প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
বিশ^বিদ্যালয়ের বার্ষিক শিক্ষা সফর নাকি প্রচ- আনন্দঘন হয়, বড় ভাইয়া ও আপুদের মুখে শোনা সেই আশার বাণী করোনার প্রকোপে তৈরি হয়েছে নিরাশায়। প্রথম বর্ষে থাকাকালীন নির্দিষ্ট সময়ে ট্যুরে যেতে না পারলেও দ্বিতীয় বর্ষে উঠে প্রত্যাশার অবসান ঘটলো।
৪ ডিসেম্বর সকালে অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছিলাম। সত্যি বলতে ওই রাতে ঘুমানোটা যেন ঘুমানো নয়, অপেক্ষার অবসান ঘটানো। খুব ভোরে উঠে রেডি হয়ে সকাল ৮টার পূর্বেই বাসস্ট্যান্ডে বন্ধু রাজন ও আনিছের জন্য অপেক্ষার প্রহর শুরু হলো আমার। রাজন ঠিক সময়ে আসলেও আনিস আজও আধা ঘন্টা পর এসেছে। একটি জিনিস বলে রাখি, আনিস কিন্তু আজকে দেরি করে এসেছে তেমনটি নয়, ও সবসময়ই কিছু না কিছু সময় দেরি করেই, সেজন্য আমি আর রাজন আনিছকে লেইট আনিছ বলেও ডাকি। কী আর করা। আনিছের জন্য ত্রিশ মিনিট অপেক্ষার পর ফরিদগঞ্জ থেকে সিএনজিযোগে যাত্রা শুরু হলো চাঁদপুর বড় স্টেশনের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে শঙ্কা ছিলো, না জানি সবাই আমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে। শত শঙ্কার পর অবশেষে ৯টা ২০ মিনিটে বড় স্টেশন পৌঁছালাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি হাতেগোণা কয়েকজন এসেছে মাত্র। কথাবলা ও দুষ্টামিতে কেটে গেলো আরো একঘন্টা সময়। অবশেষে ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা এলেন এবং শিক্ষা সফরের সকল জিনিসপত্র নিয়ে ট্রলারটি রওনা হয় মোহনপুরের উদ্দেশ্যে। যাত্রা শুরু হওয়ার সাথে সাথে খানিকটা মিউজিকের তালে তালে ফুরফুরা মেজাজে সবাই বেশ আনন্দ করছিলো। আবার কেউ কেউ নদীর দু’পাশের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করছিলো। একদল বরাবরের মত ব্যস্ত ছিলো ছবি ও সেলফি তোলা নিয়ে।
এমন সময় ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। আমাদের ব্যাচের রোকসানা কেয়া হঠাৎই জ্ঞান হারায়। সবকিছু মুহূর্তেই থমকে যায়। পাল্টে যায় পুরো ট্রলারের চিত্র। সেলিনা ম্যাম ও বাকি বান্ধবীদের চেষ্টায় প্রায় ৩০ মিনিট পর জ্ঞান ফিরে আসে কেয়ার। নতুন করে যেন প্রাণের সঞ্চার ঘটে। পুরো ট্রলারে থাকা সকলের মধ্যে কিছুক্ষণ পর লিখন, মাজহারুল আর ফরিদ সবাইকে কমলা, লেক্সাস বিস্কুট দিলো। কমলা ও বিস্কুট বিতরণের পর পুরো ট্রলারে কয়েকটি পানির বোতল নিয়ে চলে দুষ্টামি।
আরও কিছুটা অংশ যেতে চোখে পড়ে নদীর মাঝে জেগে ওঠা চর। চরের মধ্যে জন্মানো বড় বড় ঘাস আর কাশফুলের গাছগুলোতে সবমিলিয়ে চরের পরিবেশ ছিলো অপরূপ। মজার বিষয় হলো, আরও কিছুটা পথ যেতে দেখতে পাই চরের পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। চরের এই অংশে কোনো ঘাস নেই। ট্রাক্টর দিয়ে হালচাষ করা হচ্ছে। আবার কিছু অংশে দল বেঁধে কৃষকরা জমি চাষের উপযোগী করে তুলতে কাজ করছে। দূর থেকে অনুমান করে বলা যায়, এখানে ফসল ফলানো হবে। কিছুক্ষণ পর ট্রলারের চালকের কাছ থেকে জানতে পারলাম, ধান কাটার পর এ চরে আলু রোপণ করা হয়। তাই এখন চলছে আলু রোপণের প্রস্তুতি।
আরও কিছু অংশ যেতেই দেখতে পাই, চরের মধ্যেই ঘর-বাড়ি এবং দেখা গেলো একদল কৃষক ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যেতে ব্যস্ত। একপাশে বিশাল নদীর অপরূপ অংশ, অপর পাশে চরের এমন ভিন্ন দৃশ্য যে কারো মনে সুখের ঢেউ তুলবেই। আমাদের ট্রলারটি চরের পাশ দিয়ে যাওয়াতে চরের ও নদীর সৌন্দর্য বেশ ভালোই উপভোগ করছিলাম আমরা। কিছুটা সময় পর আবারো শুরু বক্সে মিউজিক বাজানো, সাথে সজিব, ফরহাদ, লিখন ও লিমনের এলোমেলো নৃত্য ছিলো বিনোদনের আরেকটি অংশ। পথেই চোখে পড়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহনের একলাসপুর লঞ্চঘাট।
দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা নৌভ্রমণের পর অবশেষে আমরা পৌঁছালাম মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রে। শুরুতে গেটে নাজির স্যার সবার জন্য টিকেট কিনলেন। তারপর আমরা সবাই একে একে প্রবেশ করলাম মূল পর্যটন কেন্দ্রে। ঢুকেই চোখে পড়লো মিঠাপানির বিচ, পাশেই ছিলো কক্সবাজারের ন্যায় বসার জায়গা। তার পাশেই শিশুদের বিভিন্ন ধরনের রাইড, রেল গাড়ি, দোলনা আরো কত কী। আছে বাঘ, কুমির, ঘোড়া, জেবরা, উটপাখি, দোয়েল, হনুমানসহ কয়েকটি পশুর স্ট্যাচু। একপাশে আছে দেয়ালচিত্র, যাতে বিভিন্ন পশু ও আলোকচিত্র অঙ্কন করা। দুঘন্টা ঘোরাঘুরি শেষে সবাই মিলে লাভের আকৃতির ন্যায় ভাস্কর্যের নিচে ছবি তোলা শুরু। সকলে একত্রে আবার কখনো আলাদা-আলাদাভাবে তোলা হলো ড্রোন ক্যামেরার ছবি।
পর্যটন কেন্দ্রে ঘোরাঘুরির পর এবার এলো খাওয়ার পালা। একে একে সবাই চলে এলাম ট্রলারে। সবাই সারিবদ্ধভাবে বসলাম, দুপুরের খাবার হিসেবে সবাইকে বিরিয়ানি দেওয়া হলো, সাথে কোল্ড ড্রিংকস্ও ছিলো। খাওয়া শেষে শুরু গান গাওয়ার পালা। শুরুতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমি আর তাসলিমা ২টি গান গাওয়ার পর মাইক্রোফোন গেলো প্রাণিবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান সেলিম স্যারের হাতে। সেই যে গেলো মাইক্রোফোন আর তা হাতছাড়া হয়নি বাকি সময়। পুরো পথ বেদের মেয়ে জোছনা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম-এমন হরেক রকমের গান গেয়ে মাতিয়ে রাখলেন তিনি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা কয়েকজনও গাইছিলাম স্যারের সাথে। এরই মাঝে লিখন, ফরহাদসহ কয়েকজন মিলে পুরো ট্রলারে সবার মাঝে আচার, পেয়ারা ও শশা বিতরণ করলো। তার মধ্যেও আমাদের বিভাগীয় প্রধান স্যারের গান চলছিলো দিব্যি। গানের সুর, নদীর স্রোত ও ঢেউয়ের আওয়াজ সব মিলিয়ে অসাধারণ মুহূর্তে রূপান্তর করে তুলেছিলো সময়টুকুকে। আমরা চলে এলাম চাঁদপুর প্রেসক্লাবের পেছনের মাঠের নদীর অংশে। ট্রলার ভিড়ানো হলো পাড়ে। আমাদের বিভাগীয় প্রধান সেলিম স্যারের সমাপনী বক্তব্য শুনে সবাই একে একে ট্রলার থেকে নামলাম এবং সবাই নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শিক্ষক ও বন্ধুদের সাথে সব মিলিয়ে স্মৃতির পাতায় যোগ হলো কিছু সোনালী মুহূর্ত।