প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ি থেকে নামতেই গুমোট গরম বাতাস চোখে-মুখে এসে লাগে। রায়হানের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ওদের টিমের সঙ্গে প্রত্যন্ত এ গ্রামে আসার সিদ্ধান্ত সঠিক কি না তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে যাই। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশ খানিকটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। এ গরমে যা রীতিমতো দুরূহ মনে হচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে ভাবনাটাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করি। গ্রামে এসে শহুরে পরিবেশ আর সুবিধা খোঁজা বোকামির নামান্তর। তার চেয়ে ইতিবাচক কিছুর সন্ধানে সময়টা উপভোগের চেষ্টা করাই শ্রেয়। আমার কাছে অসহ্য গরমও গ্রাম্য মানুষদের কর্মচাঞ্চল্যে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। প্রখর রোদে পোড়া প্রতিটি শরীর যেনো কঠোর শ্রম আর হার না মানা মানসিকতার প্রতীক!
আমাদের বন্ধুত্বের শুরু থেকে রায়হানকে একই রকম দৃঢ়চেতা দেখেছি। সংস্থাটিতে যোগ দেয়ার পর অন্য কোনো চাকরির চেষ্টা করেনি। সবাই যখন ভালো বেতনের একটা সরকারি চাকরির জন্যে কঠোর অধ্যবসায় করেছি, রায়হান তখন সংস্থাটিকে সাধারণ মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিতে দিন-রাত ছুটে বেড়িয়েছে। কত কঠিন সময় পার করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ওর প্রচেষ্টাতেই পরীক্ষায় ভালো ফল করা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। তার অংশ হিসেবেই আমাদের এখানে আসা।
তানহাদের বাড়ি খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হয় না। তার কথা জিজ্ঞেস করতেই আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে অনেকে। তানহার প্রসঙ্গ উঠতেই তাদের চোখ আনন্দে নেচে ওঠে। সবার খুশি ভাগ করে নেয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে গ্রামের মানুষদের।
তানহা বয়সের তুলনায় অনেক পরিণত। চোখে আবেগের বদলে সংকল্প প্রতিভাত। ওর কাছ থেকে জানতে পারি, মায়ের সঙ্গে টিনের চালার ঘরটিতে থাকে। পরিবারে আর কোনো সদস্য নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা স্থানীয় একটা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। মায়ের নামমাত্র বেতনেই চলে দুজনের সংসার। তানহা মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে যাবতীয় অনুপ্রেরণা। তার মায়ের ইচ্ছেটাকে নিজের ভেতর লালন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
আমরা যখন মুগ্ধ হয়ে তানহার কথা শুনছি, তার কোনো এক ফাঁকে ওর মা এসে সন্তর্পণে পেছনে দাঁড়ায়। তানহা মুগ্ধ চোখ ঘুরিয়ে ওর মায়ের দিকে তাকাতেই চমকে উঠি। খুব চেনা একটা মুখ! যেখানে বয়সের চেয়ে পরিশ্রমের ছাপ বেশি। কৌতূহল সংবরণ না করে নাম জিজ্ঞেস করি। আমার ধারণাই ঠিক, ও আফরোজা! আমরা যখন মফস্বলে থাকি, তখন ভাড়াটিয়া হিসেবে ওরা এসেছিলো। আমার সমবয়সী হওয়ায় অল্প সময়েই বেশ সখ্য হয়েছিলো। ওরা খুব বেশিদিন ছিলো না। হঠাৎ বাবার মৃত্যুতে ওরা গ্রামে ফিরে যায়। তারপর আর কোনো খবর জানি না। আজ এতো দিন পরে এভাবে দেখব কখনো ভাবিনি। তানহা তার মায়ের পাশে এসে দাঁড়াতেই মুঠোফোনের ক্যামেরা চালু করি। দুজনকে একই ফ্রেমে ধারণ করার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। ছবিটার ক্যাপশনে লেখাই যায়Ñদুই অপরাজিতা!