প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
এখনো ভোরের আলো ফোটেনি। ফজরের আজানের পরের মুহূর্ত। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় এখনো আলোকিত তিন নদীর মোহনা। রাতের শেষ প্রহরের শীতল বাতাসে মৃদু ছন্দে বয়ে চলেছে শান্ত নদী। ডাকাতিয়ার দুইপাড়ে খেয়াঘাটে বাঁধা সারি সারি নৌকা। সারাদিন ধরে খেয়া পারাপারের, নৌযানের চাপে কম্পিত থাকে ডাকাতিয়ার পানি। ঢেউয়ে আন্দোলিত নদীর পানি আর নৌকাগুলো রাতের শেষ প্রহরে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামে ছিল। আবছা কুয়াশা ভেদ করে দক্ষিণ দিকের মালবাহী জাহাজ, আর পশ্চিমের চর থেকে আসা কাঁচাসবজির ট্রলারগুলো মেঘনা ছেড়ে চৌধুরী ঘাটে এসে থামছে। স্বল্প কথাবার্তায় পাইকারি বণিকেরা মালামাল ডাঙায় নামাচ্ছে। নৌকা ঘাটগুলোর পাশে বেদেদের ভাসমান পল্লী। দূর থেকে দেখে, ছইয়ে বেষ্টিত কয়েকটি নৌকা মনে হলেও এর মধ্যে বসবাসরত স্বামী, স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে এক একটি পরিবার। ছইয়ের সাথে সাজানো তাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাবার, পোশাকসহ সব কিছু। এর মধ্যে তাদের জন্ম, খাওয়া-পরা, ঘুম, গোসল, শৌচাগার, বিয়ে এবং মৃত্যু।
বহরের প্রতিটি নৌকার মধ্যে নারীরা তৈরি হচ্ছে গ্রাম করতে যাওয়ার জন্য। হারিকেনের মৃদু আলোতে সুরমা তার মেয়েকে সাজাচ্ছে। মাথার উপরে তুলে চুলের খোঁপা, কানে লম্বা দুল, কানের উপরের ছিদ্রগুলোতে ছোট ছোট ফুল, নাকে নোলক, মুখে ¯েœা, পাউডার, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল, গলায় লম্বা মালা, হাত ভরতি কাচের চুড়ি, কোমরে বিছা, পায়ে নূপুর। হলুদ জমিনে সবুজ পাড়ের শাড়ি পায়ের গোড়ালির ওপর পরা। সাজানো শেষে নৌকার ছইয়ের সাথে ঝুলানো ছোট আয়নাটি তরীর হাতে দিয়ে বললো, দেখ, সাজানো হয়েছে কিনা।
মা, মেয়ের কথোপকথনে তরীর বাবার ঘুম ভেঙে গেল। তরী হাতে আয়নাটি নিতেই তরীর বাবা বললো, সাজ ছাড়াও আমার মেয়ে দেখতে কম সুন্দর না। বাপের কথা শুনে ফিরে চেয়ে দেখলো বাবা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তরীর বাপ হেসে বললো, তুই দেখতে একেবারে তোর দাদির মতো হয়েছিস। ক্ষণেই বেজার মুখে বললো, কিন্তু আমি তোকে তাদের মতো আভিজাত্য দিতে পারিনি রে মা।
তরী বাপের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, যে আভিজাত্য অহংকারে ভরা, সেই আভিজাত্যের কোন দরকার নেই আমার, বাবা। ভালোবেসে আমি আমার আভিজাত্য গড়ে নিবো, দেখো তুমি। একেবারে তা নিয়ে ভাববে না, বলে দিলাম।
বাইর থেকে সর্দারের ডাক পড়লো। সর্দারসহ আরো ক’জন পুরুষ মিলে শহরের দক্ষিণ দিকে হরিনার বালুর মাঠে কিছু দিনের জন্য তাঁবু তৈরি করে থাকবে। জঙ্গল থেকে তারা সাপ ধরবে, তাবিজের জন্য গাছের শেকড়, বাকল ও পাতা সংগ্রহ করবে। কেউ কেউ বাজারে গিয়ে বানর খেলা দেখাবে। মায়ের তাবিজের ঝোলাটি কাঁধে নিয়ে নৌকার বাইরে বেরিয়ে এলো তরী।
সুরমা মেয়েকে বললো, কত করে বললাম, যাস্নে, শরীর ভালো হলে আমিই গ্রামে যাব। শুনলি না আমার কথা।
‘বছরের এই দুইটা মাস তো রোজগারের সময়, মা। কবে তোমার শরীর ঠিক হবে কে জানে? সংসারটা তো চলতে হবে। তুমি বরং বাবার সাথেই থাকো। এ কথা বলে পল্লীর অন্য মেয়েদের সাথে খেয়া পার হয়ে, পুরাণবাজারের লোহার পুল থেকে বাসে উঠে বসলো তরী। আজ তারা হাইমচরের কমলাপুর গ্রামে যাবে।
কার্তিক মাসের ভোরে হালকা কুয়াশায় ঢাকা গ্রামের মেঠো পথ। ঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর খেলা। পাখির কিচির মিচির শব্দ চারদিকে। উত্তরের ঝিরঝিরে হাওয়ায় মৃদু ঠা-া পরিবেশ। শান্ত পরিবেশে হেঁটে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করছে পলাশ। বারো বছর পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে সে। ফজরের আজান পড়তেই নামাজ পড়ে মাকে বলে বেরিয়েছে। হেঁটে দেখছে তার চেনা পরিচিত গ্রাম, গ্রামের পরিবেশ আর মানুষজনদের। দশ বছর বয়সে সব ছেড়ে লেখাপড়ার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল সে। ফিরে এসে পরিচিত মানুষদের চিনতে একটুও ভুল হয়নি তার। সকলের সাথে আলাপের পর পশ্চিম পাড়ার ছমির দাদার চা-বিস্কুটের দোকান থেকে আট দশটা লজেন্স পকেটে ভরে বাড়ির দিকে রওনা দিলো সে।
ভর দুপুর, রোদের তেজ বাড়তি। দীর্ঘ সময় কাঁধে ঝোলা নিয়ে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে চৌধুরী বাজারের মোটা বট গাছটার নিচে গিয়ে বসলো তরী। গরমে ঘেমে তার মুখের সাজের বেহাল দশা। মাথার খোঁপায় গোঁজা কচুরিপানা ফুলটিও শুকিয়ে গেছে। জীবনে প্রথমবার গ্রাম করতে এসেছে সে। বাবার অমতে, মায়ের শরীর খারাপ বলে, পল্লীর অন্য মেয়েদের সাথে সেও গ্রাম করতে বের হলো। সে ছাড়া তার বাবা মায়ের আর সন্তান নেই। যশোরে তার বাবার স্থায়ী বাড়ি। শিক্ষিত ধনী পরিবারের ছেলে। তার মায়ের কোনো বাড়ি নেই। নৌকায় যাযাবরের জীবন তাদের। ভালোবেসে বিয়ে হয়েছিল বাবা-মায়ের। বাবা চেয়েছিলো তার মাকে অস্থায়ী জীবনের দুর্দশা থেকে বের করে স্থায়ী, সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে। বিনিময়ে বাবা হয়েছে পরিবারের ত্যাজ্য পুত্র, আর মা হয়েছিলো যশোরের বেদে পল্লী থেকে বহিষ্কার। বাবার সভ্য সমাজে তাদের ঠাঁই না হলেও ঠাঁই হয়েছে অবহেলিত বেদে পল্লীতে। মা বাবাকে নিয়ে চলে এসেছে চাদঁপুরে। ডাকাতিয়া পাড়ের বেদেদের ডেরায় ছোট্ট নৌকায় সংসার পেতে জীবন শুরু করেছে। স্থায়ী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে তার বাবার। বেদে সমাজের রীতি অনুযায়ী পুরুষেরা ঘরে থাকে। নৌকায় বন্দি থেকে থেকে মানসিক ও শারীরিক ভাবে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে মানুষটা। তরীর মা কখনো পিঠে, কখনো বুকে, শাড়ির আঁচলে থলে বানিয়ে তাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাবিজ বিক্রি করে সংসার চালায়। যখন তরীর বয়স ছয় বছর, তখন থেকে সে বাবার সাথে নৌকাতেই থাকতো। স্কুলে লেখাপড়ার ব্যবস্থা না থাকলেও বাবা তাকে আদর্শ লিপি বই কিনে নৌকাতেই পড়ালেখা শিখিয়েছে। বাবার ছোট্ট রেডিওতে সে সারা দুনিয়ার সব খবর শুনেছে। বাবার কাছে স্থায়ী সমাজের মানুষের জীবনের সুখের গল্প শুনেছে। সেই মানুষটির খাওয়া পরার জন্যই আজ অর্থ রোজগার করতে গ্রামের পথে নেমেছে সে।
বসে বসে এসবই ভাবছিল তরী।
ঝিনুক তাকে রেখে কোন্ বাড়িতে শিঙা লাগাতে গেছে, এখনও ফিরে নি। এ পর্যন্ত সে কোনো তাবিজ বিক্রি করতে পারেনি। হাজেরা খালাকে তার মায়ের দেয়া তাবিজটা এখনো দিতে পারেনি। সেই ছোট বেলায় মায়ের সাথে এই গ্রামে এসেছিল, এখন কিছুই চিনতে পারছে না। ঝিনুকও সেই বাড়িটা খুঁজে পায়নি। বাড়িটা খুঁজে পেলেও কিছু পয়সা পেত। তা না হলে আজ তাদের খোরাক চলবে না। চিন্তা আর পিপাসায় চুলের খোঁপার শুকিয়ে যাওয়া ফুলটি খুলে ফেলে দিল তরী।
অদূরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে পলকহীন দৃষ্টিতে তরীকে দেখছিল পলাশ। এ যেন হাজার বছর ধরে চেনা মুখ। ভাবনা ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালো তরীর, মুখপানে চেয়ে দেখলো, তার মনের মধ্যে আঁকা সেই চিরচেনা মুখটি। শৈশবে যাকে সপ্তাহ, পনেরো দিন কিংবা মাস পর পর দেখতো। অধীরচিত্তে অপেক্ষা করতো যাকে দেখার জন্য। চার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি মায়ের শাড়ির আঁচলের ফাঁকে মুখ বের করে মিটি মিটি করে চারদিকে তাকিয়ে থাকতো। আর পলাশের মুখের আধ খাওয়া লজেন্সটি হাতে পেয়ে একরাশ হাসি উপহার দিতো তাকে। হঠাৎ করেই তার আসা বন্ধ হয়ে গেল। সুরমাকে দেখলেই সে দৌড়ে গিয়ে জানতে চাইতো মেয়েটির না আসার কারণ। পলাশের মা তাকে দূরে সরিয়ে দিত। একদিন সে তরীর জন্য তার মায়ের কাছে লজেন্স পাঠিয়েছিল। তার পরেই বিদেশে যাওয়ার পর আর খোঁজ রাখার সুযোগ হয়নি তার। কিন্তু আজও পলাশের মনের মধ্যে ছবি হয়ে বসে আছে এই মুখশ্রী। সবসময়ই ভাবতো আবার তাকে খুঁজে পাবে সে। কিছুক্ষণ পর অস্পষ্ট স্বরে সে ডাকলো, তরী!
তরী! তার নাম তো এই গ্রামের কেউ জানে না! তবে কে তাকে নাম ধরে ডাকবে? এই কণ্ঠে আরও আগে তাকে কেউ ডেকেছে মনে হয়। খুব চেনা চেনা লাগছে। মুখটিও খুব কাছের কারো মনে হচ্ছে। ভাবনা ছেড়ে আচমকা তরী সামনের মানুষটিকে বললো,
সাহেব, তোদের এই বাজারটায় জল খাওয়ার কোনো কল নেই? বড্ড জল তেষ্টা পেয়েছে।
তার ডাকে সাড়া না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করাতে বিচলিত না হয়ে শান্ত চোখে বাজারের পশ্চিম মাথার নলকূপটি চোখের ইশারায় দেখালো পলাশ।
কোনো কিছু না ভেবে কাঁধের ঝোলাটি গাছের তলে রেখে এক হাতে কল চেপে অন্য হাতে জল খাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো তরী।
চারদিকে তাকিয়ে তরীর বৃথা চেষ্টা সফল করতে পলাশ এগিয়ে গিয়ে কল চাপতে লাগলো, আর তরী দুহাতে প্রাণ ভরে জল পান করে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে পুনরায় গাছের তলে এসে বসলো। শাড়ির আঁচলে চোখ মুখ মুছে সামনে তাকিয়ে দেখলো একটু আগের মানুষটি নেই।
মালি বাড়ির সামনের জবা ফুল গাছ থেকে একটা ফুল এনে তরীর চুলের খোঁপায় গুঁজে দিল পলাশ। তরী অবাক চোখে তাকালে সে বললো, আগের ফুলটি শুকিয়ে গেছে বলে তাজা ফুল গুঁজে দিলাম।
যেখানে তোদের স্থায়ী সমাজের লোকেরা আমাদের মতো যাযাবর বেদেদের দেখলে দশ হাত দূরে থাকে, আমাদের গায়ের গন্ধ নিতে পারে না বলে মুখে কাপড় চেপে ধরে, মুসলমান হওয়ার পরও বিধর্মী বলে, উপহাস, ঘৃণা কোনটা করতে বাদ রাখেনি, সেখানে তুই যে আমায় সাহায্য করলি?
জবাব না দিয়ে পকেট থেকে লজেন্স বের করে পলাশ বললো, এই নাও, এটা খেতে খুব ভালো।
এই লজেন্স, এই গলার স্বর, এইভাবে বলা কথা
তো তাকে ছোট বেলায় একজনই বলতো! তবে কি-
তরীকে ভাবতে না দিয়ে পলাশ বললো, কী হলো, ভাববে, নাকি নিবে?
অর্ধেকটা খাওয়া লজেন্সের বাকিটা হাতে নিয়ে তরী বললো, সাহেব, আজই প্রথম বার গ্রাম করতে আসছি। বাবা, মা দুজনের শরীর খারাপ। নৌকায় খাবার নাই, গ্রামের কিছুই চিনি না, খান বাড়িটা কোন্ দিকে একটু বলবি? ঐ বাড়ির হাজেরা খালার পায়ের ব্যথার তাবিজ পাঠাইছে মায়, দিতে পারলে আজকের ভাত রান্নার চালটা পেতাম।
পলাশ হেসে বললো, ঐ টা আমারি বাড়ি। মায়ের তাবিজ আমার কাছে দিতে পারো।
মুখে হাসি ফুটিয়ে তরী বললো,তাহলে তো ভালোই হলো।
তুমি আমায় চিনতে পারছো না তরী? ছোট বেলায় আমরা একসাথে কতো খেলেছি। তোমার মা যখন সারা গ্রাম হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়তো, তখন আমাদের বাড়িতে এসে বিশ্রাম নিতো। তখনই শুরু হতো আমাদের লুকোচুরি খেলা। তরী কিছু বলার আগেই-
ঝিনুক এসে বলল, চল তরী, খান বাড়ি যাবি না?
তুই এত সময় পর ফিরলি ঝিনুক?
সারা দিন হেঁটে একজন খদ্দের পাইছি। দুশো টাকা বায়না করে শিঙা দেওয়ার পর আশি টাকা দিল। তার জন্যই দেরি হইছে।
তরীর হাত থেকে তাবিজের পুঁটুলি নিয়ে, কিছু টাকা তার হাতে ভরে পলাশ বললো, বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই, আমি পৌঁছে দেব।
ঝিনুক হেসে বললো, ভালোই হলো। তুই খুবই ভালো, সাহেব।
চল তরী, বাস ধরতে হবে। বাংলা বাজার মোড়ে কণা অপেক্ষা করবে বলে হাত টেনে তরীকে নিয়ে চলে গেলো ঝিনুক। চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইলো পলাশ। তরীও কয়েকবার পিছনে ফিরে চেয়েছে।
বাড়ি ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো পলাশের। মা রাগ করে বললো, সেই ছোট্ট বেলায় বিদেশে পাঠিয়েছি লেখাপড়া করে চাকরি করবি বলে। বড় হয়ে গেছিস, তাই তো এত বছর পর এসে মায়ের কাছে না থেকে ভোরেই বেরিয়ে গেলি।
মাকে জড়িয়ে ধরে ‘মোটেই না’ বলে হাতে থাকা তাবিজের পুঁটুলিটা দিয়ে সব খুলে বললো সে।
ডেরায় ফিরে, উৎফুল্ল হয়ে তরী তার মায়ের কাছে পলাশের বিদেশ থেকে ফিরে আসা, তার সাথে দেখা হওয়া, তাকে সাহায্য করাসহ সবকিছু বললো। তার কবজের বিনিময়ে যে টাকা দিয়েছে সেটা তার মায়ের হাতে তুলে দিলো। সুরমা গুণে দেখলো, সেখানে পাচঁটি একশত টাকার নোট আছে। মেয়েকে দেখিয়ে সুরমা বললো, আমি তো এত টাকার কবজ দেইনি। সে এত দিলো যে?
মা আমি গুণে দেখি না।
ছেলেটা সেই ছোট বেলার মতোই রয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েকে বললো, যাহ, গোসল করে কাপড় ছেড়ে আয়।
ঝিনুক ও কণার সাথে নদীতে নেমে মুখ-হাত মেজে ডুব দিয়ে, বুকে হাত চেপে তারা নিজ নিজ নৌকায় উঠতে লাগলো। খেয়াপারের কতো পুরুষ তাদের দিকে কামুক নজরে দেখেছে, আর কতো জন অবজ্ঞার চোখে দেখেছে তার কোনো হিসাব নেই। এ যেন দু পক্ষের নিত্য দিনের কর্ম। সভ্য সমাজের মানুষের জন্য তা কেবলই উপহাস। আর যাদের থাকা, খাওয়া, জীবন, মরণ সবই জলে ভাসা, তাদের জন্য নদীতে নেমে গোসল করা জীবনযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাতে খাওয়ার পর শুয়ে পড়লো পলাশ। ঘুম এলো না চোখে। চোখ বন্ধ করলেই তরীর মুখটা সামনে ভেসে ওঠে। যদিও এটা নতুন না। এতোগুলো বছর বিদেশে থাকলেও তরী তার মনের মধ্যেই বাস করতো। বেদেনির পেটে জন্ম হলেও স্থায়ী সমাজের বাবার ঔরসজাত হওয়ায় শৈশব থেকেই তার মুখে, হাসিতে, কথায় অমায়িক এক আভিজাত্য ফুটে উঠতো। যার জন্য মায়ের আঁচলের ঝুলিতে বসে একগাল হেসে সকলের মন জয় করতে পারতো সে। মনে ধরলেও কেউ তা মুখে স্বীকার করতো না। বেদের মেয়ে বলে দূরে সরে থাকতো। তাদের বাড়িতে বসতো বলে তার মাকেও অনেক কথা শুনতে হতো। হাঁটা শিখার পর থেকে সে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে পলাশের সাথে খেলতো। সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ যুবতী হয়ে গেছে। তবে তার সেই মুখশ্রী, মায়াবী চাহনি, হাসি আগের মতোই আছে। যাকে চিনতে একটুও সময় দেরি হয়নি পলাশের। কেবল তার কিশোরী কালের চঞ্চলতা দেখতে পারেনি বলে মনটা আনচান করতে লাগলো।
তরীর বাবা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুরমা মেয়েকে নিয়ে ছইয়ের নিচ থেকে নৌকার মাথায় এসে খোলা আকাশের নিচে বসলো। দুইপাড়ের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পদ্মা নদীতে জেলেদের নৌকার সামান্য আলো দেখা যাচ্ছে। সারাদিন কাজের পর পৃথিবীর মানুষ যখন প্রশান্তিতে ঘুমায় তখন তরী বাবা-মায়ের সাথে বসে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে গল্প শুনে। বাবার শরীর খারাপ হওয়াতে এখন আর তেমন গল্প হয় না। অনেক দিন পর মা-মেয়ে বাইরে এলো।
তুই গেরামে গেলে পলাশের সাথে তেমন কথা বলবি না। ওদের বাড়ি যাবি না। ছোট বেলায় খেলতে খেলতে যখন একদিন তুই ওর সাথে ওদের ঘরে ঢুকেছিলি, সেদিন ওর খালা সেটা দেখতে পেয়ে তুমুল কা- করেছে। তোর পায়ের চাপে সেই ঘর অপবিত্র হয়েছে বলেছে। ওর মায়ের সাথে ঝগড়া করে ছয় মাস সেই বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর থেকে আমি আর তোকে গ্রামে নেই নি। ঐ বাড়িতেও ঢুকি না। বাড়ির সামনে ডেকে তার মাকে তাবিজ, কবজ দিয়ে আসি। তার খালার মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিবে বলেই তার খালা তাকে বিদেশে পাঠিয়েছিল। তোকে সেখানে দেখলে তার খালা আবারও ঝামেলা বাঁধাবে। স্বজন হারানোর বেদনা আমার থেকে ভালো আর কেউ জানে না, বলে নৌকার ছইয়ের ভিতরে চলে গেলো সুরমা।
দূর আকাশ পানে চেয়ে তরীর জিজ্ঞেস, তাদের অবহেলিত জীবনের কোনো পরিবর্তন আসতে পারে না? যুগ যুগ ধরে অবহেলার সাথে বেঁচে আছে এই বেদে গোষ্ঠী। তারা জানে না কোথা থেকে শুরু হয়েছে এই জীবন চলা। স্থায়ী ঠিকানাহীন, জমিজমাহীন, ঘরহীন নদীর ওপর নৌকায় ভাসা ভবঘুরে জীবন। ঝড় বৃষ্টি, শীত, গ্রীষ্ম সারা বছরই ভাসমান নৌকায় জীর্ণ দশা নিয়ে কাটাতে হয় তাদের। শুকনা মৌসুমে ডাঙায় অন্যের জমিতে তাঁবু গড়লেও কিছুদিন পর জমির মালিকদের হুকুমে ভেঙে চলে আসতে হয়। নেই তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা। শুধু কোনো রকম খেয়ে বেঁচে থাকাই তাদের জন্য অনেক। ভালো খাবার, ভালো পোশাক, শিক্ষা সব কিছু থেকেই জন্ম থেকে বঞ্চিত হয় বেদে পল্লীর বাচ্চারা। নৌকায় রান্না, খাওয়া, গোসল, ঘুম, জন্ম, মৃত্যু সব। সাপের খেলা, বানরের খেলা, নাচ, গান, তাবিজ বিক্রি, দাঁত-নখের পোকা খোলা, থালা বাসন বিক্রি, আর ব্যথা বেদনায় শিঙা লাগিয়ে নারীরা সংসার খরচ চালায় কোনরকম। নারীরা সংসারে রোজগার করলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো অধিকার থাকে না। সারাদিন গ্রামে ঘুরে রোজগার করে বেলা শেষে স্বামীর কাছে হিসাব দিতে হয় স্ত্রীকে। গরমিল হলে শরীরের ওপর নিতে হয় নির্যাতন। স্বামীকে বেশি ভালবাসে বলে সবটা সহ্য করে সংসার আগলে পড়ে থাকে। পুরুষেরা কেবল নৌকায় থেকে মাছ ধরে, আর বাচ্চাদের দেখাশোনা করে।
এই সপ্তাহে শহরের আশেপাশের গ্রামে গিয়েছে তরী। তার বাবার শরীর দিন দিন বেশিই খারাপ হচ্ছিলো। সদর হাসপাতাল থেকে এনে দেওয়া ঔষধেও কাজ হয়নি।
রোজ নয়ানী স্টেশনে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে পলাশ। পনেরো দিন পার হওয়ার পরও তরী এই গ্রামে আসে না। আজ হাঁটতে হাটঁতে সে নয়ানী মোড়ের নারকেল গাছের নিচে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর দেখলো, তরী কাঁধে ঝোলা নিয়ে এদিকেই আসছে। চোখ, মুখ মলিন। কোনো সাজগোজ নেই। তার সামনে গিয়ে কোমল কণ্ঠে পলাশ ডাকলো, তরী?
দুজনে পথের পাশে নারকেল গাছের নিচে গিয়ে বসলো? এতদিন আসলে না যে?
তরী চুপ রইলো। পলাশ আবার জানতে চাইলে কান্নাভেজা গলায় তরী বললো-
আমার বাবা চলে গেছে, সাহেব! অনেক দূরে, যেখান থেকে আর কোনো দিন ফিরবে না। বাবাকে কবর দেওয়ার জন্য মা স্থানীয় কতো লোকের কাছে গিয়েছে একটু জায়গার জন্য। কেউ দিতে চায়নি। শেষে ডেরার সকলে মিলে একজনের হাতে পায়ে ধরে তাদের বাগানের এক কোণায় জায়গা পেয়েছে বাবার কবরের।
জানিস সাহেব, ঐ লোকটার হাতে পায়ে ধরে মা যখন কাঁদছিল, মায়ের চোখের জল দেখে আমার যতটা বুক ফেটেছে, বাবার মৃত্যু দেখেও ততটা বুক ফাটেনি। মা চেয়েছে বাবার কবরটা দেখে যেন শান্তি পেতে পারে। আমাদের ডেরার সর্দারের বাপ যখন মরেছিল, কবরের জায়গা না পাওয়াতে তার লাশ কলা গাছের ভেলায় করে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বৃদ্ধ নানী আজও চোখের জলে ভাসে, মৃত স্বামীর কবরখানা দেখতে পায়নি বলে। শুকনা মৌসুমে যারা মরে তাদেরকে নদীর ডাঙায় কবর দেয়। কিছুদিন পর সেই কবরের ওপর তৈরি হয় দোকান, দালান। কোনো অস্তিত্ব থাকে না কবরের।
কিছু সময় চুপ থেকে তরী, তিনশত টাকা পলাশের হাতে দিয়ে বললো, মা যাওয়ার সময় এই টাকাটা তোকে ফেরত দিতে বলছে। কবজের দাম দুইশত টাকা। মায়ের মন কিছুতেই ভালো হয়নি বলে তাকে যশোরে নানীর কাছে পাঠিয়েছে সর্দার। যদি সব অভিমান ভুলে মেনে নিয়ে তারা মাকে সান্ত¡না দেয়।
পলাশ টাকাটা তরীর হাতে দিয়ে বললো, আমি খুশি হয়েই তোমাকে দিয়েছি। তোমার কাছে রাখো এটা।
আমরা গরিব হতে পারি, তাই বলে অন্যের দান নেই না সাহেব। বেদে মেয়েরা খেটে খাওয়া মানুষ। যারা সারাজীবনের জন্য খাওয়া-পরার অঙ্গীকার করে গাছের মগডাল থেকে বরকে নামিয়ে এনে বিয়ে করে, তারা বিনা খাটুনিতে অন্যের দার গ্রহণ করে না।
পলাশ বুঝলো, এই মেয়ে কিছুতেই তার দান, উপহার, সহযোগিতা কিছুই নিবে না। তবে সে এই কষ্টের জীবন থেকে তাকে বের করে আনবে কী করে?
হঠাৎই সে বললো, আমায় বিয়ে করবে তরী?
হাসালি সাহেব! কেবল আমার বাবা ব্যতীত তোদের সমাজের অন্যেরা হয়তো করুণা, নতুবা ভোগের জন্যই আমাদের সমাজের মেয়েদের বিয়ে করতে চায়। না হলে যখন আমরা গ্রামে বের হই তোদের সমাজের পুরুষেরা লোলুপ চোখে আমাদের শরীরের দিকে তাকায় কেন? যখন আমরা বাসে উঠি স্বেচ্ছায় আমাদের গা ঘেঁষে বসে কেন? সব থেকে বড় কথা, আমার বাবার থেকে বয়সে বড় লোকটা বাবার কবরের জায়গার বিনিময়ে কেন ভরপুর সংসার থাকতে আমায় বিয়ে করতে চাইলো? বল সাহেব?
তরীর কথা শুনে পলাশ ভাবলো, তরীর কথা মিথ্যে না। কিন্তু এখন তো তরীকে বুঝাতে হবে। তাই শান্ত হয়ে সে বললো,
দেখ, সব পুরুষ এক না, তরী! বাসে অন্য পুরুষেরাও ছিলো, তার মধ্যে দু-একজন ব্যতীত বাকিরা সবাই তো আর তোমাদের সাথে এমনটা করেনি, সেজন্যই সবাইকে এক ভাবতে নেই।
তরী চুপ রইলো। খানিক পরে পলাশ বললো,
তুমি কি ঐ বুড়োটাকে বিয়ে করবে!
জীবনে বিয়ে না করার অঙ্গীকার করেছিলাম। ভেবেছিলাম, একটা সংসার নিয়ে পড়ে না থেকে পুরো ডেরার মানুষের জন্য কিছু করে তাদের জন্য স্থায়ী বাসস্থান যোগাবো, আধুনিক জগতের আলো দেখাবো। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবো, তা আর হলো কই? বাবার মৃত্যুতে মায়ের মাথা ঠিক ছিলো না বলেই ঐ বুড়োটার শর্তে রাজি হয়েছে।
মায়ের পর তোমাকেই আমি দ্বিতীয় নারী হিসাবে আমার মনে জায়গা দিয়েছি। সব সময়ই চেয়েছি তোমায় অবহেলিত জীবন থেকে বের করে আনতে। কখনো তোমার শরীর নিয়ে ভাবিনি।
আমার বাবাও তো এমনটাই চেয়েছিল সাহেব।
বিনিময়ে সমস্ত সম্পর্ক, সুখ, সাম্রাজ্য ছেড়ে নৌকার ভেতর আটকে থেকে তিলে তিলে শেষ হয়ে গেছে। আমি কিছুতেই চাই না আর কারো সাথে এমনটা হোক। তোর মা, তোর খালার মেয়ের সাথে তোর বিয়ে আশা করে রেখেছে।
এই সবই জানে পলাশ। তবুও শান্ত স্বরে বললো, বিশ্বাস করো তো আমায়? তবে শুন, তোমার বাবার মতো কিছুই হবে না। তুমি স্বাধীনভাবেই চলবে। তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ হবে। আর কথা না বাড়িয়ে পলাশ বললো, এবার তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।
চারিদিকে চেয়ে পলাশ, তরীর চুলের খোঁপা খুলে মাথায় কাপড় টেনে দিল। কাঁধের ঝোলাটি অন্য একটা ব্যাগে ভরে তরীর হাত ধরে সামনে এগোতে থাকলো। পলাশের এহেন কা-ে তরী কিছু বলার আগেই বাস চলে আসলো। তরীকে নিয়ে সে বাসে উঠে বসলো চাঁদপুরের উদ্দেশ্য।
বাস চলতে থাকলো নিজ গতিতে। চান্দ্রা চৌরাস্তায় এসে যাত্রীদের ওঠানামার জন্যে কিছুক্ষণ বাসটি থামলো। পলাশ নেমে তরীর জন্য এক জোড়া জুতা কিনে এনে তার পায়ের সামনে রেখে পরতে ইশারা করলো।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে তরী ভাবলো, এই সেই মানুষটা। শৈশবে মায়ের সাথে গ্রামে এসে যাকে সব থেকে বেশি ভরসা করতো সে। যখন তার মা তাকে গ্রামে নিয়ে আসা বন্ধ করলো তখন এই মানুষটাকে দেখার জন্য কত কেঁদেছিল সে। মায়ের কাছে জেনেছিল, সে বিদেশে চলে গেছে। তার পর এই বারোটি বছর ধরে এই মানুষটির জন্য সে অপেক্ষায় থাকতো মনে মনে। ভাবলো, কোনো একদিন এসে তার হাতটি ধরে ছেলেবেলার মতো টানতে টানতে খেলতে নিয়ে যাবে তাকে। তাই তো এই মানুষটি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসার সময় কিছুই বলতে পারেনি সে।
পুরাণবাজার স্টেশনে এসে গাড়ি থামলো। গাড়ি থেকে নেমে দুজনে হেঁটে দশ নাম্বার ঘাটে এসে গুদারা পার হয়ে চৌধুরী ঘাটে এসে নামলো। নিজেদের ডেরার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তরীর মাথার ঘোমটা আরো টেনে দিল পলাশ। তরীর কাছ থেকে তার বাবার কবরের ঠিকানা জেনে দুজন সেখানে চলে গেল।
দুজন বসে আছে একটা ছোট দোতলা বাড়ির উপরের কামরায়। অল্প সময়ের মধ্যে ঐ লোক তাদের সামনে এলো। পলাশ তার সাথে সামান্য আলাপ সেরে বললো, আমি বিদেশে চাকরি করি। শহরের জমি নিয়ে বাড়ি বানাতে চাই। শুনেছি আপনার এখানে পূর্ব দিকের বাগানটায় খালি জমি আছে। ঐটা আমার বাড়ির জন্য দরকার। বাজার দর যা হবে তার থেকে কিছুটা বেশি দেব।
মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার মতো মনে হলো ঐ লোকের কাছে। ঐ জমি ডোবা বাগান হওয়ার কারণে বেচতেই পারছিলো না সে। তাই সুরমা বেদেনিকে দেওয়া কথা ভুলে তার স্বামীর কবর সহ জমি বিক্রি করতে রাজি হয়ে গেল। পরদিন জমির কাগজপত্র হবে বলে উঠতে গিয়েও উঠতে পারলো না পলাশ। ঐ লোক আজই জমি বিক্রির কাজ চুকাতে চায়। তার কাছ থেকে কিছুটা সময় নিয়ে তরীকে নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে চেক কেটে টাকা তুলে নিলো। তারপর, ভূমি অফিসে গিয়ে তরীর নামে জমির দলিল লিখিয়ে নিল। নগদে অতি দামে জমি বেচার খুশিতে ঐ লোক তরীর ব্যাপারে কোনো বিষয়ে জানতেও চাইলো না।
কোর্টে এসে উকিলের সাথে কথা বলে কাবিননামায় স্বাক্ষর করে তরীকেও স্বাক্ষর করতে বললো পলাশ। জীবনে এই প্রথম এতো জায়গা দেখলো তরী। শহরের পাশে নদীর পাড়ে তাদের ডেরা হলেও তারা রোজগারের জন্য চলে যায় গ্রামে। এই শহরের লাল, নীল আলো, বড় বড় বাড়ি, বাজার, কেনা বেচা, গাড়ি রিকশা কখনও তার দেখা হয়নি। তারা তো কেবল চাল, ডাল, আলু, নুন কেনার জন্য ঘাটের কিনারের মুদি দোকানটিতে আসতো। তাই এতক্ষণ মুগ্ধ চোখে চারদিকে চেয়ে থাকাতে এতোটা কিছু নিয়ে সে ভাবতেই ভুলে গেছে। পলাশের কথায় সম্বিত ফিরিয়ে সে অসন্তুষ্ট চোখে তাকালো। মনে মনে ভাবলো, বিশ্বাস করেছে বলে এমনটা হোক সে তা চায় না।
ভয় পেয়ো না। সকল পুরুষ প্রেমিক না। তোমাকে ভালবাসতে যদি তোমার অবয়বের প্রয়োজন পড়তো, তাহলে এতবছর ভালোবাসা পচে গলে মরে যেতো। ছেলেবেলায় এক সাথে খেলার কথা মনে কর, তাহলে স্বাক্ষর করতে অসুবিধা হবে না।
পলাশের কথা শুনে আর কিছু বলতে পারলো না তরী। বাবার কাছ থেকে শিখা নিজের নামের স্বাক্ষরটা করে দিলো সে। তারপর কাজীর কাছে গিয়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো।
বহরে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। শীত শুরু হওয়াতে ডেরার সকলেই শুয়ে পড়েছে। তরীদের নৌকার সামনে এসে দাঁড়ালো দুজনে। জমির দলিল ও ব্যাংক ড্রাফট তরীর হাতে তুলে দিয়ে পলাশ বললো, আমি কেবল তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছি। অস্থায়ী পরিবেশ থেকে তোমাকে বের করতে বিদেশে থেকেও সব সময়ই তোমার কথা ভেবেছি। ভেবে ভেবে নিজের বাম পাশের স্থানটি কখন যে তোমার নামে লিখে রেখেছি বুঝতেই পারিনি। আজকের দিনের ঘটে যাওয়া সব কিছু করেছি তুমি আমার থেকে কোনো সহায়তা নেবে না বলে। এখন তুমি আমার দেওয়া কিছুকে দান না ভেবে অধিকার ভাববে। কাল থেকে তুমি এই বেদে পল্লীর সবাইকে নিয়ে নতুন ঠিকানায় চলে যাবে। স্বাধীনভাবে তোমার মনের মতো পৃথিবী গড়ে তুলবে। আমার হৃদয় জুড়ে সবসময়ই তুমি রবে। এসব বলে উল্টো দিকে ফিরে পা বাড়ালো তুতুল।
আজ না গেলে হয় না, সাহেব? তরীর প্রশ্নে জিজ্ঞেসসূচক চোখে ফিরে তাকালো পলাশ।
মাকে ছাড়া রাতে ঘুম আসবে না। বড্ড ভয় হয় আমার। সারাদিন ডেরায় ফিরিনি। সকালে সর্দার আমাকে প্রশ্ন করবে। তুই আজ থেকে যা।
দুজনে চুপচাপ নৌকার মাথার খালি জায়গাটুকুতে গিয়ে বসলো। সারাদিনের ছুটাছুটিতে, অনাহারে ক্লান্ত হয়ে আছে শরীর। পলাশ পকেট থেকে লজেন্স বের করে একটু খেয়ে বাকিটা তরীর মুখের সামনে ধরলো।
লজেন্স মুখে দিয়ে পলাশের দিকে চেয়ে বললো, তুই ছাড়া এভাবে কেউ আমায় লজেন্স খাওয়ায়নি কোনোদিন। এমন করে লজেন্স খাওয়ার বাসনা সবসময়ই মনে রেখেছি আমি। সেদিন প্রথমবার দেখেই তোকে চিনেছি আমি। এত বছর যে মানুষটা মনের মধ্যে বাস করেছে, তাকে দেখে যতটা খুশি হয়েছি, ততোটাই ব্যথা পেয়েছি তার থেকে দূরে থাকবো বলে। আপনজন হারানোর বেদনা বাবা, মাকে দেখে আমি বুঝেছি। তুই তোর মায়ের কথা রাখিস সাহেব।
তোমার কথা রাখতেই আমি মায়ের কথা রাখবো। তুমি ভালোবাসা হয়ে চিরদিন আমার মনেই থাকবে। দ্বিতীয় পক্ষ কেবল আমার দায়িত্ব হবে। এরপর দুজনে বসে অনেকক্ষণ ধরে ছোট বেলার লুকোচুরি খেলার গল্প করলো।
কথা বলতে বলতে দুজনের চোখেই ঘুম ধরে আসলো। তরী নৌকার ভিতরে ঢুকে পলাশকে ভিতরে এসে শুতে বললো। পলাশ ভিতরে ঢুকে নৌকার ছইয়ের পর্দা ফেলে তরীর পাশে শুয়ে পড়লো। যদিও তার চোখে এখনো ঘুম ধরেনি। গায়ে শীত শীত লাগাতে তরী আষ্টেপৃষ্ঠে পলাশকে জড়িয়ে ধরে নিলো, যেন কত কাল তারা একসাথে রয়েছে এমনভাবে। প্রেয়সীর ডাকে পলাশও সাড়া দিলো।
অগ্রহায়ণের শেষের রাত। কুয়াশার ধূসর রঙে ঢেকে আছে নদীর বুক। সারা আকাশ জুড়ে তারার মেলা। সারাদিনের কর্ম ক্লান্তির পর মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝ নদীতে আছে দূর দূরান্তের জাহাজ চলার শব্দ আর কিছুইটা আলো। বেদে পল্লীতে কোনো শব্দ নেই। কেবল সুরমা বেদেনির নৌকায় সজাগ, প্রণয়ে রত এক প্রেমিক যুগল। সভ্য সমাজের এক উচ্চ শিক্ষিত বিদেশ ফেরত প্রেমিকের সাথে চালচুলোহীন এক বেদের মেয়ের মিলনের সাক্ষী অমাবস্যার রাতের আকাশ, তারা, নদী আর জল।
ভোরের দিকে ঘুম ভাঙলো তরীর। চোখ মেলে পাশের মানুষটির দিকে চেয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ। কিছুক্ষণ পরেই মানুষটি থেকে আলাদা হয়ে যাবে সে। আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা জানা নেই। তবুও যেন অপেক্ষায় থাকবে সে। পলাশের ঘুম ভাঙতে তরী বললো, সকলে জেগে ওঠার আগে তুই ফিরে যা, সাহেব। পলাশ উঠে তরীর দিকে চেয়ে, এখনি তো চলে যাব বলে,
তরীর হাতটি ধরে বললো, আমার ঔরসজাত যেন পৃথিবীর মানুষের জন্য মঙ্গলকামী হয়।
তরী কিছু না বলে নিচের দিকে চেয়ে শাড়ির আঁচল আঙুলে প্যাঁচাতে থাকলো।
পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তরীর হাতে দিয়ে পলাশ বললো, যেদিন এই ঠিকানায় লন্ডনে তোমার চিঠি যাবে, সেদিন বুঝবো, তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি সেদিনের জন্য অপেক্ষায় থাকবো বলে নৌকা ছেড়ে সামনে পা বাড়ালো পলাশ।
যতদূর দেখা গেলো চেয়ে থেকে নিজের স্বামীর বিদায় দেখলো তরী। শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে, বেদে পল্লীর মানুষের জন্য আধুনিক জীবনের স্বপ্ন নিয়ে নৌকার দিকে এগিয়ে গেলো সে।
(রচনাকাল-২০০৭ সাল।)