রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

অমৃতের কারিগর

অমৃতের কারিগর
সুমন্ত সাহা

বিদেশে বসে কাঁচা কাঁচা ঘাস পাতা চিবুচ্ছি যখন, ছোটবেলাটা তখন মনে পড়ে খুব। আমাদের ছোট্ট শহরের ঠিক পাশ দিয়ে ঝিরিঝিরি করে বয়ে যেত একটা ছোট্ট নদী। নদীটার নামটা মোটেই ছোট্ট ছিল না। বরং ছিল বেশ রাশভারী। আড়িয়াল খাঁ। সেই ছোট্ট নদী দিয়ে চলতো ততোধিক ছোট্ট ছোট্ট লঞ্চ। ছোট বেলায় তো আর লঞ্চের ছোট-বড় বুঝতুম না, তখন যা দেখতাম তা-ই ভাল লাগতো। সেই ছোট্ট লঞ্চগুলোর মধ্যে দুটো লঞ্চ ছিল আমার অনেক বেশি পরিচিত। সেই দুটো লঞ্চে করেই আমরা দাদুবাড়ি যেতাম। দাদুবাড়ি বলতে মায়ের বাবাবাড়ি। দুটো লঞ্চই মোটামুটি এক রকম দেখতে। কাঠের বডি, নিচতলায় খোলা ডেক। ওপর তলায় লঞ্চের মাস্টার কেবিন, অন্যান্য ক্রুদের থাকার জায়গা, আর সেই সাথে গোটা দুয়েক যাত্রী কেবিন।

দাদুবাড়ি ছিল মোটামুটি বেশ দূরে। সাথে যখন যোগ হতো ছোট্ট লঞ্চগুলোর ঢিমাচাল, তখন যেতে সময় লাগত অনেকই। বেশিরভাগ সময়ই আমরা কেবিনে করে যেতাম। কেবিনগুলো ওপরতলায় ছিল। লঞ্চের সারেং, মাস্টার ইত্যাদি লোকজনের সাথে দেখা হতো হরদম। একটা লঞ্চের নাম ছিল কামপালা। কেন এখন আর মনে নেই, কামপালার সারেঙের চোখগুলো ছিল বিশাল গোল গোল আর লাল। দেখলেই আমার গল্পের বইয়ে পড়া বিভিন্ন ভূতুড়ে চরিত্রের কথা মনে পড়ে যেতো। বাবা-মা আমাকে সেই সারেঙের ভয় দেখিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারতেন। তুলনায় মুলতান, যেটা ছিল আরেকটা লঞ্চের নাম, ছিল অনেক কম ভয়ংকর। যে কারণে প্রতিবার দাদুবাড়ি যাবার সময় কামপালায় না গিয়ে মুলতানে যাবার জন্য আমার আবদারটা থাকতো অনেক বেশি।

তখনও দেশটা এত বেশি ভেজালে ভরে যায় নি। নদীগুলোর পানিও পানির মতই ছিল, কালো তেল ভাসতো না। সেইরকম টলটলে নদীর জলে ভাসতে ভাসতে, আশেপাশের গ্রাম-গঞ্জ, পাখণ্ডপাখালি দেখতে দেখতে, লঞ্চের লাল টকটকে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে খেতে দিনখানেক পর আমরা গিয়ে হাজির হতাম দাদুবাড়ির লঞ্চঘাটে। দাদুবাড়ির লঞ্চঘাটটা বেশ জমজমাট, বড়সড়। অনেক লঞ্চ, জাহাজ, নৌকা দিয়ে ভর্তি। বিশাল নদী, তার একুল থেকে ওকুল দেখা যায় না। সেই নদীর মধ্যে খেলনার মত ছোট ছোট নৌকা ভাসতে থাকে। তার রঙ বেরঙের পাল। সবচে’ মজার লাগতো মালবাহী নৌকাগুলো। অসম্ভব ধীরগতিতে চলা এই নৌকাগুলো দেখলে মনে হতো এখুনই ডুবে যাবে। নৌকার পুরা খোলটাই ভরা থাকতো বালি বা অন্য কোনো কিছু দিয়ে। দুই পাশ দিয়ে জল নৌকার পাটাতন ছুঁই ছুঁই করে থাকতো। নৌকায় থাকবার জায়গা বলতে একটা ছোট্ট ঘরের মত। তাতে হয়তো এক দু জন মানুষ থাকতে পারে। সব সময় দেখতাম একজন হাল ধরে বসে আছে, আর অন্য আরেকজন হয় জল সেঁচে ফেলছে অথবা রান্না করছে, অথবা স্নান করছে। অতটুকু নৌকার মধ্যেই ওদের জীবন। হয়ত সেই সুদূর কোনো বন্দর থেকে ঢাকা চলেছে, অথবা অন্য কোথাও। ছোটবেলায় আমার এই নৌকাগুলো আর এই মাঝিদের জীবন অনেক ভাল লাগতো কেনো জানি। মনে হতো, এ রকম আরাম করে আস্তে আস্তে ভেসে চলে যেতে পারলে মনে হয় খারাপ হয় না।

বিশাল নদীটা থেকে একটা ছোট শাখা নদী ঢুকে গেছে শহরের ভেতর। সেই শাখা নদীর পাশ ঘেঁষে আঁকাবাঁকা চিকন পথ ধরে, বিভিন্ন ছোটবড় পুকুর দিঘির পাশ দিয়ে, রিকশার টুংটুং করতে করতে আমরা পৌঁছে যেতাম দাদুবাড়ি। পথে পড়তো বিউটি স্টোর আর লাভলী স্টোর নামে দুই চিরন্তন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, যেগুলো এখনো টিকে আছে। ভর্তি থাকতো নানা রকম জিনিসপত্র এবং বিশেষত খেলনায়। সাথে বর্ডারের কাছাকাছি থাকার দরুণ বিভিন্ন ভারতীয় জিনিসে। পড়তো কালীবাড়ির মোড়, আর সেখানে 'ওয়ান মিনিট' নামের এক বিখ্যাত মিষ্টির দোকান। সেই দোকানে সেই প্রায় দুই দশক আগে থেকে পাওয়া যাচ্ছে সফটি আইসক্রিম। তখন অবশ্য এতো সফটি মফটি বুঝতাম না। তখন সেটা ছিলো দুনিয়ার সেরা কোন-আইসক্রিম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই গত বছর গিয়েও সেই দোকানে সেই কোন-আইসক্রিম পেয়েছি। সেই একই মেশিন থেকে একইভাবে একই স্বাদের। হয়ত এখন আরও অনেক ভাল স্বাদের আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু ছোটবেলায় কেন ওই আইসক্রিম এত পছন্দ ছিলো, তা বুঝতে কষ্ট হয়নি এতটুকুও। তারপর আরেকটু এগিয়ে আমাদের টুং টুং রিকশা পৌঁছে যেত জোড় পুকুর পাড়। পাশাপাশি দুটো পুকুর, তার পাশ দিয়ে রাস্তা। সেই জোড় পুকুর নামটা রয়ে গেছে এখনো, কিন্তু কালের বিবর্তনে পুকুরগুলো ভরাট হয়ে উঠে গেছে, গড়ে উঠেছে নানা ধরনের বিল্ডিং। সেই জোড় পুকুর পাড়ের নিকটে ছিল (এখনো আছে) বেগম ইন্ডাস্ট্রিজ নামের এক স্টিলের আলমারির দোকান। যাদের তৈরি আলমারি মনে হয় আমাদের শহরের বেশিরভাগ বাড়িতে আছে। সেই বেগম ইন্ডাস্ট্রিজ পার হয়ে একটা অনেক উঁচু পুলের ওপর দিয়ে (যেটায় ওঠার সময় রিকশা থেকে একজনকে নেমে যেতে হতো) পৌঁছে যেতাম বাড়ি। পৌঁছে দেখতাম বেশ একটা আয়োজন আয়োজন ভাব। নাতি, মেয়ে, জামাই এসেছে। চারিদিক রান্নার গন্ধে মৌ মৌ করছে। আর সাথে চলছে বান্দর আমার থেকে কীভাবে জিনিসপত্র রক্ষা করা যায় তার সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা।

দাদুবাড়ির কথা চিন্তা করলেই মনে পড়ে ছাদের কথা। পৌঁছেই দৌড় দিয়ে চলে যেতাম ছাদে। দাদুদের ছাদ ছিল ফুলে ফুলে ভরা। আমার ছোটমামার ছিল সেইরকম বাগানের শখ। তাঁর হাতে যাই পড়তো, তা-ই মনে হয় সোনা হয়ে ফলতো। বাগান ভর্তি ছিল বিশালাকৃতির সব গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, বেলী, আর অসংখ্য নাম না জানা ফুলের সমাহার। তবে ছোট্ট আমার আগ্রহ ফুল নিয়ে যতোটা না ছিল, তারচে’ বেশি ছিলো ছাদের ওপরের জলের ট্যাংকি নিয়ে। তখনো এইসব গাজী ট্যাংকের জামানা আসেনি। জলের ট্যাংক ছিল পাকা। ছাদের ওপর আরেক তলা সমান উচ্চতায় ছিল ভাঁড়ার, তার ওপর ট্যাংক। সব মিলিয়ে ছাদের ওপর প্রায় দোতলা উচ্চতা। কোনো রেলিং তো নেইই, উপরন্তু কোনো সিঁড়িও নেই। লোহার রড দিয়ে বানানো একধরনের মই বেয়ে উঠতে হতো। সেইটাই ছিল প্রধান আকর্ষণ। সেই মই বেয়ে অনেক কসরত করে ট্যাংকির ওপর উঠলে দূরে দেখা যেতো সেই ছোট্ট শাখা নদীটা। আর পাওয়া যেতো ফুরফুরে বাতাস। আর ট্যাংকির ঢাকনা খুলে তার ভেতর কথা বললে চমৎকার প্রতিধ্বনি হতো। ওখানে বসে কাটিয়ে দিয়েছি অনেক সময়। এখন চিন্তা করলে মনে হয়, আমাদের বাবা-মা সাহসী ছিলেন অনেক। এই রকম বাচ্চা কাচ্চাকে এতো অ্যাক্রোব্যাটিক ধরনের কাজ কর্ম করতে দেখলে এখনকার বাবা-মা মনে হয় ভয়েই মরে যেত।

দাদুর খাটটা ছিল সেই ছোট আমার জন্যে অনেক উঁচু। রীতিমত সার্কাস করে খাটের ওপর উঠতে হতো। কিন্তু সেটাই ছিল আমার আরেক প্রিয় খেলা। সারা বাড়ি দৌড়ে এসে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে দাদুর খাটে উঠে বিছানার বারোটা বাজানো, আর দাদুর সাথে মারামারি করা। সেই সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠেই স্নান করে দাদু রেডি হতেন ঠাকুরঘরে যাবার জন্যে। সেই সময় দাদুকে যন্ত্রণা দিয়ে বড় আনন্দ হতো। কিন্তু যন্ত্রণা, মারামারি, আর দাদুর সাথে খেলা যতোই করি দিনের বেলা, রাতে দাদুর সাথে ঘুমাতে যাওয়া ছিল একদম অবধারিত। দাদুর ছিলো অফুরন্ত গল্পের ভাণ্ডার। ঘুমুতে যাবার সময় দাদুর বুকের ওপর শুয়ে থাকতাম, আর দাদু গল্প বলতে থাকতেন। এক গল্প কখনও দুবার শুনেছি বলে মনে পড়ে না। রাক্ষস-খোক্কস, ভূত-পেতিœ, শাঁখচুন্নি থেকে শুরু করে গোপাল ভাঁড়, রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। কোত্থেকে যে দাদু এতো এতো গল্প প্রতিদিন জোগাড় করতে পারতো, সেটা এখনও চিন্তা করলে অবাক লাগে। ছোট্ট আমার ধারণা ছিলো, দাদুর পেটে একটা গল্পের মেশিন আছে। সেই মেশিন থেকে প্রতিদিন রাতে একটা করে গল্প তৈরি হতো।

দাদুকে নিয়ে আমার স্মৃতি অনেক। কিন্তু সেগুলো তোলা থাক আরেকদিনের জন্যে। এখন না হয় একটু দিদুর কথা বলি। সে সময়কার খুব বাঙালি নারী বলতে যা বোঝায় দিদু বোধহয় ছিলেন সেরকমই। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে নতুন কাপড় পরে পূজোর ঘরে চলে যেতেন। পূজোআর্চ্চা শেষ করে চলে আসতেন রান্নাঘরে সকালের জলখাবার তৈরির জন্য। রান্না ছিল দিদুর প্যাশন। সত্যিকারের শখ, হবি, প্যাশন যা-ই বলি না কেন, সেটা ছিল দিদুর রান্না করা, আর মানুষকে খাওয়ানো। কম কিছু দিয়ে রান্না করা, বা কম করে রান্না করা বলতে যে কোনো জিনিস থাকতে পারে, সেটা দিদুর অভিধানে ছিলো না। যা-ই করতেন, অনেক জিনিস দিয়ে অনেক করে করতেন। দাদুও সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিতেন, কারণ তার ছিল আবার বাজার করার শখ। সেই সক্কাল সক্কাল দাদু দিদুর তৈরি গরম গরম আটার রুটি বা ফুলকো ফুলকো লুচি তরকারি খেয়ে আমার হাত ধরে বাজারে রওনা দিতেন। বাজারে অনেক দোকানিই ছিলো দাদুর পরিচিত, তারাও জানতো দাদুর পছন্দ কী, আর নাতি আসলে কী দিতে হবে।

দাদুদের শহরটা ছিল মাছের জন্যে বেশ বিখ্যাত। প্রচুর মাছ ধরা পড়তো আশেপাশে বিশালাকায় তিনটা নদী থেকে। দাদু আমাকে নিয়ে বাজারে যাবার একটা কারণ ছিলো মাছ মাপ দেওয়া। মাছের দোকানিরা দাদু আর আমাকে একসাথে দেখলেই সেই মাছগুলো বের করতো, যেগুলো লম্বায় আমার চে' বড়। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি। মাছ কেনা শেষে সেই মাছ বাসায় নিয়ে যাওয়া হতো, আর সাথে নেওয়া হতো মাছ কাটার জন্যে লোক। মাছ বাসায় দেখানো হলে তারপর ছাদে বসে চলতো মাছ কাটাকাটি।

যাক, দিদুর কথায় ফেরত আসি। আসলে সমস্যা হলো, দিদুকে নিয়ে আমার সব কথাই হলো খাওয়া সংক্রান্ত। অনেক অনেক ভালো রান্না খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে জীবনে। কিন্তু দিদুর হাতের রান্নার কাছে ধারের কোনো জিনিস এখন পর্যন্ত বোধহয় কোথাও চেখে দেখতে পারি নি। রান্নার ব্যাপারে দিদুর কোয়ালিটি লেভেল ছিল অনেক ওপরের লেভেলের। খুব সাধারণ সাধারণ জিনিস, যেগুলো হয়ত আমরা প্রায় প্রতিদিনই খাই, সেগুলো যে অন্য কোনো রকম হতে পারে হয়তো সেটা আমাদের মনেই হয় না। সেটাই হয়তো দিদুর হাতে পড়ে অসাধারণ হয়ে উঠে। যেমন একটা উদাহরণ দেই। লুচি আমরা অনেকেই ভাজি। মোটামুটি ফুলকোও হয়। দিদুর জন্যে এই ফুলে ওঠাটারও একটা প্যারামিটার ছিলো। যদি লুচি ফোস্কা ফোস্কা হয়ে ফুলতো, তাইলে সেটা ভাল ফোলা না। যদি পুরা বলের মত হয়ে যেতো লুচিটা, তাইলেই কেবল সেটা পাস করতো। একই রকম ভাবে খুব সাধারণ বেগুন ভাজি কতোটা মাখন মাখন নরম হতে পারে, সেটাও দিদুর রান্না খেলেই খালি বোঝা যেত। তবে রান্না ভাল হওয়ার পেছনে কারণও ছিল বটে। কম তেলে ভাজা বা স্বাস্থ্যকর কিছু বানানোর মধ্যে দিদু ছিলেন না। সব কিছুই হতে হবে তেলে ঝোলে একাকার অথবা ক্ষীর ক্রিমে মাখামাখি। সর্বোপরি খুব ধীরে সুস্থে বানানো। কোনো তাড়াহুড়ার ব্যাপার নেই। সবকিছু হতে হবে নিখুঁত।

খুব সাধারণ সব রান্না যেমন দিদুর হাতে পড়লে অমৃত হয়ে উঠতো, তেমনি বেশ কিছু দিদু-স্পেশালও ছিলো বটে। এখন মনে করতে বসলে বেশিরভাগই মনে পড়ে পিঠা পায়েসের কথা। বিভিন্ন পূজা পার্বনে দিদু অসংখ্য পিঠা পায়েস বানাতেন। পিঠা বানানোর ক্ষেত্রেও দিদুর সবকিছু বেশি বেশি দেওয়ার অভ্যাস অবশ্যই বজায় থাকতো। সেই সাথে থাকতো কোয়ালিটি কন্ট্রোল। পাটিসাপটার ভেতরে যে নারকেলের পুরও দেয়া সম্ভব সেটা মনে হয় দিদু বিশ্বাসই করতো না। পাটিসাপটার মধ্যে সবসময় থাকতো বাসায় দুধ ঘন করে বানানো বিশুদ্ধ ক্ষীর। সেই পাটিসাপটা ভাজার সময় যদি একটুও লাল হয়ে যেতো, তাইলেই সেটা কোয়ালিটি কন্ট্রোল ফেল করতো। পাটিসাপটা হতে হবে ধবধবে সাদা পেটমোটা কোলবালিশের মত। আরও কত শত ক্ষীরঘন পায়েস, গোকুল পিঠা, পুলি ইত্যাদি ইত্যাদি। সব নিয়ে বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তবে সবকিছুর মধ্যেই মনে হয় একটা জিনিস ছিল -- প্রচুর দুধ আর প্রচুর ক্ষীর। দিদুর বানানো শুধু তেলে ভাজা পিঠা খুব বেশি খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। দু-একটা ছিল। তার মধ্যে মালপোয়া অন্যতম। সেটাও হতো অসাধারণ মজা। আমরাও এটা মাঝে মাঝে বানানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করি। কিছুই হয়ত হয় না, তাও যা-ই হয়, তা-ই ভাল লাগে। তবে দিদুর কাছেধারে যায় না।

দাদু বাড়িতে পুজোপার্বন হতো ভালই। তার মধ্যে বেশ ঘন ঘন হতো সত্যনারায়ণ পুজো। আমি ছিলাম ছোট, আর বান্দর। দেখা যেত পুরো পুজোর সময়টা বাঁদরামি করে একদম ঠিক সময় এসে ঠাকুরঘরে হাজির হতাম যখন দিদু চরণামৃত বিলি করতেন। এই জিনিসটা তৈরি হতো দই, দুধ, চিনি, মধু, কর্পুর ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু মিলিয়ে। সব সহ জিনিসটা হতো দুধের চেয়ে একটু ঘন, মিষ্টি, আর অদ্ভুত সুন্দর গন্ধওয়ালা একটা জিনিস। সাধারণত সবাই এক চা চামচ করে পেতো। কিন্তু আমি বসে থাকতাম কখন সবার নেয়া শেষ হবে। তারপর পুরো বাটি নিয়ে এক চুমুকে পুরোটুকু শেষ করে দিতাম।

চরণামৃত বিলানো শেষে দিদু বসতেন একধরনের মাখা মাখাতে। সেই মাখার মধ্যে যতদূর মনে পড়ে থাকতো সাগুদানা, কলা, দুধ, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি এবং আরও অনেক কিছু। মাখানো শেষ হলে সবাই পেতো একটা করে গোল বল। সেই মাখানোর স্বাদও ছিল অসাধারণ। সবাইকে দেওয়া শেষ হবার পর সেই মাখার বাটিও চলে আসতো আমার দখলে।

মিষ্টি মণ্ডার কথা অনেক হলো। অবশ্য কারণও আছে। ছোটবেলায় মাছ-ভাত খাওয়ার চেয়ে মিষ্টি মণ্ডা খাওয়ার দিকেই মনোযোগ ছিল বেশি। কিন্তু অন্যান্য রান্নার কথা না বললে দিদুর প্রতি অবিচার করা হবে। সেই যে মাছটা দাদু কিনে নিয়ে এসেছিলেন আমার সাথে মাপ দিয়ে, সেই মাছটা যখন দিদুর হাতে পড়তো, সেটা তখন টেবিলে ফেরত আসতো বিভিন্ন ভাবে। কোনোটা হয়ত বেশ সবুজ সবুজ পাতলা ঝোল দিয়ে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা তরকারি, কোনোটা আবার তেল ভাসা মসলায় মাখামাখি ঝালঝাল ঝোল। সাথে হয়ত আসতো ছোট মাছের, বা আমার সবচেয়ে প্রিয় মাঝারি মাছের (কই, পাবদা) লাল কালোজিরা দেয়া তেল ভাসা ঝোল। সত্যিকারের খাওয়া শুরু করার আগে পাতে পড়তো ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে গাওয়া ঘি, আর কোনো ভাজি। দিদু একটা আলু ভাজি করতেন, যেটার কথা খুব মনে পড়ে। কোনো এক অদ্ভূত উপায়ে দিদু বঁটি দিয়ে আলুকে চুলের মতো কুচি কুচি করতে পারতেন। সেই চুলের মতও সরু সরু আলুকুচি তারপর ডুবা তেলে ভাজা হতো ঠিক সেই পর্যন্ত, যখন আলুগুলো ঝকঝকে সোনালী রঙ ধারণ করতো, কিন্তু এক কুচি আলুও সোনালী থেকে খয়েরি হতে পারতো না। সেই সাথে আলুগুলো হতো সেই রকম মুচমুচে। সেই মুচমুচে আলুভাজি দিয়ে ঘি ভাত খেতে কী যে মজা সেটা না খেয়ে কল্পনা করা কষ্ট।

দিদুকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই আরেকটা জিনিসের কথা মনে পড়ে যায়। সেটা হলো দিদুর সিঁদুরের বাক্স। দিদুর একটা অনেক ব্যবহৃত সিঁদুরের কৌটা ছিল, যেটার মধ্যে সিঁদুরের ডাব্বা, সিঁদুর দেওয়ার জিনিস, আলমারির চাবিসহ আরও হাবিজাবি অনেক কিছু থাকতো। সেই সাথে থাকতো কিছু টাকা। সেই ছোট্ট বেলায় আমার চাওয়াগুলোও খুব ছোট ছোট হতো। হয়তো একটা বেলুন, দুটা লজেন্স, বা মিঠুনের সিনেমা। অন্য কাউকে বলে বেশি লাভ হবে না দেখে আমি গিয়ে দিদুকেই বলতাম। আর অবশ্যম্ভাবীভাবে দিদু বলতেন সিঁদুরের কৌটা থেকে নিয়ে যা। সেই সিঁদুরের কৌটাই ছিলো আমার সকল শখের টাকার উৎস, যখন দাদুবাড়ি থাকতাম। আমার বিশ্বাস, জিজ্ঞেস করা হলে পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ মানুষই বলবে, তাদের সবচে' প্রিয় রান্না হলো তাদের মায়ের হাতের রান্না। আমার মাও খুবই অসাধারণ রান্না করেন। কিন্তু দুঃখিত মা, আমার কাছে আমার দিদুই অমৃতের কারিগর। তোমার জন্যে প্রতিযোগিতাটা খুব কঠিন হয়ে গেছে, কী আর করা। দুঃখ পেও না, তোমারই তো মা।

সুমন্ত সাহা : ফিনল্যান্ডে অবস্থিত গুগল হেডকোয়ার্টারে প্রিন্সপাল আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত; চাঁদপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রয়াত চন্দ্রকান্ত সাহার বড়ো মেয়ের ঘরের নাতি; নিখিল রঞ্জন সাহা-কবিতা সাহা দম্পতির বড়ো ছেলে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়