের সমস্ত স্বার্থকতা প্রেমাস্পদকে পাওয়ার মধ্যে সীমিত নয়-এটাই সঠিক।
সেদিনের পর থেকে বাকি মাসগুলো কেটেছে আফসোস নিয়ে। বেরিয়েছি স্কুল ছেড়ে আকাশ ছোঁয়ার মন্ত্রে। অথচ আমার আকাশে আমি নিজে না উড়ে অন্য কারো উড়াল দেখতে চেয়েছিলাম। সম্ভব হয়নি। সামনাসামনি দেখাদেখি আর হবে কি-না জানা নেই। তবে আগে যে ফেসবুকে টুকটাক কথা হতো। সেটাও যে আর হবে না তা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম। শেষে আমাকে ঘৃণার কার্তুজ ভেবে সবদিক থেকে সুস্পষ্টভাবে অবহেলা চাপিয়ে চলে গেছে।
সেদিন থেকে দিবসের ভিন্নতা এখন আর তেমন করি না। এখন আর বিশেষ বিশেষ দিবসে তেমন উত্তেজনা, আগ্রহ কাজ করে না। এখন মনে হয় সবদিনই সমান সব পরিস্থিতিই পরিবর্তনশীল। হ্যাঁ এটাই এখন ভালো থাকার একটা মন্ত্র মনে হচ্ছে।
কলমের কালি ফুরিয়ে গেছে বলে মনে হয়। ঘড়িটাও একটা পূর্ণ সংখ্যায় জানান দিলো দুবার আওয়াজ করে। সম্ভবত রাতের বারোটা বেজে গেছে। জানি না ঘটনার কতটুকু গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পেরেছি, তবে যা কিছুই লিখেছি তার কারণবসত চোখের অশ্রুসিক্ততা মেনে নেয়ার নয়। এখন তার প্রতি আমার, না আছে কোনো কোনো আবেগ, না আছে কোনো প্রেম, না আছে কোনো ভালোবাসা। তবুও তার কথা উঠে আসলে চোখে অশ্রুসিক্ত হওয়ার কারণ কি? কেনো হয়? কেনো...।