প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
কে ডাকে
কে যেন আমাকে ডাকে
বারবার ডাকে
হৃদয় দুয়ারে খটখট কড়া নাড়ে
তারপর মিলিয়ে যায় শূন্যে
আমি দরোজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকি
মনের ভেতর আনচান করে পাখি
উড়াউড়ি করে, ঘোরাঘুরি করে
কে যেন আমাকে গোপনে ডাকে!
তার কণ্ঠে রাখা বেহালার সুর
মাতাল করে বাজে, বাজে...
আমি পেছন পেছন ছুটি
ছুটতে ছুটতে হিমালয় চূড়া
গিরিখাদ এবং সাত আসমান
টের পাই কে যেন আমাকে ডাকে
বারবার ডাকে...॥
নগ্ন
রাত্রির কাছে ফিরে যাবো মেয়ে
ফিরে যাবো মৈথুনে, নির্ঘুম জ্যোৎস্নায়
দীর্ঘপথ উড়ে উড়ে
দু দণ্ড দাঁড়াবো নিশ্চুপ
তোমার ঠোঁটের বারান্দা ঘেঁষে একবার
জানি, মহুয়া বনে লেগে আছে গভীর চুম্বন
সাঁইসাঁই উড়ছে প্রেয়সীর অবাধ্য চুল
অথচ অথৈ সাগরে চোখ পেতে দেখি
ভেসে যায় বেহুলার দেহ
সাথে অভাগা লখিন্দর সাপে কাটা
আর কামুক মন আমার
রাত্রির কাছে ফিরে যাবো মেয়ে
ফিরে যাবো মৈথুনে, নগ্ন শুভ্রতায়...
নিয়তি
হাঁটা শেষে পথিক রেখে যায় পদচিহ্ন
তারপর মদের গন্ধের মতো সময় পালায়
আবার নতুন পা আসে
দাঁড়ায়, হাঁটে একই গন্তব্যে
চোখে রোদণ্ডআলো, অন্ধরাতের পাহারা
কণকলতা কিংবা কখনো ছুরি হাতে
ভারি ভারি পা ফেলে
সারি সারি চরণচিহ্ন রেখে
চলে যায় অজস্র পথিক, অগণিত দিন
উড়ে যায় ধোঁয়া হয়ে পলকে পলকে
মানুষ নিঃশেষ হলে পদচিহ্ন থাকে
থেকে থেকে মিশে যায় মলিন ধূলায়।
পরিভ্রম
(স্নেহের নীলিমা রিমিকে স্মরণে রেখে)
অফুরান অবসরে এক এক করে পাতা ঝরে যাচ্ছে
হাওয়ায় দুলছে অলস গল্প, আঙুল থেকে মুছে যাচ্ছে পিয়ানোর পরশ
আমি বসে আছি উদোম, কোনো এক গানে-
শুনে যাচ্ছি ঝাউবন, মায়া বন বিহারিণী...
চোখ পেতে দেখি উচ্ছল এক নদী ফিরছে বাড়ি
বৃক্ষের গায়ে লেগে আছে প্রগাঢ় চুম্বন
আলাদীন গোপন রাখে ইচ্ছের দৈত্য, সমস্ত জাদুবল
আমিও রই গোপনে...
পার হয়ে সিন্ধুনদী, হেঁটে যাই নগরীর কোণে
জনারণ্যের প্রাচীর ভেঙে একলা দাঁড়াই- একা!
কেউ নেই, চারপাশে চৈত্রের মলিন হাহাকার
একটু দূরে এক এক করে অবসরে পাতা ঝরে যায়
আর আঙ্গুলে লেপ্টে থাকে পিয়ানোর পরশ...
পাপ
বৃত্তের চারপাশে পাপ থাকে
বহুবিধ রঙঘরে
লাল-নীল-হলুদ পাপ
ঘিরে থাকে চন্দ্রচ্যুত মন।
সাঁতার জানি না, না ছলাকলা
ডুবে আছি আকণ্ঠ শুভ্র-প্রপাতে
বৃত্তের সীমারেখা পাথর মেনে
ক্ষয়ে যায় হরিণ জীবন!
জল-তৃষ্ণার মরীচিকা শেষে
রাখি শরীর বৃষ্টির নিচে
সমুদয় আলো রাত্রিতে মুছে গেলে
পাপঘরে ছুঁয়ে যায় মন।
প্রজাপতি
একটা প্রজাপতির পেছনে প্রায়ই ঘুরি
আমি উড়তে পারি না
তবে ফুল ভালোবাসি ভীষণ
একদিন প্রজাপতি ডানাগুলো দিয়ে গেলে
দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে খুব ইচ্ছে হয়।
অথচ আমার পা-ভর্তি শেকড়-বাকড়
মাটি ভেদ করে পৌঁছে গেছে পাতালে
চাইলেই কি সবকিছু ছিন্ন হয়?
উড়তে উড়তে একটি জবা ফুলে বসি
গোপন চোখ হঠাৎ কেঁপে উঠলে
সামনে দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চুপ মেয়েটি
সেও আরেক রবীন্দ্রনাথ যেন- কোনো কথা বলে না
তবু হৃদকম্পন তার বেজে ওঠে কানে...
পালিয়ে যেতে মন আনচান করে
প্রজাপতি ডানা মুছে যেতে যেতে
ফিরে আসি মেয়েটির চিবুকের কাছে
সংসার, হাটবাজার, অফিস- আবারও প্রতিদিন
বুকের ভেতর একটা প্রজাপতি তখনো ওড়ে,
অথচ আমি উড়তে পারি না কখনো।
সত্তার রঙ
বৃক্ষ থেকে উজ্জ্বল সবুজ
আর আসমান থেকে মেঘ মেখে
তোমার দুটি ঠোঁটের লজ্জা
অব্যর্থ কিছু দৃষ্টি নিয়ে
আঁকা হবে আজ অনন্ত চুমুক।
মানুষ এনেছে মাতাল রাত্রি
উৎসুক চোখে জ্যোৎস্নার সাজ
যেন ফিরেছে পিকাসোর তুলি
ফিরেছে ভিঞ্চি... এবং
আবার আঁকা হবে মোনালিসা!
বিভ্রম জগৎজুড়ে রঙের জলসা
আঁকি বছর, শতাব্দি, মহাকাল
আঁকি নিজের মুখ অকপটে
আঁকি মুখোশ, সেতার বাজনা...
অন্ধ যেমন চেনে না রঙ
চেনে না প্রভেদ, জ্যোৎস্নার তীর
অবুঝ মানুষ তেমনি ফেরে ঘরে
পড়ে থাকে রঙ এবং জীবন
তারপর সবুজ ফিরে বৃক্ষে, পাতায়
আসমানে ফেরে মেঘ
তোমার দুটি ঠোঁট তোমারি থাকে
উষ্ণতাবিহীন...।
শিল্পী নিহত হলে রঙ মুছে যায়
মুছে যায় জীবন, তীব্র চুমুক...।
চুলের ভাঁজে মেঘ রেখে
দিঘল চুলের ভাঁজে মেঘ রেখে
বৃষ্টি নামাতে চেয়েছি ঝমঝম ইটের শহরে
পাতার গভীর-সবুজে প্রজাপতি মেখে
মনে মনে কত উড়ে গেছি নীল জ্যোৎস্নায়...
শতবর্ষ পর এক সূর্যের দিনে জেগে দেখি
নামেনি বৃষ্টি নগরের দীর্ঘ কোলাহলে
ডানা ভেঙে মরে গেছে নীল প্রজাপতি সেই কবে
পাতারা ফিরেছে ঘরে বহুরাত..
পিপাসার সমুদ্র ঠোঁটে নিয়ে তবু পথ হাঁটি ঠিকানাবিহীন
আর দিঘল চুলের ভাঁজে অবিরাম মেঘ রেখে
বৃষ্টি নামাতে চাই ঝমঝম, ইটের শহরে...
জীবনের কাছে ফেরা
(উৎসর্গ : অমিতাভ রেজা চৌধুরীকে)
সবকিছু ছেড়ে যেখানে ভালোবাসা রেখে যাই
যেখানে গোপন রাখি মাটির শৈশব, মায়া
ফিরে ফিরে আসি ঘুরে ঘুরে আসি প্রতিদিন
শিশির আলোয় রেখে যাই দীর্ঘ দেহের ছায়া।
প্রতিটি ভোরে প্রতিটি চোখে রেখে যাই প্রেম
বৃক্ষের সাথে জড়িয়ে রাখি পাতা, মাছরাঙা ঠোঁটে মাছ
প্রতিটি মৃতের মুখে কথা রেখে যাই, দ্বিধাহীন
নর্তকীর পায়ে রাখি জলের ঘুংঘুর, উন্মাদিনী নাচ।
গাঙুরের জলে ভেসে মিশে যাই, জল হয়ে ঘুরি
ফেরি করি হাসি, প্রাচীন পাথর, প্রিয়সুখ যত
যেখানেই যাই, ভালোবাসা উড়াই মুখে মুখে
জীবন বেঁচে থাকুক মায়ায়, অবিরাম অবিরত...
অকাল চৈত্রদিন
চারদিকে চৈত্র ঝলসানো চোখ
খেয়ালি রোদে খা-খা মাঠ,
অসংখ্য ফাটলে খানখান হৃদয়
আর যারা ছিল নিপুণ সন্ন্যাসী,
ব্রত ভেঙে তারা আজ পিতা
হাটবাজার নিয়ে গেছে গেরুয়া রঙ-
আমরা যারা গৃহে ছিলাম, ভালোবেসে-
দুধ-ভাতের চিন্তায়, সাথে স্বপ্ন জাহাজ
এবং ফুল-পাখি-নদী প্রেমে যারা ছিলাম
করুণ স্তব্ধতায় ডুবে আছি আকণ্ঠ
পৈশাচিক পীড়নে কাঁদে মা, কোলের শিশু
কাঁদে শুভ্র মন বিপুল আর্তনাদে-
আমরা অরণ্যে চলে যেতে চাই
ঝলসানো চৈত্র আর শ্বাপদ লোকালয়
এবং মানুষের দাঁতাল থাবা থেকে
যেতে চাই গেরুয়া রঙে, বৃক্ষছায়ায়...
মূলত আমরা পালাতে চাই এই উন্মাসিক চৈত্রকাল থেকে।
নুন
গহীন ভূমি থেকে হাতড়ে আনি বেদনার জল
ঘাম ঝরে পা-থেকে মাথা, অবিশ্রান্ত অবিরল
অশ্রু শুকায়, অতঃপর কেবল থাকে দেহজ নুন
ছায়ার কাছেই রেখে যাই বিষমাখা ছুরি, খুন।
আমার কাছে যা ছিলো নদী, রঙমাখা রোদ্দুর
সে দামে কিনেছি জীবন, কিনেছি সমুদ্দুর
সব রেখে প্রেম, চুমো, দীঘল জোছনাবাড়ি
দিন তো ছিলো ফানুসভরা, কি ভীষণ আনাড়ি!
অথচ ঘৃণার ছুরি হাতে মুছে নিলে প্রেম, প্রজাপতি ঋণ
ভাবিনি রক্তমাখা ঠোঁটে, চুমো এঁকে গেছি এতটা দিন!
সেই থেকে ছায়ার কাছে রেখে যাই বিষমাখা ছুরি, খুন
অতঃপর অশ্রু শুকায়, কেবল পড়ে থাকে দেহজ নুন।
বাংলাদেশ
প্রিয় বাংলাদেশ, তোমার প্রতিটি গ্রাম জুড়ে
তোমার শ্যামল বনভূমির প্রতিটি বৃক্ষ জুড়ে
যে পাখি ওড়ায় প্রাণের পতাকা
যে পথিক কণ্ঠে রাখে পিতৃপুরুষের অবিরাম শব্দগাঁথা
তুমি তাকে ভালোবেসো।
প্রিয় বাংলাদেশ, তোমার প্রতিটি নদীর ¯্রােতে
তোমার প্রতিটি ফসলের মাঠে
যে মানুষ উৎসব ছড়ায় ক্লান্তিহীন
যে তরুণ একখণ্ড আকাশ হতে চায়
তুমি তাকে ভালোবেসো।
প্রিয় বাংলাদেশ, তোমার প্রতিটি জোছনা রাতে
তোমার প্রতিটি বৃষ্টির দিনের উল্লাসে
যে তরুণীর ঠোঁটে গান লেগে থাকে
যে নারী মা ডাক শোনার স্বপ্নে বিহ্বল
তুমি তাকে ভালোবেসো।
প্রিয় বাংলাদেশ, তোমার প্রতিটি পবিত্র ভোরে
তোমার অগ্নিঝরা দিনের অলিতে গলিতে
যে যুবক মুখে নিয়ে বজ্র স্লোগান
যে পিতা আর কখনো ফেরেননি
তুমি তাকে ভালোবেসো।
আমাকে যে নিতে এলে
ঘোরের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নেমে যাচ্ছি কোথাও
ঠিকানা জানি না, কোনো পরিচয় নেই আমার
পকেট হাতড়ে কবে থেকে খুঁজে ফিরছি তেল জবজবে চুল,
লাঙ্গল, হালচাষের দুখানি গরু আর পোড় খাওয়া মাথাল...
আমাকে যে নিতে এলে, তোমার হাতখানা দেখি-
তোমার হাতে কি আছে পাটের গন্ধ, কাস্তের দাগ
তোমার গায়ে কি লেগে আছে কাদা, ধান আর
বৃষ্টি পড়ার শাব্দিক আখ্যান?
আমাকে যে নিতে এলে, তোমার মুখখানি দেখি-
তোমার চোখে কি আছে পূর্ণিমার চাঁদ
জোয়ার, ভাটা, গহীন গাঙের স্রোত...
তোমার ঠোঁটে কি আছে ডাল-ভাত, কাচামরিচের ক্ষেত
আছে কী মায়ের আঁচল, আদর, রোদণ্ডমেঘের হাসি?
আমাকে যে নিতে এলে, তোমার হাত, মুখ আর চোখ দেখি
একবার মিলিয়ে নেবো রক্তের গন্ধ, কম্পন...
তবে এসো, বাড়িয়ে দাও হাত-
ফেরারী হবো আজন্ম, ফেনীল স্রোতে...