প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
বিতর্ক উন্মুক্ত করে মুক্তচিন্তা
জগৎ হলো মুক্তচিন্তার এক নান্দনিক মহামঞ্চ। জগতের সৌন্দর্যে যেমন ফুল-পাখি-লতাপাতা ও সাগর-অরণ্যের অবদান আছে তেমনি অবদান আছে মুক্তচিন্তার। মুক্তচিন্তাই হলো জগত বিনির্মাণের মুখ্য হাতিয়ার। জগতে আজকের এই নব নব আবিষ্কারের পেছনে মুক্তচিন্তার অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তচিন্তা যেমন কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা তৈরি করে তেমনি সেই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পেতেও সাহায্য করে। মুক্তচিন্তা ব্যতীত কোনো জিজ্ঞাসার সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ মুক্তচিন্তাজাত জিজ্ঞাসা জগৎকে একদিকে চিনতে সাহায্য করে আর অন্যদিকে উদ্ভূত জিজ্ঞাসার সমাধান জগৎকে বিনির্মাণে ভূমিকা রাখে। সোজা কথায় বলতে গেলে, মুক্তচিন্তাই জীবন ও জগৎকে বাঁচিয়ে রাখে নান্দনিক সুষমায়।
|আরো খবর
একজন বিতার্কিকের জন্যে মুক্তচিন্তাই হলো যুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার ঢাল-তরোয়াল। যার মুক্তচিন্তার ধার যত ঋদ্ধ সে তত বেশি ভালো একজন বিতার্কিক। মুক্তচিন্তাই সত্য উদ্ঘাটনে আলোকসম্পাত করে। বিতর্কের উদ্দেশ্যই হলো যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সত্যকে উন্মোচন করা ও সমাধানে উপনীত হওয়া। এক্ষেত্রে মুক্তচিন্তা হলো সমস্যার সমাধানে উপনীত হওয়ার শুদ্ধ ও সঠিক বাহন। যে এ বাহনের যাত্রী, তার গন্তব্যে উপনীত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এক একজন বিতার্কিক আসলে এক একজন অভিযাত্রী। অভিযাত্রীরা যেমন দুর্গম অজানা পথে ভ্রমণ করে অদেখাকে দেখে, অজানাকে জানে, তেমনি বিতার্কিকও মুক্তবুদ্ধি নামের জ্ঞানশকটে চড়ে পাড়ি দেয় যুক্তির জালে আটকে পড়া সত্যকে অবমুক্ত করার অভিপ্রায়ে।
অন্যের চিন্তা ধার করে যে চলে সে হয়ে যায় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধী। অন্যের ধার করা একশ’টি যুক্তির চেয়ে নিজের একটি দুর্বল যুক্তিও শতগুণে ভালো। কেননা এই স্বকীয় চিন্তাই ক্রমে ক্রমে ব্যক্তিকে করে তোলে প্রত্যয়ী ও পরিণত। মুক্তচিন্তাহীন জগৎ অসার। মুক্তচিন্তার পরিমিত প্রবাহ জীবনের জন্যে হয়ে ওঠে বাঁচার প্রেরণা। মুক্তচিন্তাই মানুষকে কোনো বিষয়ের ভালোমন্দ উভয় দিক বিবেচনা করার সামর্থ্যরে যোগান দেয়। মানুষ ভালোকে ভালো এবং মন্দকে মন্দ বলতে পারে মুক্তচিন্তার বদৌলতে। নিরাভরণ রাজাকে সবাই যখন ভয়ে ও তোষামোদে কিছু বলতে পারছিলো না, তখন এক শিশুই তার মুক্তচিন্তাকে অটুট রেখে রাজার নগ্নতার কথা স্বয়ং রাজাকে শোনাতে পেরেছিলো। অর্থাৎ এ উদাহরণে স্পষ্টভাবেই বুঝা যায়, মুক্তচিন্তা ব্যক্তিকে সাহসী করে তোলে।
বিতর্ক হচ্ছে আসলে যুক্তির দাবা খেলা। যার যুক্তি যতবেশি সুসংহত সে ততবেশি বিজয়ী হওয়ার সুযোগ থাকে। যুক্তিকে সুসংহত করে মুক্তচিন্তা। সুসংহত যুক্তির বলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায় খুব সহজেই। মুক্তচিন্তা যেমন সতত প্রগতিশীল তেমনি বিতার্কিকের যুক্তিও সতত প্রগতিময়। কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিতার্কিক নিজেকে আবদ্ধ রাখেন না। তিনি জানেন, সময়ের ফেরে সত্যে পৌঁছানোর পথ যেমন পরিবর্তনশীল তেমনি একজন মুক্তচিন্তকের কাছেও চিন্তার পরমবিন্দু বলে কিছু নেই। বিতর্ক কেবল বাচিক শিল্পের উৎকর্ষ ঘটায় না, বিতর্ক ব্যক্তির মস্তিষ্কে জটপাকানো চিন্তাকে অবমুক্ত করে স্বাধীন রূপ দেয়। ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার শক্তি অসির চেয়েও ধারালো এবং কার্যকর। মুক্তচিন্তার মাধ্যমে সংঘটিত পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই। এতে মনোজগতের নির্মাণ যেমন গতি পায় তেমনি মানুষও মনুষ্যত্ববোধে উদ্ভাসিত হয়।
প্রাচীন গ্রীসে গুরুগৃহকেন্দ্রিক শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করতে ও সত্যে উপনীত হতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্কের অবতারণা করা হতো। এর মাধ্যমে শিক্ষা স্থায়ীভাবে শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে যেতো। এই শিক্ষাপদ্ধতিতে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। ফলে অধীত জ্ঞান কার্যকারিতা লাভ করতো। আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষে বিতর্ক চর্চার অনুশীলন ও গুরুত্ব বাড়ানো হলে আমাদের শিক্ষার্থীরা মননশীল চিন্তক হয়ে বেড়ে উঠতে পারবে।
মুক্তচিন্তাহীন মানুষ পরাধীন মানুষের সমতুল্য। প্রতি পদে পদে তাকে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। ভিক্ষুকের যেমন কোনো নিজস্বতা নেই তেমনি মুক্তচিন্তাহীন ব্যক্তিরও নিজস্বতা থাকে না। বিতর্ক মানুষের মুক্তচিন্তাকে উন্মীলিত করে। বিতর্কচর্চা ব্যক্তির মুক্তচিন্তাকে ঋদ্ধ করে। কাজেই মুক্তচিন্তার সক্ষমতা ও বিতর্ক চর্চা একে অন্যের পরিপূরক। মুক্তচিন্তাহীন ব্যক্তি আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধীর মতো। যে যা বলে তাতেই নির্ভর করে তাকে থাকতে হয়। যার মুক্তচিন্তার সক্ষমতা আছে, সে অন্যের উপর প্রভাব তৈরি করতে পারে। ব্যক্তির মুক্তচিন্তার ক্ষমতাকে পরিণতি দিতে পারে বিতর্ক। কাজেই বিতর্কে আসুন, নিজের স্বতন্ত্র চিন্তাশক্তিকে নির্মাণ করুন। কেননা বিতর্কই হলো সভ্য মানুষের সমৃদ্ধির কার্যকর বাহন।
ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া : সব্যসাচী লেখক; অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমী।