প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
কৃষকের সবজি বেচে কোনোমতে খরচ উঠে ॥ হাতবদলে দাম বাড়ে কয়েক গুণ
চাঁদপুর জেলায় সবজির অন্যতম বড় পাইকারি মোকাম ফরিদগঞ্জের রুপসা বাজার। সেখানে মঙ্গলবার এক কেজি শসা বিক্রি করে কৃষক দাম পেয়েছেন ১৮ থেকে ২০ টাকা। হাতবদলের পর ফরিদগঞ্জ বাজারে খুচরা পর্যায়ে সেই শসা ক্রেতারা কিনেছেন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে। অর্থাৎ খুচরা বাজারে শসা বিক্রি হয়েছে পাইকারি বাজারের চেয়ে দুই গুণ বেশি দামে।
সবজি উৎপাদনে জড়িত কৃষকেরা বলছেন, জ্বালানি তেল, সার, বীজ, কীটনাশকসহ সবকিছুর দাম বাড়ায় সবজি উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। খেত থেকে সবজি তুলে পাইকারি বাজারে বিক্রি করে তারা যে দাম পাচ্ছেন, তাতে কোনোরকমে উৎপাদন খরচ উঠছে। আর খুচরা বাজারে সেই সবজি দুই থেকে তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা করছে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট।
খরিপ মৌসুমে চার বিঘা জমিতে নানা জাতের সবজি চাষ করেছিলেন মানিকরাজ গ্রামের মাসুদ বেপারী । তিনি বলেন, সার, কীটনাশক ও সেচ খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। তবে সেই তুলনায় বাজারে সবজির দাম মিলছে না। এক কেজি শসা হাটে নিয়ে দাম মিলছে সর্বোচ্চ ১৮ থেকে ২০ টাকা।
কৃষক শরফত আলী বলেন, গত বছর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৩২, কাঁচা মরিচ ৮০ টাকা, পটল ২০ টাকা, ঢেঁড়স ২০, মুলা ২০, কচুমুখি ২২, মিষ্টিকুমড়া ২০, শসা ৩৫, করলা ৪০, পেঁপে ৯, দেশি লাল পাকড়ি আলু ২৫, সাদা আলু ২০, জালি কুমড়া প্রতিটি ১৮ টাকা এবং ছাচি লাউ প্রতিটির দাম ৩০ টাকা ছিল। এ বছর সব কিছু দাম ডাবল। তবে আমরা কৃষকরা বেশি দামে বিক্রি করতে পারিনি।
গতকাল সকালে প্রখর রোদে ৪০ কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি করতে নয়াহাট এসেছিলেন ফরিদগঞ্জ উপজেলার হাঁসা গ্রামের কৃষক সিরাজ ছৈয়াল। মরিচ বেচে দাম পাচ্ছি ৮০ টাকা। আমাদের কাছ থেকে এই মরিচ কিনে শহরে নিয়ে বেচা হচ্চে ১৪০ টেকা কেজি।’
গোবিন্দপুর গ্রামের মনজিল হোসেন হাটে ৫ মণ করলা বিক্রি করতে এসেছেন। তিনি বলেন, গত বছর এই সময়ে এক কেজি করলা বিক্রি করেছেন ৩০ টাকা কেজি। সেই করলার দাম এই বারও ৩০ টাকাই আছে। অথচ সার, সেচসহ উৎপাদন খরচ বেড়েছে, খরচও ঠিকমতো উঠছে না।
কাঁচা বাজার পাইকারি ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত বছর হাটে সবজির যে পরিমাণ আমদানি ছিল, এবারও সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। তবে জ্বালানির দাম বাড়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনীসহ বিভিন্ন পাইকারি মোকামে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে। হাটের পাইকারি পর্যায়ে ২৫ টাকা কেজি দরে যে পেঁপে বিক্রি করছেন কৃষকেরা, শুধু হাতবদলের পর ফরিদগঞ্জ শহরের খুচরা পর্যায়ে ক্রেতাকে এই পেঁপে কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। অথচ এক কেজি পেঁপে হাট থেকে ফরিদগঞ্জ বাজার পর্যন্ত পরিবহন, আড়তদারি কমিশন, হাটের খাজনাসহ খরচ গড়ে সর্বোচ্চ দুই টাকা। এক বছর আগে পরিবহন খরচ ছিল গড়ে এক টাকা।
ফরিদগঞ্জ থেকে ট্রাকে নিয়মিত চাঁদপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম সবজি পরিবহনে করেন স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ী রুবেল মিয়া। তিনি বলেন, চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ১৫ টন সবজি পরিবহনে এক বছর আগে ভাড়া ছিল গড়ে ১২ হাজার টাকা। এখন ভাড়া ২৪ হাজার টাকা।
ট্রাক মালিক সমিতির আনোয়ার হোসেন বলেন, চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রাক যাতায়াতে ডিজেল খরচ হয় ২৫ লিটার। তেল-মবিলের সঙ্গে আরও আছে টায়ার-টিউব খরচ, চালক-সহকারীদের বেতন এবং পথের খরচাপাতিও বেড়েছে। আসা-যাওয়া মিলিয়ে পণ্য পরিবহনে ভাড়া মিলছে গড়ে ২৪ হাজার টাকা। খরচ বাদে আসা-যাওয়া মিলে গড়ে ৩ হাজার টাকা লাভ হয়।
রুপসা বাজার পাইকারি ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, ১৪ টন সবজি পরিবহনে চট্টগ্রাম ছিল আগে ১২ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর এখন ভাড়া গুণতে হচ্ছে ৩৪ হাজার ও ২৪ হাজার টাকা। পরিবহন ছাড়াও হাটের টোল খরচ, বস্তাজাত করার শ্রমিক খরচ, কুলি খরচ—সব বেড়েছে। এতে সবজি পরিবহন খরচও বেড়েছে।
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মোঃ সাফায়েত আহম্মদ বলেন, এবার রেকর্ড জমিতে শীতকালীন সবজি উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া খরিপ মৌসুমেও রেকর্ড সবজি চাষাবাদ হয়েছে। সবজি ও আলুর বাজারদর বাড়ার জন্যে কৃষক দায়ী নন, লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। হাটে সবজি বিক্রি করে কৃষক কোনোরকমে খরচ তুললেও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে হাতবদলের পর সবজির দাম কয়েক গুণ বাড়ছে।