প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
রফিকের মশারিটা পুরানো। ছিঁইড়্যা ত্যানা ত্যানা। চাচিকে একটা নতুন মশারির কথা বলেছে কয়দিন আগে। তিনি বলেছেন, আইচ্ছা তোর কাগু (চাচা) আসুক। কাগু কবে আইবো কে জানে। মশার কামড়ে সে ঘুমাইতে পারে না। রাইত অইলে কানের কাছে ভনভন করে আর কামড়াইয়া রক্ত চোষে। সারা শরীরে মশার কামড়ের গোটা গোটা দাগ। খাজলির মতো চুলকায়। রসুইঘরটা বড় বলে তারই এক কোণায় চৌকি পেতে রফিকের শোয়ার ব্যবস্থা। একলা ঘুমাইতে খুব একটা সমস্যা হয় না, তবে হঠাৎ মাঝ রাইতে ঘুম ভাঙলে পেটের ভোকমোড়ানিটা আর ঘুমাইতে দেয় না তারে।
এই কথা অর্থাৎ মশারির আবদারের কথা কুট্টি হাজী শুনেছে তক্কে তক্কে। কয় কিÑপাতিলের তলার লাহান তোর শইল্যের রঙডা! রাইতে তোর হোন্দে থাহে না কাপড়! তুই ঘুমাছ ন্যাংটা উদাম অইয়্যা! মশা তোরে দেইখ্যা শরমে কাছে আইয়্যে নাকি, হ্যাঁয়? তোরে আবার কামড়ায় কহন রে রফিক্ক্যা, হ্যাঁয়?
কথা শুইন্যা চাচি আর তার ছেলে-মেয়েরা হাসতে হাসতে খুন। তখন বুড়ার উপর মেজাজটা যায় খারাপ অইয়্যা। প্রতিশোধ যে সে নেয় না এমন না। বুড়া দাদার পাঞ্জাবির পকেটে থাকে ‘রেজ্জাক’ বিড়ি। তিনি বাড়িতে বা ঘরে পুতের বউদের সামনে বিড়ি খান না। বিড়ি খান ওয়াপদার রাস্তায় টুকটুক কইরা হাঁটতে হাঁটতে। কখনও পুরান বাড়ির মন্তা’র দোকানে গফ করতে করতে। মন্তা’র চায়ের দোকানডা গফের একটা আখড়া। বুড়ার পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুই-চাইরটা বিড়ি চুরি কইরা রাইতে চুলার আগুন গুতাইয়া ধরায়, তারপর সুকটান দেয় রফিক আর মনে মনে ভাবে-এইটাই প্রতিশোধ! ঠেঁটা বুড়ারে দিছি এখ্খান শিক্ষা! সকালে ধরা খায়। কেউ কেউ যখন বলে, কী রে! তোর গায়ে ত বিড়ির গন্ধ! বিড়ি খাস নাকি রে, রইক্কা? ইস! ধোঁয়া উড়ছে, দ্যাখ!
বই-পড়া বুইড়া মহা বদকথা কয়। হাজী না পাঁজি আল্লায় জানে! মনে মনে সে কুট্টি হাজী’র সর্বনাশ কামনা করে। কিন্তু কী সেই সর্বনাশ-তার কোনও সদুত্তর রফিকের নিজের কাছেই নাই।
মাঝে মাঝে এইসব আত্মকথায় নিজের ভেতর মগ্ন হয় সে। তখন চুলার জ্বাল কখন নিভে যায় টের পায় না। কিংবা বেশি জ্বালে গাইয়ের দুধ উতরাইয়া অর্ধেক শ্যাষ। সেই দুধ পইড়া আবার শুকায় চুলার উত্তপ্ত গায়ে। তখন চাচি রাগ করেন। কী ভাবছ এ্যাতো চুলার পাশে বইস্যা বইস্যা? চাচি’র রাগ অবশ্য কিছুক্ষণ থাকে তারপর ঠা-া।
চুলায় শুকনা গমের খড় ঠেলে ঠেলে জ্বাল দিচ্ছিলো আর লালরঙ গমের আটার রুটি বানাচ্ছিলো সে। ছেলে-মেয়েরা গেছে কাচারি ঘরে ওজুদ মালানা’র কাছে। আরবি পড়তে। এট্টু পরেই সবগুলি আইবো নাস্তা খাইতে। নাস্তা খাইয়া আবার যাইবো মনির স্যারের কাছে। বাংলা অংক পড়তে। এইটা বড় বাড়ি। এই বাড়ির সব পোলাপান বিহানে আর সন্ধ্যা দুইবেলা কাচারি ঘরে চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া পড়ে-
অমলা কণা ঊষা।
উহারা তিন বোন।
একজন বীণা বাজায়।
একজন সেতারা বাজায়।
একজন পুতুল নিয়া খেলা করে।
এসব শুনতে শুনতে তারও মুখস্থ হয়ে গেছে। কী সব হাবসি-হুবসি ছাতানাতা ওয়ান-টু মুখস্থ করে! কান ফাইট্টা যায়। এ বাড়ির মুরুব্বিরা নাকি ছাগলা-দাঁড়ি ওজুদ মাওলানা আর মনির মাস্টরকে বলে দিছে, পোলাপাইনের চামড়া আপনেগো আর হাড্ডি আমাগো! পড়া না পারলে কঠিন মাইর। মাইরা ছাল বাকলা উঠায়া নিবেন! কথার কি ছিরি! তার কাছে এ সবই নতুন অভিজ্ঞতা। তাদের, রফিকদের দশানী’র বাড়ি এইসব ঝামেলামুক্ত। সেখানে লেখাপড়ার চিহ্ন বলে কিছু নাই। নাম গন্ধও নাই।
লাল আটার রুটি পোড়া পোড়া কইরা ভাজলে যে সোন্দর গন্ধটা বার হয়, এর থেকে সোন্দর খুশবু গন্ধ ইহকাল-পরকাল কোথাও নাই বলেই রফিকের ধারণা। তারে চুলায় বসাইয়া দিয়া চাচি গেছেন পুকুর ঘাটে। কাল রাতের একগাদা আঁইডা বাসন-কোসন নিয়া। চাচি’র আইতে সময় লাগবো। এট্টু পরেই পোলাপানগুলি আইবো। কুট্টি হাজীও মিহি সুরে কোরান তেলাওয়াত শেষ কইরা টুকটুক কইরা আইবেন। গরম গরম রুটি আর আলুভাজির সঙ্গে আখের গুড়ের রঙ-চা বুড়ার জম্মের পছন্দ। এট্টু দেরি সয় না । দেরি হইলেই একলা বিড়বিড় কইরা চইলা যাইবো মাইজ্যা মিয়া, মন্তা অথবা তবি’র বাপের দোকানে। গিয়া পাউন্ড রুটি আর চা খাইয়া আইবো। পাউন্ড রুটি না থাকলে কুড়কুড়ে টোবা অথবা একখান খড়ম বিস্কুট। লুঙ্গির খুঁতিতে টাকা না থাকলে দোকানে বাকি খাইতে বুড়ার সমস্যা নাই। চাচা চিটাগাং থেইক্যা দুই-তিন মাস পর পর বাড়ি আসেন। তখন দোকানদারদের পাওনা মিটিয়ে দেন। কুট্টি হাজী বুড়া মিয়া আছেন মহা আরামে।
চাচি কইয়া গেছেন সোন্দর কইরা রুটি বেলতে আর দাদারে রঙ-চা বানাইয়া দিতে। রুটি য্যান টুপির লাহান গোল হয় আর ফুলে উঠে। চ্যাপ্টা চিটচিট রুটি এরা কেউ খায় না। রফিকের রুটি টুপির লাহান ফোলে না একটাও। মাঝে কী ভাবে য্যান টুস কইরা হাওয়া বার হয়। গোল আর টুপির মতো ফোলানো রুটি বানায় কুট্টি হাজীর মাইজ্যা পোলার বউ কাঞ্চনমালা। কাঞ্চনী চাচির রুটি কানায় কানায় ফুলে ওঠে, এক চুলও ফোলা ছাড়া হয় না-কীভাবে এ্যাত সোন্দর রুটি বানায় কাঞ্চনী চাচি আল্লায় জানে!
তবে চ্যাপ্টা চিটমিট রুটি তার খুব পছন্দ। পোড়া পোড়া দাগ না পড়লে আবার কিসের আটার রুটি! সে মাঝে মাঝে চাচিকে ফাঁকি দিয়ে, বিশেষ করে রাত্রিকালে, অল্প আটা চুরি করে লবণ-পানি দিয়ে মেখে বেশ গোল একটা আটার বল বা আটার গোল্লা বানায়। তারপর মাটির চুলার কয়লা বা মান্দারী তুষের নিভু নিভু আগুনের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করে। গভীর রাতে পোড়া পোড়া সুগন্ধ বার হয়ে এলে আঁন্ধারে বসে পরম আরামে পোড়া আটার গোল্লা খায়। এভাবে আলু পোড়াও খায় সেÑগোল আলু বা সাক্কর আলু দুইটাই খায়। মাঝে মাঝে আটার গোল্লা পোড়া দিয়ে রাজ্যের ঘুমে তলিয়ে যায় রফিক। গোল্লা খাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে কী যেনো কি স্বপ্ন দেখে। সকালে চুলার ভিতর পোড়া পোড়া গন্ধ টের পান চাচি। জিজ্ঞেস করলে চোখ মাটির দিকে নামিয়ে সে বলে, কী জানি চাচি! চুলায় আবার কিসের গন্ধ আইবো!
তার যে ভোক বেশি এটা চাচি বোঝেন, বুঝেছেন অনেক আগেই। তিনি দয়াবতী। মুখে দু-চার কথা বললেও খুব একটা রাগ করেন না। ছেলেটা নিরীহ ধরনের। অভাবে পইড়া কাম করতে আইছে। অনেক দিন ধইরা আছে। মায়া জন্মাইয়া গেছে। তাছাড়া এর যে কানপঁচা এটা রহিমা বেগম জানেন। সে কানে ধেঁন্ধা। বেশির ভাগ সময় কানে কম শোনে। যুগি বাড়ির বটু ডাক্তাররে ডাইকা কয়েকবার কান ভালো করার অষুধ কিনে দিয়েছেন। সে মনে হয় ঠিকমতো অষুধ লাগায় না। ধেঁন্ধার সঙ্গে ক্যাচক্যাচ করার ইচ্ছা নাই রহিমা বেগমের। এর সাথে ক্যাচক্যাচ না কইরা ততোক্ষণ তসবিহ পড়াই ভালো। তিনি বিড়বিড় করে তসবিহ’র গোটা গুনতে থাকেন। রফিক তার কাম করে যায়।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য।)
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]