রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

লাল আটার রুটি
অনলাইন ডেস্ক

রফিক ঘুম থেকে ওঠে রাজ্যের ভোক নিয়া। ভোকের কোঁড়ৎ কোঁড়ৎ শব্দে কতবার রাত্রিঘুম ভেঙে পড়ে, ফলে ঘুমটা কোনও রাতেই ঠিকমতো থিতিয়ে উঠতেই পারে না। রফিকের পেটের ভেতর ভোক-ঢেউ শেষ হতে চায় না। রাত্রি তবু গড়িয়ে গড়িয়ে একসময় বিহান বেলার আলোয় এসে থামে, তার আধিপত্য নিভে যায়, উদাস-নিরাকার অন্ধকার মুছে যায় কিন্তু ভোকের ঢেউ গড়িয়ে গড়িয়ে রফিকের তলপেটে এসে ভোরের দিকেই যেনো হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে জ্বলে ওঠে। রাত পোহানোর প্রার্থনার মতোই অন্তহীন এক মনষ্কামনায় ভোর হয় রফিকের। অতএব ক্ষুধা মিটানোর অপেক্ষাই তার ছাইচাপা তুষের আগুন অথবা অসমাপ্ত বাসনা।

মাঝে মাঝে, ক্ষণিকের আত্মচিন্তার অবসরে, নিজের পেটটাকে পেট বলেই মনে হয় না তার। মনে হয়, এটা পেট না, য্যান সোনাপুরের হাট। শনি-মঙ্গলে যেমন সোনাপুরের হাটে, সন্ধ্যার আজানের অন্তে সব কিছুই বিকিকিনি হয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, কিছুই আর বাকি থাকে না, তেমনি ওই নিঃশেষিত হাটের মতো সবকিছুই খেয়ে ফেলতে চায় রফিকের বুভুক্ষু উদর। তার মা, কুলফুরেন্নেসা বলতেন, এডার পেডে কি গুইসাপ ডুকছেনি! খালি খাই খাই!

যেহেতু ভোকই জীবনÑএই ভোক-ক্ষুধার জ্বালায় তার মা কুলফুরেন্নেসা উপায়ান্তর না দেখে একদিন তাকে এই বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়েছিলো। কাজে না পাঠিয়ে রফিকের কুরকি-আঁন্ধা মায়ের আর বিকল্প কিছুই করার ছিলো না। এক গাদা পোলাপাইন রাইখ্যা এদের বাপ বিড়ি খাওয়ার কু-প্রভাবে দীর্ঘকাল হুক্কুর হুক্কুর কাশতে কাশতে, পাঁজরের সঙ্গে তলপেট মিশে যাওয়ার পর, একদিন মইরা গেছিলো। চোখের দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে আসার কারণে, তার মা পরের বাড়িতে কাম-কাইজ কইরা যা-ও এতগুলো পেটের একটা হিল্লা করার চেষ্টা করেছে, একসময় তা আর সম্ভব হয় না। কুরকি-আঁন্ধারা সূর্য পশ্চিমে হেলে গেলেই চোখে ঝাঁপসা দেখা শুরু করে, তাদের দুনিয়া তখন একরকম আঁউস্যা আঁন্ধার। ফলে নিজে কোনও রকমে কায়তনে বাঁন্ধা একজোড়া আতস কাঁচ দুই চোখের মণির উপর এঁটে নিয়ে যারে যেখানে সম্ভব কামে দিয়া দিছেন। এছাড়া কুলফুরেন্নেসা কী-ই-বা আর করতে পারতেন। কলিজায় খিল দিয়া মায়েরাও কষ্ট হজম করে।

রফিক এসেছে এই বাড়ি। দেখতে দেখতে ক’বছর হয়েই গেল। তার মনে হয় এই তো ক’দিন আগেই য্যান সে ময়লা খাকি-রঙ মারু হাফপ্যান্টটাকে কলা গাছের শুকনা আঁতি দিয়া বাঁইন্ধা ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে গুলতি খেলার মাঠ থেকে ধরা-পড়া এক কালা বালকÑযাকে খেলা ফেলে সোজা এই কামের বাড়িতে চলে আসতে হয়েছে। খেলার নাম করে কয়েকদিন ফাঁকি দিতে সক্ষম হলেও শেষতক বড় ভাই শুক্কুরের হাতে ধরা খায় সে। তিনিই বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাথায় মুখে হাতে পায়ে ঝাঁঝালো সরিষার তেল মেখে ছোট ভাইকে কিছুটা মানুষ রূপ দিয়ে খাঁ বাড়িতে কামে দিয়া গেছিলেন। কলার আঁতি-বাঁন্ধা কোমরের তলে তখনও রফিকের ভোক ছিল।

এরা খাঁ বংশ। দশ গ্রামের লোক খাঁ বাড়ির সুনামের নামে এক লোকমা ভাত বেশি খায়। তবে এরা লোক আসলেই ভালো। খাওয়া নিয়া সমস্যা করে না। কিপ্টামি-কিরপিনিও করে না। সমস্যা যা করার সেটা করে তার, রফিকের নিজেরই পেট। সারাক্ষু চোঁ চোঁ করার তালে থাকে । গলা সমান ভাত খাওয়ার পরও, একটা ঢাঁউশ ঢেউক দিলে অথবা বেকুবের মতো পাছুপথে গন্ধভেদুলি বাছু বের হওয়ার পরই পেটের ভেতর পুনরায় কোড়মোড়ানি শুরু হয়ে যায়। সেই কোড়মোড়ানির বিকট-কিম্ভুত শব্দÑয্যান পেটের ভিতর এক যুদ্ধ। মহা গ-গোল। সে একাই সেই মহা গ-গোলের ঠুস ফোটার আওয়াজ শোনে, অন্যরা শুনতে পায় না। তবে নিঃশব্দ বাছুর অদৃশ্য গন্ধটা নিকটবর্তী লোকেরা টের পায়। তখন কেউ কেউ বিশেষ করে এ বাড়ির বুড়া দাদা এ নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। বুড়া তার পুতের বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে কয়, না গো বউ! পোলাডা বড়ই বদ বাছু ছাড়ে! এই পোলা তো পানি খায় না। তার কষার ব্যারাম। উঃ দুর্গন্ধে মনুরা উল্টায়!

বুড়া দাদার শরমভরম কম। এইরকম কথা কি কোনও মুরুব্বি লোক পুতের বউয়ের কানে তোলে! বুড়ার কথা শুইন্যা ঘরের সকলে বেতাল হাসে। সে লজ্জায় চুপ। মস্তক নিচু করে নিজের অপকর্মে খানিকটা বেহায়া কুটকুট হাসি চেপে রাখার অপচেষ্টা যে করে না তা নয়। তার কুঁচকুঁচে কালো মুখের পটভূমিতে দাঁতগুলো শাদা, কখনওবা অন্ধকারেও সেই মিটমিটে হাসি যেন জ্বলে ওঠে। এ বাড়ির সবাই এই হাসি পছন্দই করে।

রফিক চরিত্রগতভাবে কম কথা বলা ছেলে। তাই শরমিন্দা ভাব নিয়া চুপচাপ থাকে। একের ভোক অন্যে বোঝে না এই সংসারেÑএই রকম দার্শনিক চিন্তায় মগ্ন থাকে কখনও বা। পরের বাড়ি। ভোকের কথা নিজ থেকে কখনও বলতেও পারে না। নিজের মা’র কাছে আবদার করা যায়। অন্যের কাছে মুখ ফুটে কিছু বলা যায় না। সে কখনও বলার চেষ্টা করেনি অবশ্য। যা কিছু ভাবনাচিন্তাÑসবই নিজের সঙ্গে, নিজেরই অন্তর্নিহিত ক্ষুধার সঙ্গে কথোপকথন।

যদিও দিন দিন সে এ বাড়ির একজন হয়ে উঠেছে তবু স্বভাবসুলভ লাজুক মিনমিনে ভাবটি কাটিয়ে ওঠা আজও পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠেনি তার পক্ষে। চাচি যখন খেতে দেয় তখনই খায়। তবে দিন যত যায়, ভেতরে ভেতরে কিছু কিছু জড়তা যে কাটে নাÑএমন নয়। ভোক মিটাতে একটু এদিক ওদিক করার গোপন কলাকৌশল সংক্রান্ত কিছু বিষয় আয়ত্ত্বে এসে গেছে তার।

রসুই ঘরের এক পাশে মাটির চুলা। এখানে তিনবেলা এই পরিবারটির নয়-দশ জন লোকের রান্না হয় প্রতিদিন। ধানের দিন আসলে সারাদিন কালিজিরা-লক্ষ্মীবিলাস-কয়রা ধান সিদ্ধ করা, ভাদ্রমাসে কলার পাতার মোড়কে কয়লার আগুনে তালের পিঠা, তিলের পিঠা, সারা বছরের মুড়ি ভাজা, দুই ঈদে সেমাই, মুগডাল-নারিকেলের খিঁচুড়িÑএসব রান্নার ফাঁকে তিনবেলা খাওয়ার রান্না চলছেই। এ বাড়ির চাচি অর্থাৎ রহিমা বেগম ভালো রাঁন্ধুনি। তিনি মানুষ খাওইয়া আনন্দ পান। তার রান্না ও মানুষ খাওয়ানোর সুনাম এ বাড়ি ও বাড়ি ছড়ানো। মহররমের সিন্নি রাঁনতেও চাচির ডাক পড়ে। তিনি হাত না দেয়া পর্যন্ত সিন্নির স্বাদ কেউ পায় না। বিশেষ করে গভীর রাত পর্যন্ত এই বাড়িতে পিঠা বানানোর আয়োজনে রফিককেও থাকতে হয়। মুগপাকান পিঠা করতে চাচি বড় বড় খেজুর কাঁটা বা নারিকেল তেল মাখানো পোড়ামাটির খাঁজ ব্যবহার করেন। তাঁর প্রতিটি পিঠা দেখতে সোন্দর। সেই রাতে মুগপাকানো পিঠার সুগন্ধে গাছগাছালিতে ঢাকা এই বাড়িতে ভূতেরাও আসেÑএইরকম চিন্তা রফিক করে থাকে। তখন সে টুকটাক ভয়ও পায় কল্পনার ভিতর।

রান্নায় জ্বাল দেয়া, এটা সেটা বটি দা’য়ে কুটে দেয়া, বাড়ির পুকুরে চাল ধোয়া, মাছ ধোয়া, সোডা পানিতে বছরে একবার পুরান কাপড়-চোপড়, কাঁথা-মশারি সিদ্ধ করে পুকুরের কাঠের পিছলা ঠ্যাঙ্গায় আছাড় মেরে মেরে কাচানোÑএসব কাজ সে ভালোই করে। কাম করে আর ভাবে, চাচি কখন খাওন দিব! চাচি খাওন নিয়া কখনও সমস্যা করে না। বড় ভালো মানুষ।

এ বাড়ির গিন্নি রহিমা বেগমকে সে ডাকে ‘চাচি’ বলে ডাকে। চাচি’র ছেলেমেয়েরাও প্রায় তার সমবয়সী। কামের লোক হলেও, রফিকের সঙ্গে এ বাড়ির লোকেদের ব্যবহার স্বাভাবিক। বরং আদর যতেœর খুব একটা কমতি করে না এরা। এদের ভালো ব্যবহারের কারণেই দেখতে দেখতে বেশ ক’টি বছর কেটে গেল খাঁ বাড়িতে। কোন দিক দিয়ে গেল সে টের পায় নাই। প্রথম প্রথম ভুল করে নিজের মা’র স্মরণে রহিমা চাচিকে আচানক ‘মা’ ডেকে ফেলে কতবার আহাম্মকি করেছে সে। তারপর নিজের জিহ্বায় দাঁত চেপে শরমিন্দা হয়েছে। তবে এ নিয়ে কেউ তাকে কিছু বলেনি। চাচি শুধু অল্প হেসেছেন। চাচি’র স্বভাবে দয়ার পরিমাণ খুব বেশি।

দুই ঠ্যাং পোড়া এক ঠু-া কালা বেডি-ফকিরনী কোত্থেকে আইস্যা কইল, কই গো রাজকপালি মা জননী, দুগ্গ্যা পান্তাভাত দেন গো মা! কোন গ্রাম থেকে যে ঠু-ি বেডি ভিক্ষা করতে আসে কেউ তার ঠিকঠিকানা জানে না। ওয়াপদার রাস্তা দিয়া বিশেষ ছন্দে যখন হাঁটে তখন পোলাপান কয় ওই যে ঠু-ি আইয়্যে! চাচি’র রসুই ঘরে বসে ঠু-ি বেডি ইলিশ মাছের জ্বাল দেয়া তেলতেল ঝোলের সঙ্গে কা-াকু-া আর হলদে-রঙ ইলিশের ডিম দিয়া ভাত খায়। পান খায়। ঢক ঢক কইরা এক মগ কলের ঠা-া পানি খায়। শেষে চিমসানো ঠোঁট চিবিয়ে চিবিয়ে কয়, ও জননী, ফিতরার টাকাডা রাইখ্যেন গো! ঈদের দিন আমু। আল্লায় আফনেরে আরো দিব গো আম্মাজান! তারপর ‘আল্লামাবুদ’ বলে দীর্ঘ একটা শ্বাস বার করে দিয়ে নাকে লটকানো ময়লা-ধরা কালসে রূপার নাকবালী নেড়ে নেড়ে টুনটুন করে হেঁটে যায় দুই ঠ্যাঙ-পোড়া-আঙরাÑঠু-ি।

আরেক বেডি আইয়্যে য্যান ভাজা মাছ উল্টাইয়্যা খাইতে জানে নাÑএমনই তার মিচকি ভঙ্গি। চাচি সেদিন বানাইতেছিলেন লাল আটার রুটি। পাশে রফিক আলু কুঁচিকুঁচি করছিল আর চুলায় জ্বাল ঠেলে দিচ্ছিল। বিহান বেলা গোলগাল কোমর বাঁকা সেই ফকির বেডিরে দেইখ্যা রফিকের রাগ হয়। কিছুক্ষু কাপড় মুখে দাঁড়াইয়্যা রুটির দিকে তাকাইয়্যা মিচকি বেডি কয়, দিবেননি গো খালা, একখান লুডি? হ খালা আঁই গরম গরম লুডি খাইতে ভালোবাসি!

কথা শুইন্যা রফিকের ইচ্ছা হয় বেডির মাথায় বটি দাও দিয়া ঠাস কইরা একটা কোপ মারতে। সে মনে মনে কয়, হ তোরে দিমু লাল আডার লুডি! যা ভাগ মাতারি!

চাচি’র জন্যই কিছু করা যায় না। চাচি কিচ্ছু না কইয়্যা বেডিরে দুইখান গরম গরম লাল আটার রুটি দিয়া দিলেন। সে মাটিতে পাছা ঠেকাইয়্যা বইয়্যা কয়, ও খালা, এট্টু আলু ভাজা দেন। খালি লুডি ক্যামনে খামু খালা!

তারপর চোখ গোল গোল কইরা যতদূর সম্ভব গরম ধোঁয়া-ওড়া হলুদাভ আলু ভাজার দিয়ে চেয়ে থাকে যেন কোনওদিন সে আলুভাজা চোক্ষে দেখে নাই। বেডি কি আলু বাজা দেখে না চাচি’র আলুভাজার উপর ফালি করে কাটা লাল টমাটুম দেখে কে জানে! এসময় রফিক কটমট কইরা বেডির মুখখান দেখে। তার লোভটা কোনদিকে বেশি সেই পাল্লার ওজন বোঝার চেষ্টা করে। ভেতরে তার রাগ ওঠে। কামের বেলায় নাই, খাওনের বেলায় ওস্তাদ। বদমাইশ।

উদাম গায়ের মাইট্টা হাফপ্যান্ট পরা ছেলে রফিক, এখন রুহিতপুরী লুঙ্গি পরে গরুর জন্য ঘাস আনতে যায়। কখনও বা কোসা না’য়ে ডাকাতিয়া নদী পেরিয়ে দূরের চরমেশার চরের দিকে যায়Ñগরুর জন্য কচুরি কেটে আনতে। যেখানেই যায়, ভোকও কোঁড়ৎ কোঁড়ৎ করে তার সঙ্গেই যায়। ভোক কি চিনা জোঁক! না’য়ের ছোট বৈঠায় চাপ দিতে দিতে সে সিদ্ধান্ত নেয়Ñএ এক বিরাট সমস্যা। বর্ষার পানি কমে এলে অল্প পানিতে ডুবে থাকা চরে প্রচুর শালুক পাওয়া যায়। সে কচুরি কাটা বাদ দিয়া শালুক আর পানিফল তুলে পেট ভরায় আগে। তারপর নিজের কামে মনোযোগ দেয়। খাওয়ার ভাষাহীন চিন্তা ছাড়া রফিকের জীবনে আর কোনও স্বপ্ন-বাসনা নাই।

মাঝে মাঝে ক্ষুধায় তার চোখের গর্ত থেকে মার্বেলের মতো চোখ দু’টি বার হয়ে আসে। শরীরের রঙ কুঁচকুঁচে কালো বলে সেই বার হয়ে আসা গোল গোল চোখ যারপরনাই দৃশ্যমান হয়ে উঠলে রহিমা বেগম বলেন, কি রে তোর কি ভোক লাগছে? যাঃ! টিনের থন উরুম নিয়া নাইকল মিডাই দিয়া খা, যাঃ!

উরুম তার ভাল লাগে না। উরুম চাবাইতে চাবাইতে খালি গলা শুকায়। পানির ঠিল্লা ভইরা দিলেও গলা ভিজে না। ইহলোকে উরুম বড়ই বাজে খাদ্যবস্তুÑঅখাদ্যÑএরকমই তার ধারণা-সিদ্ধান্ত। তবু চাচি’র দরদমাখা কথায় সে কোঁচ্চা ভইরা উরুম আর আখের গুড় নিয়া কামে মন দেয়। কখনওবা পুকুরের পাড়ে চাচিদের বুড়ি আম গাছটার তলে বইস্যা কুরকুর কইরা উরুম খায়। আর পুকুরের কালো পানিতে সাঁতরানো একঝাঁক চক্কুণি মাছের দৌড়াদৌড়ি দেখে। সামান্য ঢিল ছুঁড়লে বা বাতাসে চক্কুনি মাছের দল তাদের গোল চোখ বার করে অবাক বিস্ময়ে ফুড়ুৎ করে ডুব মারে। তারপর আবার ভেসে ওঠে ঘাটে-বসা রফিককে দেখে। তখন রফিক ভাবে, মানুষ চক্কুনি মাছ খায় না কী কারণে! কামের অবসরে সে, রফিক এবাড়ির পোলাপানের সঙ্গে বর্শিতে চক্কুনি বা গুঁড়া ইঁচা মাছ গেঁথে কচুরির তলে ঠা-া পুকুরের মেনি মাছ ধরে।

একশ’ হাজার কাম করলেও এই বাড়ির বুইড়াÑকুট্টি হাজী’র টিটকারি থেকে রেহাই পায় না রফিক। তিনি চাচি’র শ্বশুর। ছেলে-মেয়েদের দাদা। সেও দাদা’ই ডাকে। বুইড়ার বুড়ি নাই। কোন সত্যকালে মইরা গেছে কে জানে! দাঁত-নাই-বুড়া সারাদিন পান চাবায়। য্যান গরু ঘাস খায়, জাবর কাটে। আর বই পড়ে। বুড়া মানুষÑএ্যাতো বই পইড়া কী অইব আল্লাই জানে! দুইদিন পর যাইব মইরাÑদুই ঠ্যাং কবরে! বুড়া অইলে কি অইবো, বজ্জাত কম না। সুযোগ পাইলেই তার দোষ ধরে, খাওন নিয়া মশকরা করে, চেহারা-চুরুত নিয়াও ইয়ার্কি-ঠাট্টা করে। তার চেহারা কালা, মুখে বসন্তের খাঁজকাটা দাগ। চেহারা কি মানুষ নিজে বানায়? বসন্ত রোগ কি ইচ্ছা কইরা অয় কারো! সুতরাং বুড়া কুট্টি হাজী’র উপর তার একটা অন্তর্গত রাগ-হিংসা কাজ করে।

(চলবে)

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়