বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

ভাদ্র মাসে কৃষিতে করণীয়
কৃষিকণ্ঠ প্রতিবেদক ॥

চাঁদপুরে বর্ষা ঋতুতে ভাদ্র মাসেও ঝরছে অঝোর ধারার বৃষ্টি। প্রকৃতির এ খেয়াল কৃষির জন্য যতটুকু না সফলতা বয়ে আনে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করে। কৃষির এ ক্ষতি মোকাবিলায় আমাদের নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থাপনা। কৃষির ক্ষতিটাকে পুষিয়ে নেয়া এবং প্রয়োজনীয় কাজগুলো যথাযথভাবে শেষ করার জন্য ভাদ্র মাসে কৃষিতে করণীয় বিষয়গুলোর ওপর নজর দিয়েছেন ঢাকা ফার্মগেটস্থ কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অফিসার (কৃষি) কৃষিবিদ মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন । তাঁর পরামর্শ কৃষক কৃষাণীর জন্য নি¤েœ তুলে ধরা হলো।

আমন ধান

আমন ধান ক্ষেতের অন্তর্বর্তীকালীন যত্ন নিতে হবে; ক্ষেতে আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করার পর ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আমন ধানের জন্যে প্রতি হেক্টর জমিতে ২০০ কেজি ইউরিয়া সার প্রয়োজন হয়। এ সার তিন ভাগ করে প্রথম ভাগ চারা লাগানোর ১৫-২০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৩০-৪০ দিন পর এবং তৃতীয় ভাগ ৫০-৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।

নিচু জমি থেকে পানি নেমে গেলে এসব জমিতে এখনও আমন ধান রোপণ করা যাবে। দেরিতে রোপণের জন্যে বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান ৩৮, ব্রি ধান ৪৬, বিনাশাইল, নাইজারশাইল বা স্থানীয় উন্নত ধান বেশ উপযোগী। দেরিতে চারা রোপণের ক্ষেত্রে প্রতি গুছিতে ৫-৭টি চারা দিয়ে ঘন করে রোপণ করতে হবে।

আমন মৌসুমে মাজরা, পামরি, চুঙ্গি, গলমাছি পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া খোলপড়া, পাতায় দাগপড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে, জমিতে খুঁটি দিয়ে, আলোর ফাঁদ পেতে, হাতজাল দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাছাড়া সঠিক বালাইনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক নিয়মে, সঠিক সময় শেষ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

পাট

বন্যায় তোষা পাটের বেশ ক্ষতি হয়। এতে ফলনের সঙ্গে সঙ্গে বীজ উৎপাদনেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। বীজ উৎপাদনের জন্যে ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত দেশি পাট এবং আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত তোষা পাটের বীজ বোনা যায়।

বন্যার পানি উঠে না এমন সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে জো বুঝে প্রতি শতাংশে লাইনে বুনলে ১০ গ্রাম আর ছিটিয়ে বুনলে ১৬ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।

জমি তৈরির সময় শেষ চাষে শতক প্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৬৫০ গ্রাম টিএসপি, ৮০ গ্রাম এমওপি সার দিতে হবে। পরবর্তীতে শতাংশ প্রতি ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম করে দুই কিস্তিতে বীজ গজানোর ১৫-২০ দিন পরপর জমিতে দিতে হবে।

আখ

এ সময় আখ ফসলে লালপচা রোগ দেখা দিতে পারে। লালপচা রোগের আক্রমণ হলে আখের কাণ্ড পচে যায় এবং হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। এজন্যে আক্রান্ত আখ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

এছাড়া রোগমুক্ত বীজ বা শোধন করা বীজ ব্যবহার করলে অথবা রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করলে লালপচা রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

লালপচা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন কয়েকটি আখের জাত হচ্ছে ঈশ্বরদী ১৬, ২০, ২১।

তুলা

ভাদ্র মাসের প্রথম দিকেই তুলার বীজ বপন কাজ শেষ করতে হবে। বৃষ্টির ফাঁকে জমির জো অবস্থা বুঝে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে বিঘাপ্রতি প্রায় ২ কেজি তুলা বীজ বপন করতে হয়। লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৩০ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার বজায় রাখতে হয়।

তুলার বীজ বপনের সময় খুব সীমিত। তাই হাতে সময় না থাকলে জমি চাষ না দিয়ে নিড়ানি বা আগাছানাশক প্রয়োগ করে জমি আগাছামুক্ত করে ডিবলিং পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। বীজ গজানোর পর কোদাল দিয়ে সারির মাঝখানের মাটি আলগা করে দিতে হবে।

সমতল এলাকার জন্য সিবি-৯, সিবি-১২, হীরা হাইব্রিড রূপালী-১, ডিএমণ্ড২, ডিএমণ্ড৩ অথবা শুভ্র জাতের চাষ করতে পারেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ি তুলা-১ এবং পাহাড়ি তুলা-২ নামে উচ্চফলনশীল জাতের তুলা চাষ করতে পারেন।

শাকসবজি

ভাদ্র মাসে লাউ ও শিমের বীজ বপন করা যায়। এজন্যে ৪-৫ মিটার দূরে দূরে ৭৫ সে.মি. চওড়া এবং ৬০ সে.মি. গভীর করে মাদা বা গর্ত তৈরি করতে হবে।

এরপর প্রতি মাদায় ২০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৭৫ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। মাদা তৈরি হলে প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ বুনে দিতে হবে এবং চারা গজানোর ২-৩ সপ্তাহ পর দুই-তিন কিস্তিতে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৭৫ গ্রাম এমওপি সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। এ সময় আগাম শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদনের কাজ শুরু করা যেতে পারে। সবজি চারা উৎপাদনের জন্য উঁচু এবং আলো বাতাস লাগে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে।

এক মিটার চওড়া এবং জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে লম্বা করে বীজতলা করে সেখানে উন্নত জাতের ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো এসবের বীজ বুনতে পারেন।

গাছপালা

ভাদ্র মাসেও ফলদ বৃক্ষ এবং ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা যায়। বন্যায় বা বৃষ্টিতে মৌসুমের রোপিত চারা নষ্ট হয়ে থাকলে সেখানে নতুন চারা লাগিয়ে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে হবে।

এছাড়া এ বছর রোপণ করা চারার গোড়ায় মাটি দেয়া, চারার আতিরিক্ত এবং রোগাক্রান্ত ডাল ছেঁটে দেয়া, বেড়া ও খুঁটি দেয়া, মরা চারা তুলে নতুন চারা রোপণসহ অন্যান্য পরিচর্যা করতে হবে।

ভাদ্র মাসে আম, কাঁঠাল, লিচু গাছ ছেঁটে দিতে হয়। ফলের বোঁটা, গাছের ছোট ডালপালা, রোগাক্রান্ত অংশ ছেঁটে দিলে পরের বছর বেশি করে ফল ধরে এবং ফল গাছে রোগও কম হয়।

প্রাণিসম্পদ

ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমে পোলট্রি শেডে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে। আর টিন শেডে চটের ছালা রেখে মাঝে মাঝে পানি দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে। যাতে করে অধিক গরমে মুরগিগুলো মারা না যায় এবং নানা রোগের বিস্তার না ঘটে। ভেজা আবহাওয়া ও মাঝে মাঝে গরম পোলট্রির ক্ষেত্রে গামবোরো রোগের সংক্রমণ বৃদ্ধি করে। এ রোগে মুরগির পালক নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। গা গরম ও কাঁপুনি দেখা দেয়। সাদা পানির মতো পাতলা পায়খানা দেখা যায়। মুরগি সহজে নড়ে না। এমনিতে ভাইরাসজনিত এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তবে আছে সতর্কতা ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। বাংলাদেশে গোখাদ্যের সমস্যা এখনও বিরাজমান। সে কারণে পতিত জমিতে নেপিয়ার, বাজরা, খেসারি, মটর, ইপিল ইপিল, গিনি ঘাস লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দুগ্ধবতী গাভী পালন এবং যারা গরু মোটাতাজাকরণ করবেন, তাদের অবশ্যই গবাদি পশুকে সুষম খাবার সরবরাহ করতে হবে। কোনো জায়গায় যদি পানি জমে থাকে সে এলাকায় জন্মানো ঘাস গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে না। কারণ এতে গাভী বা গরুর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।

গরু ও ছাগলকে নিয়মিত গোসল করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে অসুখণ্ডবিসুখ কম হয়।

গোয়াল ঘরের গোবর চনা নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার। আর গরুর গায়ের আঠালি, মাছি, জোঁক, পোকামাকড় বেছে দিতে হবে।

তড়কা, বাদলা, গলাফুলা রোগ যাতে না হয় সেজন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারি সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

মৎস্যসম্পদ

পুকুরে সার ব্যবহারের মাত্রা আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলতে হবে। জৈব সার ব্যবহার না করাই ভালো। খাদ্য ঘাটতির জন্য পরিমাণ মতো অজৈব সার ব্যবহার করা দরকার। পুকুরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। পুকুরে নতুন মাছ ছাড়ার সময় এখন। মাছ ছাড়ার আগে পুকুরের জলজ আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। পুকুর জীবাণুমুক্ত করে সঠিক সংখ্যক সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে। যেসব পুকুরে মাছ আছে সেসব পুকুরে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা দরকার।

রোগের আক্রমণ থেকে মাছ রক্ষা করতে স্থানীয় উপজেলা মৎস্য অফিসের সহায়তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি পুকুরে পাঙ্গাশ মাছের চাষ, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ, প্লাবিত এলাকায় ঘেরের মাধ্যমে রাজপুঁটি ও চিংড়ির চাষ, পুকুরে রুই জাতীয় ও চিংড়ির মিশ্র চাষ এবং প্লাবিত এলাকায় খাঁচায় মাছ চাষ করা যেতে পারে।

বন্যার কারণে ভেসে যাওয়া পুকুরের মাছ পুকুরে রাখতে যা করা প্রয়োজন--সেটি হলো ভেসে যাওয়া পুকুরগুলোর ১৫ থেকে ২০ মিটার দূরত্বে একটি চটের ব্যাগে ৫ থেকে ৭ কেজি ধানের কুড়া বা গমের ভুসি ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পানির নিচে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। তবে ব্যাগটিতে অবশ্যই ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে। খাবার পেয়ে মাছ পুকুরেই অবস্থান করবে।

কোনো কারণে পুকুরের পানি যদি দূষিত হয়, তবে ভাইরাস, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে মাছের ক্ষত রোগ দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেহের ভারসাম্যহীনতা, শরীরে লাল দাগ দেখা যায়। পরে মাছ ক্ষত রোগে মারা যায়। এ রোগ প্রতিকারে অধিক আক্রান্ত মাছ উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। প্রতি শতক পুকুরে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হবে। ছোট ও ব্রুড মাছের জন্য প্রতি কেজি খাদ্যের সঙ্গে ৬০ থেকে ১০০ মিলিগ্রাম টেরামাইসিন মিশিয়ে মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে।

সুপ্রিয় কৃষিজীবী ভাইবোন, বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি এখন সবুজ শ্যামলিমায় ভরপুর, কাশবনের আলোড়ন সবই প্রকৃতির দান। সেসঙ্গে বন্যা, প্লাবন আমাদের নিত্য সহচর। সব কৃষক ভাইয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের কৃষিকে নিয়ে যাবে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। সবার জন্য নিশ্চিত সফল কৃষি উৎপাদন কামনা করে এ মাসের কৃষি এখানেই শেষ করলাম। সবাই খুব ভালো থাকবেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়