প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
মাছ চাষ অনেকেই শখ থেকে করে। আবার কেউবা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে। বর্তমানে রঙিন মাছ সকলের কাছে জনপ্রিয়। কেননা এ মাছ বাড়িতে অ্যাকুরিয়ামে চাষ করা যায়। কিন্তু অনেকেই জানেন না এই রঙিন মাছ অন্য মাছের মতো পুকুরেও চাষ করা যায়। বাড়ির পাশে ছোট পুকুরে এই মাছ লাভজনকভাবে চাষ করা যায়। অন্য মাছের মতো পরিচর্যা করলেই চলে। পড়ালেখার পাশাপাশি রঙিন মাছ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা মোঃ নাঈম পাঠান।
হাইমচর উপজেলার ২নং উত্তর আলগী ইউনিয়নের ভিঙ্গুলিয়া গ্রামের তরুণ এ উদ্যোক্তা রঙিন মাছ চাষে সফল হয়েছেন। তিনি উত্তর আলগী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোঃ বশির উল্লাহ পাঠানের তৃতীয় পুত্র। এছাড়া তার বাবার রয়েছে ২০টি পুকুর। সেখানে ১২ জন শ্রমিক কাজ করেন। আর নাঈমের অধীনে কাজ করেন ৪ জন শ্রমিক। তাদের দৈনন্দিন ৫০০ টাকা হাজিরা দেয়া হয়।
নাঈম ২০১৯ সালের শুরুতে বাড়ির আঙিনায় একটি পরিত্যক্ত জমিতে ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোলেন রঙিন ফিশ ফার্ম। পোনা কেনা, খাবার দেয়াসহ নানা কাজে তার খরচ হয়েছিলো ১০ হাজার টাকা। বছর ঘুরতেই মাছ বিক্রি করেছেন প্রায় এক লাখ টাকা। পরে সেই মাছ পুকুরে চাষ করেন।
বিভিন্ন জেলা থেকে রঙিন মাছ আমদানি করেন মোঃ নাঈম পাঠান। সেই পোনা বড় করে বিক্রি করেন তিনি। বাবার সাদা মাছ চাষই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি এখন নিজেই হ্যাচারীর মাধ্যমে রেণু উৎপাদন করেন এবং মৎস্যপ্রেমীদের কাছে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। নিজ বাড়িতে পরীক্ষামূলক রঙিন মাছের চাষ শুরু করলেও এখন তিনি বিভিন্ন জনের কাছে এ মাছ বিক্রি করেন। নাঈমের বাড়িতে এখন সারি সারি চৌবাচ্চা। সেখানে আছে নানা রঙের মাছ। তার মধ্যে কই কার্প, কমেট কার্প ও গোল্ড ফিসের চাহিদা বেশি। বর্তমানে তার খামারে নানা জাতের মাছ রয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৫ লাখ টাকা।
২২ বছর বয়সী মোঃ নাঈম পাঠান এইচএসসি পাস করেছেন। ডিগ্রিতে ভর্তি হবেন। তিনি পড়ালেখাও করেন। মাছচাষও করেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখতেন তার বাবা বিভিন্ন প্রজাতির মাছচাষ করতেন। কিন্তু তার বাবা রঙিন মাছ চাষ করেনি। বাবার সাথে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানে অ্যাকুরিয়ামের রঙিন মাছ চাষ দেখেন তিনি। তখন থেকে রঙিন মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হন নাঈম। পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়িতে পরীক্ষামূলক রঙিন মাছের চাষ শুরু করে লাভের মুখও দেখেন।
নাঈম বলেন, ২০১৯ সালের থেকে বড় আকারে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ শুরু করি। এর আগে বাবার সাথে মাছ চাষ করতাম। এখন আমি নিজে ৩টি চৌবাচ্চা স্থাপন করি। চৌবাচ্চায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে। প্রথমে ১০ হাজার টাকার রঙিন মাছ কেনেন। পরে খামার গড়ে তুলতে মাছ, বিদ্যুৎ, অবকাঠামোসহ মোট ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় মা মাছ আমদানি করছেন নাঈম। এই রঙিন মা মাছ পোনা ছাড়ছে। এই পোনা মাছ বড় করে তিনি বিক্রি করছেন। খামারে আছে অক্সিজেন ব্যবস্থা।
মাছ বিক্রির জন্যে তাকে হাট-বাজারে যেতে হয় না। খামারের নামে রয়েছে ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল, গুগল বিজনেস। এসব ব্যবহার করে অনলাইনের মাধ্যমে তিনি ঘরে বসেই সারা দেশে রঙিন মাছ বিক্রি করছেন। বিকাশ ও ব্যাংক হিসাবে টাকা নিয়ে কুরিয়ারে বিশেষ ব্যবস্থায় মাছ অর্ডারদাতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এভাবে শতকরা ৯০ ভাগ মাছ খুচরা ও পাইকারি দামে তিনি বিক্রি করছেন।
তিনি বলেন, মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে মাছসহ খামারে প্রায় কয়েক লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ রয়েছে। বর্তমানে খরচ বাদে তার মাসিক আয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। এক একটি রঙিন মাছের দাম ১৫ টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এখন তার খামারে প্রায় নানা জাতের মাছ রয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৫ লাখ টাকা।
নাঈম জানান, আমার হ্যাচারীর কাজ চলমান রয়েছে। সামনে আমি আরো ১৫ থেকে ২০ প্রজাতির মাছ চাষ করবো। বর্তমানে কই কার্প মাছ ৪-৫ ইঞ্চি ২০-৩০ টাকা। কমেট কার্প মাছ ৪-৫ ইঞ্চি ২০-৩০ টাকা ও গোল্ড ফিস মাছ ৩-৪ ইঞ্চি ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নাঈম বলেন, ভবিষ্যতে খামারটি আরও বড় আকারে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রয়োজনীয় মূলধন ও কারিগরি সমস্যার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে রঙিন মাছের আমদানি বেড়েছে। সরকার সহযোগিতা করলে দেশেই রঙিন মাছ উৎপাদন সম্ভব। তবে আগামী বছর শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা মাছসহ দেশি প্রজাতির মাছের রেণু উৎপাদন করবেন তিনি।
তিনি জানান, কেউ যদি আমার কাছ থেকে রঙিন মাছ নিতে চান, কোনো মাধ্যম না ধরে সরাসরি আমার সাথে যোগাযোগ করে নিতে পারেন। আমার এই ফোন নম্বরে ০১৬০৯-৬৭৬৫৬০, ০১৬৪৮-৩১৪৫৫৪ যোগাযোগ করে রঙিন মাছ ক্রয় করতে পারবেন। এছাড়া কেউ যদি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন তাহলে আমাদের নিজস্ব পরিবহনে রঙিন মাছ এবং অন্যান্য মাছের রেণু পৌঁছে দিতে পারবো।
হাইমচর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মাহবুব রশিদ জানান, হাইমচরে এ প্রথম রঙিন মাছের চাষ হচ্ছে। এ মাছের বেশ চাহিদা তরুণ প্রজন্মের কাছে। ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ মাসে এরা প্রজনন করে। প্রতিটি মাছ ২-৩ হাজার ডিম দেয়। ডিমসহ কচুরিপানাগুলো পুকুরের পানিতে আলাদা করে হ্যাচিং নেটের ভেতরে রাখা হয়। এর ৭২ ঘণ্টা পর ডিমগুলো ফুটে পোনা তৈরি হয়।
তিনি জানান, এক কেজি ওজনের প্রতিটি মাছ ৩-৪ হাজার টাকা। ২০-৩০ দিন বয়সী পোনা মাছ ২শ’ থেকে ১ হাজার টাকা বিক্রি হয়। ১ বছর বয়সী মাছ প্রজননক্ষম হয়। খাওয়ার চেয়ে অ্যাকুরিয়ামে পালনের জন্যে এ মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঘরের সৌন্দর্যের জন্যে অ্যাকুরিয়ামের মাধ্যমে মাছ পালন করেন অনেকেই।