প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আশ্বিন মাস চলছে। এই মাসে কৃষক-কৃষাণীরা সবজি চাষে লাভবান হয়।
শাকসবজি :
শাকসবজি চাষের জন্যে প্রথম ও প্রধান কাজগুলোর একটি হলো, কোন্ স্থানে কোন্ সবজির চাষ হবে ও তার জন্যে উপযুক্ত মাটি তৈরি। ২ভাগ জৈব সার (গোবর/ কম্পোস্ট/ ভার্মি কম্পোস্ট), ১ ভাগ কোকোডাস্ট ও ১ ভাগ উর্বর দোআঁশ মাটি মিশিয়ে চারার উপযোগী মাটি তৈরি করে নিতে হবে। মাটি বেশ মিহি, ঝুরঝুরে ও সমতল ভাবে তৈরি করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকবে। পর্যাপ্ত জৈব সারের পাশাপাশি পরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক সার দিতে পারেন। সবজি চারা উৎপাদনের জন্যে উঁচু এবং আলো-বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে বীজতলা তৈরি করতে পারেন। অথবা প্যাকেটে/ ছোট টবে/ সীডলিং ট্রে (seedling tray)তে এগুলোতে বীজ থেকে চারা তৈরি করে নিতে পারেন।
রবি বা শীতকালীন সবজি যেমন-বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, শিম, টমেটো, ওলকপি, শালগম, ব্রোকলি, লেটুস, আগাম জাতের ব্রাসেলস স্প্রাউট, বেগুনের উন্নত জাতের বীজ বুনতে পারেন।
ছাদবাগানে ড্রাম বা টবে বা বেডে ভালোভাবে মাটি তৈরি করে সরাসরি বীজ বপন করে লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক চাষ করতে পারেন।
লাউ ও শিমের বীজ বপনের জন্য ৭৫ সে.মি. চওড়া এবং ৬০ সে.মি. গভীর টব / ড্রাম /বেড ভালো।
লাউ ও শিমের জন্য- বেড/ টব / কাটা ড্রামের অর্ধেক সমআয়তন মাটির সাথে ১ বছরের পুরোনো শুকনো পচা গোবর সার এবং তার সাথে ১০০-১৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ৫০-৭০ গ্রাম এমওপি সার মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিবেন। ৭-১০দিন পর মাটি ওলোটপালোট করে তারপর প্রতি বেডে/ ড্রামে/ টবে ৪-৫টি সবল বীজ বপন করবেন। চারা গজানোর ১৫-২০দিন পর ২ বার করে ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০-৭০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করবেন। যারা একদমই রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে চান না, তারা চাইলে শুধু জৈবসার দিতে পারেন।
নার্সারি থেকে ৩০-৩৫ দিন বয়সী সুস্থ সবল চারা মাদা/ বেড/ ড্রামে/টবে রোপণ করতে হবে।
বেশি ঘন করে চারা লাগালে তাতে আলো, বাতাস, পানি ও মাটিস্থ পুষ্টি গ্রহণের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়, তাই প্রত্যেকটি চারা সমনির্দিষ্ট দূরত্বে লাগাতে হবে।
লাউ, শিম, বরবটি লতানো সবজি, চারা লাগানোর পর গাছগুলো বড় হতে থাকলে মাচা তৈরি করে দিবেন।
লতানো সবজির দৈহিক বৃদ্ধি তথা কাণ্ড, পাতা, শাখা-প্রশাখা যত বেশি হয়, তার ফুল-ফল ধারণ ক্ষমতা তত কম হয়। তাই ১৫-২০% লতাণ্ডপাতা কেটে দিতে হবে। তাহলে গাছে দ্রুত ফুল ও ফল ধরবে।
কুমড়া গোত্রের সবজি লাউয়ের শত ভাগ পরাগায়ন ও অধিক ফলন নিশ্চিত করতে হাত-পরাগায়ন অপরিহার্য। গাছে ফুল ধরা শুরু হলে প্রতিদিন ভোরবেলা হাতপরাগায়ন নিশ্চিত করলে ফলন অনেক বেড়ে যাবে।
অনেকেই ছাদবাগানে আলু চাষ করতে পছন্দ করেন। আলু চাষের জন্যে বিশেষভাবে মাটি তৈরি না করেই চাইলে পূর্ববর্তী মাসের ফসল উঠিয়ে সেই মাটিতেই আলু চাষ করতে পারেন।
উন্নত জাতের সরিষা-বারি সরিষা-১৪ চাষ করতে পারেন। মাসের শেষের দিকে মাটিতে বীজ ছিটিয়ে দিবেন।
বিভিন্ন প্রকার শাক যেমন- মুলাশাক, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক ইত্যাদি প্রায় সকল ধরনের মাটিতে সহজেই চাষ করতে পারেন।
বেড/ টবের মাটিতে শাকের বীজ ছিটিয়ে দেয়ার পর একটি জাল/ মশারি দিয়ে বেড /টব ঢেকে দিবেন। কারণ অনেক সময় পাখি এসে বীজ ও অংকুর খেয়ে আপনার ফসলের ক্ষতি করতে পারে। পূর্ববর্তী মাসের সবজি ফসল ফসল উঠানো বা সংগ্রহ করার পর বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন।
কাঁচাবাজারে মসলা জাতীয় ফসল রসুন, পিঁয়াজের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে। তা সত্ত্বেও দৈনন্দিন রান্নায় অতুলনীয় স্বাস্থ্যগুণসম্পন্ন এই ফসলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং তা উপলব্ধি করেও কিনতে হয়। ছাদবাগানে এখনই সময় রসুন ও পিঁয়াজের বীজ লাগিয়ে চারা করা। যেন সারাবছর নিজের উৎপাদিত ফসল থেকেই চাহিদা মেটাতে পারেন।
পরিচর্যা
চারাকে ভাইরাস বা ব্যক্টেরিয়া কিংবা ছত্রাকজনিত রোগ থেকে রক্ষার জন্য চারা লাগানোর আগেই মাটি শোধন করতে পারেন।
চারা গজানোর পর ‘গোড়া পচা’ রোগ দেখা দিলে বীজতলায় পানির পরিমাণ কমাতে হবে। দ্রুত পানি নিষ্কাশন করা বা শুকনো বালি বা ছাই ছিটিয়ে দিয়ে আর্দ্রতা অর্থাৎ পানির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। একই সাথে ডাইথেন এমণ্ড৪৫ অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড প্রয়োগ করে রোগের বৃদ্ধি রোধ করা যায়।
যারা বেডে বা ড্রামে সবুজ সার ব্যবহার করেন তারা মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে, মাটিতে মেশানোর ৭/১০ দিন পর চারা রোপণ করতে পারেন।
সবজি ফসল ২-৩ দিনের বেশি সময়ের জন্যে জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। তাই অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে গাছের গোড়ার পানি নিয়মিত নিষ্কাশন করতে হবে।
এ মাসের শেষে তাপমাত্রা হ্রাস পায় ও শুষ্কতা বাড়ে অর্থাৎ, আর্দ্রতা কমতে থাকে। তাই গাছের গোড়ার আগাছা নিড়িয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। সঠিকভাবে আগাছা ব্যবস্থাপনা কৌশল জানা থাকলে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। জৈব উপায়ে আগাছা নির্মূল করা যায়। আর আগাছানাশকের সঠিক মাত্রা বিধি মেনে প্রয়োগ করতে হবে। সরাসরি রোদ ব্যতীত ভোরে অথবা সন্ধ্যায় গাছে পানি এবং কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত।
ফলদ গাছ, ফুল ও অন্যান্য
আশ্বিন মাস কলা চারা রোপণের সবচেয়ে উপযোগী সময়। এতে ১০-১১ মাসে কলার ছড়া কাটা যায়। বিশ্বস্ত চারার উৎস থেকে কলার সাকার বা অসি চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। কলা চারা ড্রাম বা বেডে রোপণ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে চারা প্রতি ২-২.৫ মিটার (৬.৫ থেকে ৮ ফুট) দূরত্ব বজায় রেখে বেড/ ড্রাম প্রতি ৬০ সে.মি. (২ ফুট) চওড়া এবং ৬০ (২ ফুট) সে.মি. (২ ফুট) গভীর করে রোপণ করতে হবে।
ড্রাম/ বেড/ গর্ত মাটির সাথে ৫-৭ কেজি গোবর, ১২৫ গ্রাম ইউরিয়া ও তার সমপরিমাণ টিএসপি ও এওপি সার এবং ৫ গ্রাম বোরিক এসিড ভালোভাবে মিশিয়ে ৫-৭ দিন পর চারা রোপণ করতে হবে। কলা বাগানে সাথী ফসল হিসেবে যে কোনো রবি ফসল চাষ করতে পারবেন।
শীতকালীন গোলাপ চাষে ভালো জাতের গোলাপের কাটিং বা চারা সংগ্রহ করে, মাটি তৈরি করে চাষ করতে পারেন। বাগানে মশার উপদ্রব রোধে তুলসি, পুদিনা, লেমন গ্রাস, ল্যাভেন্ডার ও গাঁদাজাতীয় গাছ রাখতে পারেন।
শরতের ফুল : শাপলা, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, শিউলি, জবা, কামিনী, মালতি, মল্লিকা, মাধবি, ছাতিম ফুল, বড়ই ফুল, দোলনচাঁপা, বেলি, জারুল, কামিনি, নয়নতারা, ঝিঙে, জয়ন্ত্রী, শ্বেতকাঞ্চন, রাধাচূড়া, স্থল পদ্মা, বোগেনভেলিয়াসহ নানা রকমের কত ফুল গাছের যত্ন নেয়া।
বাগানের চারিতে বা ছোট জলাশয়ে জলজ উদ্ভিদণ্ড শাপলা, শালুক, পদ্ম ইত্যাদি চাষ করেন যারা, পানিতে কিছু গাপ্পি মাছ ছেড়ে দিলে দেখবেন মশার উপদ্রব কমে যাবে। গাপ্পি মাছ মশার ডিম, লার্ভা খেয়ে দূরে থাকবে। গ্রাম বা মফস্বলে বসবাস করছেন যারা, আপনারা বাগানে কিছু ব্যাঙ ছেড়ে দিলেও দেখবেন মশার উপদ্রব আর থাকবে না। বাগানে যেন পানি জমে না থাকে সে জন্যে পরিষ্কার রাখবেন।
যারা টবে বা ড্রামে চাষ করছেন, আপনারা গাছের ফুল ফোঁটা শেষে বীজ সংগ্রহ করে রেখে দিতে পারেন। বৃক্ষ ও গুল্ম জাতীয় গাছের ডালপালা ছেঁটে সাথে সাথে খাবার দিবেন। পরবর্তীতে বাগান হয়ে উঠবে সুসজ্জিত, আরও অপরূপ শোভাময়। এই মাসে মসলা ফসল এলাচ পেকে গেলে তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে।
পরিচর্যা
বর্ষায় বাগানের কোথায় কোনো গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হলে যত্ন নিতে ভুলবেন না। চারা যেন সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সেজন্যে খুঁটি দিয়ে চারা বেঁধে দিবেন। ফল গাছের মাটির অবস্থা বুঝে ২য় কিস্তির সার প্রয়োগ করবেন। আগাছা তুলে ফেলে তারপর সার প্রয়োগ করতে হবে।
ফলন্ত গাছ লেবু, পেয়ারা, কাঁঠাল, আম, নারিকেল, তাল, কলা, কমলা, আনারস, বাতাবি লেবু, মাল্টা, কুল ইত্যাদি গাছের গোড়ায় মাটি উঁচু করে দিতে হবে। তাহলে গাছের গোড়ায় পানি জমে গোড়া পচে যাওয়া রোধ করবে।
মাসের শেষের দিকে কার্তিক মাসের চাষের জন্যে মাটি প্রস্তুত করে নিতে হবে, বীজ থেকে চারা তৈরির সময় ঘন ও দুর্বল চারা তুলে ফেলতে হবে।
গাছপালার রোগ ও পোকামাকড়
সবজিতে ফল ছিদ্রকারী পোকা, এফিড বা জাব পোকা, বিভিন্ন বিটল পোকা সবুজ পাতা খেয়ে ফেলতে পারে। তাই এদের দমন করার জন্যে হাত বাছাই অবলম্বন করতে পারেন। পোকা ধরার ফাঁদ ব্যবহার করতে পারেন। ছাইগুঁড়া ব্যবহার করতে পারেন। জৈব কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন। গাছের কাঁটা অংশে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। ডেঙ্গু মশা রোধে বাগান পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাগানের কোনো স্থানে পানি জমতে দেয়া যাবে না। জৈব উপায়ে মশা মাছি রোধ করা ভালো। বিছাপোকা এবং লেদাপোকা আক্রমণ করে থাকে। এরা দলবদ্ধভাবে পাতা ও ডগা খেয়ে অনেক ক্ষতি করে থাকে। এদের আক্রমণ রোধ করতে পোকার ডিমের গাদা, পাতার নিচ থেকে পোকা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
বাসার আশপাশ ফাঁকা থাকলে অর্থাৎ গাছপালা কম থাকলে পাখির আনাগোনা কম দেখা যায়। পাখি বসার জন্যে একটা আসন তৈরি করে দিলেন। তাহলে দেখবেন পোকা খাদক পাখি যেমন শালিক, ফিঙ্গে ইত্যাদি পাখি বাগানের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে আপনার বাগান সুরক্ষিত রাখবে।
পোকার আক্রমণ খুব বেশি হলে ফাইটার ২.৫ ইসি/ নাইট্রো ৫০৫ ইসি ১মিলি/লিটার মাত্রায় সঠিক সময়ে প্রয়োগ করতে হবে।