প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
(গত সংখ্যার পর)
মনে একরাশ ঘৃণা রেখে সেই ঘৃণিত মানুষটার সাথে ভালো ব্যবহার চালিয়ে যাওয়া, তাকে এটা অনুভব করানো যে উনি আমার খুব প্রিয় তা যে কত অসহ্য যন্ত্রণার তা আমি হারে হারে বুঝেছিলাম।
উনি আমার সাথে ভালো আচরণ করলেও আমার মায়ের সাথে করছিলেন জঘণ্য ব্যবহার। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা, অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয়া, খিটখিট করা, আম্মুকে এক মিনিটের জন্যেও বিশ্রাম নিতে দিতেন না উনি। কাজ না থাকলে যখন আম্মু একটু বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে শুয়ে থাকতেন উনি তখন গুছানো ঘর আবার এলোমেলো করে দিতেন, পরিষ্কার জামা-কাপড় আবার ইচ্ছা করে ময়লা করে দিতেন আরো কত কি!
আম্মুর জীবনটা হয়ে উঠছিলো বিষাক্ত।
আর আমি! এসব মুখ বুজে সহ্য করে গিয়েছিলাম। আব্বুকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওনার প্রিয় বিশ্বস্ত হওয়ার জন্য আমিও আম্মুর সাথে বিনা কারণে খারাপ ব্যবহার করতাম, রান্না ভালো হওয়া সত্ত্বেও ভালো হয়নি বলে মুখের উপর ছুড়ে মারতাম, খামোখা চেচামেচি করতাম...।
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে কোনো কিছু করাই অসহ্যকর। যা প্রতিনিয়ত আমাকে করতে হয়েছে। আম্মুর কষ্ট দেখেও চুপ করে থাকা ছিলো আমার জন্যে এই নরপিশাচকে শেষ করার এক অদম্য শক্তির জোগান।
বাবাকে তখন পেয়ে বসেছিলো নারী আর মদের নেশা! আমার তার সাথে এতোটাই সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো যে উনি ওনার সব রক্ষিতার খবরাখবর আমাকে দিতেন। ওনার মদের পেগ আমিই তৈরি করে দিতাম। তার সহকারী হয়ে উঠেছিলাম আমি।
সেদিন ছিলো ১৭ আগস্ট। বাবা যেদিন তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে খুন করে তার তারিখ। কিভাবে জানলাম এই সত্যিটা? ওই যে বললাম বাবাকে পেয়ে বসেছিলো মদের নেশা! আর তা তৈরি করার দায়িত্ব ছিলো আমার উপর। সেই পন্থাই অবলম্বন করেছিলাম।
বাবাকে সেই রাত্রে খুব বেশি পেগ খাইয়েছিলাম। বরফ আর সোডা ছাড়া কয়েক পেগ খেয়ে বাবা তাল হারিয়ে ফেলেছিলেন। আর সেই সুযোগে আমি বাবাকে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মারা যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করি।
নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সবাই সব সময় তার মনের কথাই বলে। বাবার ক্ষেত্রেও হলো তা-ই। জিজ্ঞেস করার পর উনি সেই দিনকার ঘটনা বলা শুরু করলো।
মাতাল অবস্থায় বলা এলোমেলো কথাগুলোই এখন সাজিয়ে বলছি।
বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী যে আমাদের বাসায় এসে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেছিলো, যা তা ব্যবহার করেছিলো মায়ের সাথে তা আমি বা আম্মু কেউই বাবাকে বলিনি। চুপ করে ছিলাম আমরা। কিন্তু সেই আন্টিই বাবাকে কল করে সব জানিয়ে দিয়েছিলো। বাবা ওনার আমাদের বাসায় আসার কথা শুনেই রেগে যান। ওনার দ্বিতীয় স্ত্রীর ফ্ল্যাটে গিয়ে ওনাকে সব জিজ্ঞেস করার পর যখন উনি বললো বাবার প্রথম স্ত্রী-সন্তানকে তার সহ্য হয় না, তার বাচ্চা হওয়ার ক্ষমতা নাই তাই তিনি চান বাবা যাতে মাকে ডিভোর্স দিয়ে নয়তো মেরে ফেলে আমাকে নিয়ে ওনার কাছে চলে আসে তখন বাবা আরো রেগে যান। বাবা রাজি হচ্ছিলেন না আর উনি একরোখা জিদ নিয়ে তর্ক করছিলেন। তর্কে এক পর্যায়ে বাবা ওনাকে বেল্ট দিয়ে মারতে শুরু করেন, মার খেতে খেতে আন্টি যখন জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হয় তখন তাকে চেয়ারের সাথে ওনারই গায়ের শাড়ি দিয়ে বেঁধে দেন। এর পরেও কিন্তু মারা থামাননি। ব্লেড দিয়ে সারা শরীরে অসংখ্য আচর কাটতে থাকেন, হাত-পায়ের আঙ্গুলের মাথায় সুই ঢুকিয়ে দেন। যাতে চিৎকার করে লোক জড়ো করতে না পারেন মুখে কাপড় ঢুকিয়ে স্কচটেপ মেরে দেন। এতেও যখন তার রাগ কমলো না তখন হাতুরি দিয়ে হাতের আঙুলে মেরে থেতলে দিয়েছিলেন।
‘আন্টির কৈ মাছের প্রাণ ছিলো!’ কথাটা বলতে গিয়ে জাবিন হেসে উঠলো। এতো নির্মম কাহিনি বর্ণনা করার সময়েও কেউ হাসতে পারে আশরাফের তা জানা ছিলো না। অথচ এই কাহিনি শুনে তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ে পরছে।
জাবিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর ভঙ্গিতে আবারো বলা শুরু করলো.. এতো মার খাওয়ার পরেও যখন উনি মরে যাচ্ছিলেন না তখন বাবা ছুটে গিয়ে রান্নাঘর থেকে ছুরি এনে আন্টির গলায় চালিয়ে দেন। তারপর?
শেষ!
বাবা তার নিজ হাতে তার নাজায়েজ স্ত্রী রক্ষিতার বিসর্জন দিয়ে দিলেন। রক্তমাখা ছুরি আর শরীর নিয়ে উনি তখন আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে বিকট শব্দে হেসে উঠেছিলেন। তারপর লাশ বস্তাবন্দি করে রাতের অন্ধকারে নর্দমায় ফেলে রেখে আসেন।
একটা মানুষ.. না না তাকে মানুষ বলা চলে না। নিকৃষ্ট কিট বলা চলে। তা না হলে কি কেউ কাউকে এতটা কষ্ট দিয়ে মারতে পারে! ওনার দ্বারা সব সম্ভব।
ওহ ভালো কথা, আমি ওনার সব কথা ক্যামেরায় রেকর্ড করেছিলাম। ক্যামেরাটা শুধু ওনার দিকেই তাক করানো ছিলো। যা প্রমাণস্বরূপ পরে আমি পুলিশের নিকট হস্তান্তর করি। আর সেই সাথে বাবার রক্ষিতাদের খবরাখবরও দিয়ে দিই। সবচাইতে মজার ব্যাপার কি জানেন? যে পুলিশ অফিসারের কাছে আমি সব প্রমাণ হস্তান্তর করি ওনার স্ত্রী ছিলো আমার বাবার প্রধান রক্ষিতা!
মা, বাবার এই খুনের বর্ণনা আর রক্ষিতদের শোক সহ্য করতে পারেননি। অর্ধপাগল হয়ে যান। দুই বছর আতুরাশ্রমে থেকে তারপর আমাকে এই বিষাক্ত পৃথিবীতে একলা রেখেই পরলোক গমণ করলেন।
তারপর থেকেই আমি একা!
এই বিশাল মহিতে আমি ভীষণ একা!
কাহিনি বলা শেষে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরো এক গ্লাস পানি পান করলো জাবিন। খেয়াল করলো কেমন মায়াময় দৃষ্টিতে আশরাফ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আশরাফের সেই মায়া দৃষ্টিকে পরোয়া করলো না জাবিন। তার কাহিনি শোনার জন্য আশরাফকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো। সালাম বিনিময় করে আশরাফের অনুমতি নিয়ে কেবিন ত্যাগ করার জন্য আসন ছেড়ে উঠার জন্য প্রস্তুতি নিতেই আশরাফ তাকে অবাক করে দিয়ে আরো একটি প্রস্তাব দিয়ে বসলো। “বিয়ে করবেন আমাকে মিস. জাবিন সুলতানা? আপনার একাকিত্বের অবসান করার অধিকার দিবেন আমাকে? আমৃত্যু এই বিষাক্ত পৃথিবীর বিষাক্ততা থেকে আগলে রাখবো আপনাকে। একটু ঠাঁই দিবেন আপনার একাকিত্বের রাজ্যে? আপনার গালের কাটা দাগটি ছুঁয়ে দেখার অধিকার দিবেন?”
প্রস্তাব শুনে থমকে দাঁড়ালো জাবিন। এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে। কয়েক মিনিট চুপ করে আশরাফের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠলো ‘যে মেয়ের শরীরে বইছে এক নিকৃষ্ট নিরপিশাচের রক্ত, তাকে নিজের অর্ধাঙ্গিণী বানাতে বিবেকে বাধবে না?’