প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ হলেও এদেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে বর্তমান সরকার যুগোপযোগী পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ফলে এদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে করোনা নামক ভয়াবহ ভাইরাসের আক্রমণে পৃথিবীতে নেমে এসেছে এক সংকট। এ সংকটকালে বিশ্বের সর্বত্রই দেখা দিতে শুরু করেছে অর্থনৈতিক সমস্যা এবং খাদ্য ঘাটতি। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশে এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে। সে নির্দেশনা অনুসারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এবং তা বাস্তবায়নে অত্র অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতভাবে চাষের জমি প্রতি বছরে প্রায় ১ শতাংশ হারে কমছে, এক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার পথ দেখাতে পারে পতিত জমি এবং বসতবাড়ির বিভিন্ন অংশ, যা মোট জমির প্রায় ৫ শতাংশ। কিন্তু সব বসতবাড়ির আঙিনার জমি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার হচ্ছে না।
অধিক জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্যে বাড়ির কৃষাণীরাই পারে সারা বছর সবজি চাষ করে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে। পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদিত সবজি বাজারে বিক্রি করে অর্থ আয় করতে। তাতে তার অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসবে। শাকসবজি পরিমিত পরিমাণে নিয়মিত খেলে পুষ্টিজনিত সমস্যা দূর করা যাবে এবং দেশে নারীসহ পারিবারিক স্বকর্মসংস্থান বাড়বে।
বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি চাষের সুবিধা
অল্প পরিমাণ জমিতে অনেক ধরনের সবজি ও ফল আবাদ করা যায়। সবজি আবাদে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে। একই জমিতে বছরে ক’বার সবজি চাষ করা সম্ভব। পুষ্টির দিক থেকে প্রায় সব শাকসবজি উন্নতমান সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে বছরব্যাপী উপযুক্ত পরিমাণ সবজি খেয়ে পুষ্টিহীনতা দূর করা এবং রোগমুক্ত থাকা সম্ভব হয়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বিক্রি করে পরিবারের জন্যে বাড়তি আয়ের সংস্থান করা যায়। বসতবাড়ির আঙিনায় পরিবারের নারী ও ছেলে-মেয়েদের অবসর সময়ে সবজি চাষের কাজে লাগিয়ে পারিবারিক শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
সবজি চাষে কৃষাণীর প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা
বসতবাড়ির যে জায়গায় দিনের বেশির ভাগ সময় রোদ লাগে এমন জায়গা নিবিড় সবজি আবাদের জন্যে সবচেয়ে বেশি উপযোগী। আঙিনায় আলো আসার পথে বাধা দেয়া বাড়ির আশপাশের বড় গাছের ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। ভবিষ্যতে বড় হয়ে ছায়া সৃষ্টি করতে পারে এমন গাছও জন্মাতে দেয়া যাবে না। এমন রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গায় সারা বছর অর্থাৎ শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে সব ধরনের সবজি কৃষাণীরা চাষ করতে পারবেন। আবার ছায়া পছন্দ করে এমন সবজি ও মসলা ফসল ছায়াযুক্ত স্থানে চাষ করে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষাণীরা পারিবারিক পুষ্টি চাহিদাও মিটাতে পারেন। আর এজন্যে কৃষাণী বোনদেরকে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ সংগ্রহে রাখতে হবে ও মৌসুমের একটি তালিকা করে রাখতে হবে অথবা এ বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে বা দক্ষদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে চাষাবাদের বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে।
বাড়ির পাশে খালি জায়গায় সবজি চাষের নকশা
সবজি ফসলের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যার সুবিধার জন্যে প্রতিটি প্লট প্রস্থে সর্বোচ্চ ১ মিটার এবং দুই প্লটের মাঝে ও তার চারদিকে ২৫-৫০ সেঃমিঃ জায়গা নালা হিসেবে ব্যবহারের জন্যে এবং সেচনালার জন্যে আরও ১ মিটার জায়গা রাখতে হবে। যাতে সেচের বা বর্ষার অতিরিক্ত পানি বাগান থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। তবে বাগানের যে দিকটা লম্বা সে দিকটি প্লটের দৈর্ঘ্য হিসেবে রাখতে হবে। সেচের সুবিধার জন্যে বাগানের উঁচু অংশে হস্তচালিত নলকূপ, রোয়ার পাম্প বা ট্রেডেল পাম্প বসালে সহজে বাগানে পানি দেয়া যায়।
সবজি বাগানের জন্যে সুপারিশকৃত শস্যবিন্যাস
সবজি বাগানের চারটি বেডে সারা বছর উৎপাদনের জন্যে নিম্নেবর্ণিত চারটি সবজি বিন্যাস অনুসরণ করার জন্যে কৃষাণীদেরকে সুপারিশ করা হচ্ছে : প্রথম বেড : টমেটো/মুলা-ডাঁটা-গীমাকলমি; দ্বিতীয় বেড : লালশাক/বাঁধাকপি-ডাঁটা-ঢেঁড়স; তৃতীয় বেড : বেগুন/লালশাক-পুঁইশাক-গীমাকলমি; চতুর্থ বেড : ঝাড় শিমণ্ডলালশাক-পুঁইশাক/বরবটি।
বাড়ির স্থানভিত্তিক ফসল নির্বাচন
ঘরের ছাদে বা চালে চালকুমড়া, লাউ, মিষ্টিকুমড়া বা লতাজাতীয় সবজি ফলানো যায়। নারিকেল গাছ, পেঁপে, ডালিম গাছ ইত্যাদি বাড়ির গেটে, বাড়ির সীমানা বেড়ায় লতাজাতীয় সবজি যেমন ধুন্দুল, ঝিঙা চাষ করা যায় এবং নারিকেল গাছ, লেবুগাছ, কম প্রচলিত সবজি যেমন কাঁচকলা, সজিনা, বকফুল ও পেঁপে ইত্যাদি বাড়ির সীমানায় চাষ করা যায়। কলপাড়ে বা টিউবওয়েলের (স্যাঁতসেঁতে স্থানে) পাড়ে, পানির ড্রেনেও লতিকচু, মুখীকচু, মানকচু, দুধকচু ইত্যাদি চাষ করা যাবে। মসলার মধ্যে আছে আদা ও হলুদ, বিলাতী ধনিয়া ইত্যাদি বড় গাছের ছায়ায়, মাচার নিচের জায়গায় চাষ করা যাবে। লতাজাতীয় ফসল যেমন : পান, গোলমরিচ ও মেটে/গাছ আলু বাড়ির কৃষাণী খুব সহজেই চাষ করতে পারেন। বাড়ির আঙিনায় মাচা করে লতাজাতীয় সবজির মধ্যে শিম, বরবটি, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, শসা, চিচিংগা, ঝিঙা, ধুন্দুল ও করলা ইত্যাদি সবজি চাষ করা যায়। বাড়ির পাশের পুকুরের পাড়ে নারিকেল, সুপারি, পেঁপে পুকুরের ঘেরে চাষ করা যায় এবং পুকুরের পানির ওপরে মাচা করে মিষ্টিকুমড়া, লাউ, শসা, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি চাষ করা যায়। এছাড়াও মৌসুমভিত্তিক শাকসবজি চাষের বর্ষপঞ্জি ছক দ্রষ্টব্য।
সবজির আন্তঃপরিচর্যা
অধিক ফলনের জন্যে কৃষাণীকে মাদায় ও জমিতে কম্পোস্ট ও সার প্রয়োগ, মালচিং, আগাছা পরিষ্কার, সেচ প্রয়োগ, রোগবালাই ও পোকামাকড় সমন্বিত পদ্ধতিতে দমন করতে হবে।
কৃষিবিদ সাবিনা ইয়াসমিন : উপজেলা কৃষি অফিসার, সংযুক্ত : হর্টিকালচার উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।