প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
বাবা দিবসের অঙ্গীকার
আবহমান গ্রামবাংলায় আমরা বাবাকে আব্বা বলেই ডাকতাম। অবশ্য হিন্দু ধর্মের বন্ধুদের দেখতাম বাবাকে বাবা বলে সম্বোধন করতে। এরপর শহরে এসে দেখি আব্বা হয়ে গেছেন কখনও আব্বু, বাবা আবার কখনও বা ড্যাডি। আমাদের আব্বা ছিলেন একেবারে আটপৌরে গ্রামীণ মানুষ। দাদার অকাল মৃত্যুর কারণে তৃতীয় শ্রেণির পর নিজের পড়াশোনাটা আর চালিয়ে নিতে পারেননি। পরিবারের বড় ছেলে হওয়াতে এরপর ধরতে হয়েছিলো সংসারের হাল। এরপর কালের পরিক্রমায় শুরু করেন নিজের সংসার।
|আরো খবর
আমি বড় ছেলে হওয়াতে আব্বার সংগ্রামের অনেকটাই দেখেছি। আমিও ছিলাম সেই কঠিন সময়ে আব্বার সহযোদ্ধা। এবং সেটা নিয়ে লিখেছিলামও। আজকে আব্বার যে গুণটা নিয়ে লিখবো, সেটা আমি শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত নির্বিশেষে খুব কম বাবার মাঝেই দেখেছি। আমাদের আব্বা হচ্ছেন আমাদের তিন ভাইয়ের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আরও সহজ করে বললে অনেকটা বড় ভাইয়ের মতো। আমরা তাই মাঝেমধ্যে মজা করে আব্বাকে বড় ভাই বলেও ডাকি।
গ্রামের ছেলে বলেই আব্বার বিড়ি খাওয়ার নেশা ছিলো। আমি ছোটবেলায় দেখেছি আব্বা ধূমপান করেন। কিন্তু বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে দেখলাম আব্বার বিড়ির নেশাটা আর নেই। দুটো কারণে এটা হতে পারে। প্রথমত, বিড়ি কেনার মতো বিলাসিতা করার আর্থিক সামর্থ্য ছিলো না। দ্বিতীয়ত, আমাদের তিন ভাইয়ের কথা চিন্তা করে। যাই হোক, আব্বার যেহেতু ধূমপানের অভ্যেস ছিলো না, তাই আমরাও আর ঐদিকে পা বাড়াইনি। আমাদের সমসাময়িক অনেক বন্ধুকে দেখেছি বিভিন্ন উছিলায় ধূমপায়ী হয়ে যেতে।
গ্রামের মানুষ বলেই আব্বা দুর্দান্ত তাস খেলতে পারেন, হোক সেটা রাশিয়ান ব্রিজ কিংবা ম্যারিজ। আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় আব্বা তার খালাতো, মামাতো ভাইদের সাথে মুদির দোকানে বসে তাস খেলতেন আর আমাদেরকে পাহারায় রাখতেন, কখন ওই রাস্তা দিয়ে উনার নানা (আমাদের বড় আব্বা) আব্বাস আলী মন্ডল আসেন। বড় আব্বাকে দেখলেই আমরা ইশারা দিতাম। তখন উনারা তাস লুকিয়ে ভদ্রলোক হয়ে যেতেন।
বড় হয়ে উঠার সাথে সাথে আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যেও তাস খেলার বহুল প্রচলন দেখা দিলো। আমি বুয়েটের ড. এমএ রশীদ হলে থাকি। আমার বিছানায় নিয়মিত তাসের আসর বসে। সেখানে নিয়মিত ম্যারিজ খেলা হয়। মেজভাইটা কুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলে থাকে। সেখানেও একই অবস্থা তারও। এরপর একসময় আমাদের ছোট ভাইটাও বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেলো এবং সিট পড়লো রশীদ হলে আমারই পাশের কক্ষে। তখন আমাদের তাসের আসরে সেও শামিল হয়ে গেলো। কিন্তু আমরা সবসময় একটা নীতি অবলম্বন করতাম। সেটা হলো, আমরা কখনোই টাকা দিয়ে তাস খেলতাম না, যেটাকে বলে জুয়া খেলা।
এইভাবে আমাদের বিভিন্ন আসরে আমাদের তিন ভাইয়ের বন্ধুরাও জুটে গেলো। এরপর আমরা যখনই তিনজন একসাথে কুষ্টিয়া যেতাম, তখন বাড়িতে একসাথে একের অধিক সেট তাসও আমাদের সাথে হাজির হতো। এরপর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিন ভাইয়ের বন্ধুরাও এসে পড়তো। তখন আমরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ম্যারিজ খেলে সময় পার করতাম। অনেকসময় দেখা যেতো, কয়েকটা দল হবার পর শেষের দলে একজন খেলোয়াড় কম পড়েছে। তখন আব্বা সেই দলে যোগ দিয়ে দল পূরণ করতেন।
এছাড়াও বেশির ভাগ সময় আমরা তিন ভাই এবং আব্বা মিলে তাস খেলতাম। তখন আমি আর ছোট ভাইটি হতাম পার্টনার আর আব্বা এবং মেজো ভাইটি হতো পার্টনার। আব্বা এবং মেজো দুজনেই অনেক হিসেবি খেলোয়াড়। তারা তাসের প্রত্যেকটা চাল দিতেন অনেক হিসেব করে। কিন্তু তাস শুধু হিসেবের খেলা না। এটা অনেকটা ভাগ্যনির্ভর খেলাও। আমি আর ছোট ভাইটা তেমন ভালো খেলোয়াড় না। তাই বোধহয় আমাদের অনেক ভালো তাসের হাত পড়তো। তাই আব্বা এবং মেজো ভাইটি হিসেব করে চাল দিয়েও শেষমেষ আমাদের কাছে হেরে যেতেন।
হেরে যাওয়ার পর মেজো ভাইটা রাগে গজগজ করতো আর বলতো, সে তার হলের তাস খেলার চ্যাম্পিয়ন। আব্বা কিছু বলতেন না, শুধু মুচকি হাসি দিতেন। আর এদিকে মা বসে বসে রাগ করতেন আর আমাদের তাসের আসরে খাবারের জোগান দিয়ে যেতেন। মাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, বুড়ো মানুষ; ছেলেপেলেদের সাথে বসে তাস খেলে। এগুলো শুনেও আব্বা তার চিরপরিচিত মুচকি হাসি দিতেন। তাই তাস খেলার জন্যে বা বিনোদনের জন্যে আমাদেরকে তেমন কোনো লুকোছাপা করতে হতো না।
আমাদের বাড়িতে তখনও বিদ্যুতের সংযোগ আসেনি। সন্ধ্যা হলেই আমরা দুভাই হারিকেনের আলোয় টেবিলে পড়তে বসি। পড়া শেষ করে রাতের খাবার খাওয়া হলে একটু টেলিভিশন দেখা চাই আমাদের। তখন আমাদের পাড়াতে একমাত্র টেলিভিশন ছিলো প্রতিবেশী সালামদের বাড়িতে। সেটা ছিলো ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সাদাকালো একটা টেলিভিশন। খাওয়া শেষ করেই আমরা দুই ভাই বিভিন্ন অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হতে চাইতাম। কিন্তু মায়ের বকুনির ভয়ে আমরা সাহস পেতাম না। তখন আমরা বলা শুরু করতাম সেদিন টেলিভিশনে কোন্ অনুষ্ঠানটা দেখাবে এবং তাতে কারা কারা অভিনয় করবেন এবং বিষয়বস্তুই বা কী। কারণ আমরা আশা করতাম, আমাদের আলোচনা শুনে আব্বাও টেলিভিশন দেখতে যাবেন। তখন তার সাথে সাথে আমরাও যেতে পারবো।
এভাবেই আমরা রাত জেগে তখনকার দিনের টেলিভিশনের আনন্দময় অনুষ্ঠানগুলো দেখতাম। সেসব অনুষ্ঠান রাত দশটার ইংরেজি সংবাদের আগেই শেষ হয়ে যেতো। তখন আমরা বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়তাম। মা রাগে গজগজ করতে করতে দরজার খিল খুলে দিতেন। টিনের চৌচালা ঘরের মাঝে সিমেন্টের বস্তার বেড়া দিয়ে দুটো কক্ষ তৈরি করা হয়েছিলো। একটাতে আমরা দুভাই ঘুমাতাম আর অন্যটাতে আব্বা, মা আর ছোটভাই ঘুমাতেন। মাঝের বেড়ার মধ্যে একটা ছোট ছিদ্র করা হয়েছিলো। সেটা দিয়ে হাত বাড়িয়ে উনাদের ঘর থেকে আমাদের ঘরে খিল দেয়া এবং খোলা যেতো।
যতদূর মনে পড়ে, রোববার রাত দশটার ইংরেজি সংবাদের পর ‘হারকিউলিস’ নামে একটা ইংরেজি সিরিয়াল প্রচার করা হতো। সেই সিরিয়ালের নায়কের অসম্ভব ক্ষমতা আমাদেরকে চুম্বকের মতো টানতো। কীভাবে এই অনুষ্ঠানটার খোঁজ পেয়েছিলাম সেটা আর এখন মনে নেই। কিন্তু আমরা একেবারে ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেই সিরিয়ালের। সমস্যা হচ্ছে, অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকা এবং আব্বাকেও জাগিয়ে রাখা। আর দশটার ইংরেজি সংবাদ প্রচারের আধা ঘণ্টা সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা। সেখানেও আমরা সফল হতাম। সেদিন রাতে খিল খুলে দিতে দিতে মা আব্বাকে নিয়ে সেই একই কথা বললেন : বুড়ো মানুষ ছেলেদের সাথে মিলে টিভি দেখে বেড়ায়।
এভাবেই শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পদার্পণ করলাম। ইতিমধ্যে আমি বুয়েটে ভর্তি হয়ে গেছি, কিন্তু ক্লাস শুরু হতে দেরি আছে। তাই ভাবলাম অবসরটা কুষ্টিয়াতে থেকে টিউশনি করে কিছু টাকা জমাই। নতুন নতুন ঢাকাতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। এক বাসায় টিউশনি করতে যেয়ে মাত্রাতিরিক্ত খাতির পেতে শুরু করলাম। অভিভাবক আমাকে দুই বেলায় পড়াতে বললেন। নাস্তাতে একগাদা খাবার দেন। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, পারলে তিনি আমাকে সারাদিন তার বাসায় রেখে দেন। এইসব ঘটনা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হওয়াতে আব্বাকে একদিন সব খুলে বললাম। শুনে আব্বা বললেন : ‘ওই পরিবারের ইতিহাস কিন্তু মারাত্মক। ওদের সব মেয়ের বিয়ে হয়েছে গরিব মানুষের মেধাবী ছেলেদের সাথে’। তখন বুঝলাম আমি তাদের পরবর্তী শিকার হতে যাচ্ছি। এরপর আর সেই টিউশনিটা চালিয়ে নিইনি।
এভাবেই আব্বা ছিলেন আমাদের সব কাজের ঢাল। পরবর্তীতে ইংরেজি শেখার পর জানলাম এই বিষয়টাকে বলে--আই গট ইউর ব্যাক। আব্বা সকল পরিস্থিতিতে বন্ধুর মতো আমাদেরকে সহায়তা করেন। এখনও অনেক বিষয় মায়ের সাথে আলাপ করতে ইতস্তত করলেও আব্বাকে বলে ফেলি নির্দ্বিধায়। বর্তমানের দুনিয়ায় আমাদেরকে দ্বীপের মতো মানুষ হবার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার পরিবর্তে নিজের সচ্ছলতা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সুখের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সবাইকে নিয়ে থাকার মধ্যে যে বিরাট শিক্ষা নিহিত সেটা থেকে আমরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি। এভাবেই নিজেদেরকে ভালো রাখতে গিয়ে আমাদের বাচ্চারাও একসময় আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এইসব গল্প যখন আমি আমার পরিচিতজনদের সাথে ভাগ করি, তখন তারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই সময়ে এখন সবকিছুই এখনকার বাচ্চাদের হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিচ্ছে। সেখানে ভালো এবং মন্দের মধ্যে ফারাক বোঝা খুবই কঠিন। সেক্ষেত্রে আব্বা মায়েরা হতে পারেন বাচ্চাদের সবচেয়ে বড় গাইড। কিন্তু যেহেতু আব্বা মায়েরা কখনওই বাচ্চাদের বন্ধুর আসনে বসতে পারেন না, তাই তারা তাদের সাথে সব বিষয় সহজে ভাগ করে নিতে পারে না। আর তখনই তারা ভুল পথে পা বাড়ায়। আব্বারা যদি অভিভাবকের পাশাপাশি বাচ্চাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে তাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে যেতো।
অস্ট্রেলিয়াতে প্রতিবছর বাবা দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রোববার। এদিনটাকে সামনে রেখে সন্তানেরা তাদের বাবাদের জন্যে অনেক ধরনের আয়োজন করে। সেখানে উপহার থেকে শুরু করে খাওয়া সবই থাকে। প্রবাসের নতুন পরিবেশে বাবা-মাকে একসাথে অনেকের রোল প্লে করতে হয়। কারণ প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম দেশে ফেলে আসা আত্মীয়স্বজনের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই বাবা যদি তার সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে বাবা যেমন একজন সঙ্গী পাবেন, সন্তান পাবেন তার ভবিষ্যৎ পথচলার নির্দেশনা। বাবা দিবসকে সামনে রেখে তাই আসুন আমরা নিজ নিজ সন্তানের সাথে বন্ধুত্বভাবাপন্ন সহজ, সাবলীল এবং সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলি।
মোঃ ইয়াকুব আলী : মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।