প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
বর্ষার ছড়া পড়তে পড়তে প্রকৃতিতে কখন যে বর্ষা এসে পড়েছে কবিতা তা বুঝে উঠতে পারেনি। জানালার শিক গলিয়ে হিমেল পরশ আসছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিকণা ওর কাজল কালো চুলে এসে পড়ছে। মুক্তাদানার মতোই চিক চিক করছে। বেশ লাগছে ওর। কবিতা জানালার বাইরে দু’হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁতে চায়। রাশি রাশি বৃষ্টিধারা ওর দু’হাতে চুমু খায়। কবিতা আবার পড়তে শুরু করে-
“আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো
গেলরে দিন বয়ে
বাঁধন হারা বৃষ্টি ধারা
ঝরছে রয়ে রয়ে।”
বৃষ্টি নামলে কবিতার মন ভালো হয়ে যায়। আবার কখনো খারাপ হয়ে যায়। এমন বাদল দিনে কবিতা তার ¯েœহের বাবাকে হারিয়েছিল চিরদিনের জন্য। গত বছর বর্ষায় তার বাবা প্রবাস কর্মস্থল থেকে দেশে ফিরছিলেন। পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। ঐ বছর কবিতা জুনিয়র সমাপনী (জেএসসি) পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ পায়। মেয়ের এই সাফল্য অল্পের জন্য দেখে যেতে পারেননি তার বাবা। কবিতা বৃষ্টি হলেই এসব ভেবে স্মৃতির মেঠোপথে হারিয়ে যায়। তখন শুধুই ‘কবিতা’ পড়তে থাকে। মনে মনে ভাবে বাবা কেন তার নাম কবিতা রেখেছিল। সে জন্যই কি ‘কবিতা’ এত ভালো লাগে তার। কবিতা তাই আবার গায়-
“রজনী শাওন ঘন ঘন দেয়া গরজন
রিমি ঝিমি শব্দ বরিষে”
অথবা
“কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ, গোলাম মোস্তফা কোনটাই বাদ যায় না।
কবিতা আবৃত্তি করেই চলেছে। মাঝে মাঝে দৃষ্টি মেলছে দূর সীমানায়। দেখছে বৃষ্টিতে প্রকৃতির অবগাহন। সব গ্লানি ধুয়ে কেমন নীরব প্লবতায় একাকার হয়ে আছে। দুষ্টু ছেলেরা বৃষ্টির পানিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কখনো মেঘের গর্জনে চমকে চমকে উঠছে। দেবদারু গাছে ভেজা কাক ডানা ঝাপটাচ্ছে। দেখতে দেখতে কবিতা শৈশবে ফিরে যায়-
বাবার কোলে বসে বৃষ্টির পানিতে কাগজের নৌকা ভাসায়। বাতাসের ছোঁয়ায় নৌকা ভেসে চলে। কবিতা খিল খিল করে হাসি তোলে। নূপুর পা টিপে টিপে পাশে এসে দাঁড়ায়। কবিতা খুশি হয়ে যায়।
: দেখো আব্বু নূপুর এসেছে। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
: তাই নাকি? তা নূপুর তুমি কেমন আছো? বৃষ্টিতে মজা করবে বুঝি! তাহলে এই নৌকাটা তুমি ভাসাও।
নূপুর মিষ্টি করে হাসে। এবার দু’জনের নৌকা ভেসে চলে। তারপর যখন বিকেল শেষে বৃষ্টি থেমে মিষ্টি রোদ্দুর বেরুলো, তখন ওদের মনে আনন্দ আর ধরে না। দু’জনে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে পড়ে। মাঠজুড়ে পানি। দু’একটি ছেলে মাঠের সেই পানিতে নেমে আনন্দ কুড়াচ্ছে। এমন সময় প্রজাপতির সাত রঙ পাখায় ভর করে রংধনু ভেসে ওঠে আকাশে। রঙের খেলায় দু’বন্ধু আরো রঙিন হয়ে ওঠে।
সেদিন সন্ধ্যায় ঘন ঘোর বরষায় বৃষ্টি ভেজা একটি বিড়াল ছানা মিউ মিউ শব্দ তোলে। কবিতা দরজা খুলে দেয়। মা-বাবার বারণ শোনেনি সে। ছানাটিকে কবিতা খেতে দেয়, ওম দেয়। ওই দিন রাতে গল্পের আসর বসে। বাবা ভিনদেশি ছেলেমেয়েদের গল্প করে। এভাবে বর্ষা চলে যায়। বাবাও পাড়ি জমান কর্মের তাগিদে ভিন দেশে।
গতবার কথা ছিল বাবা এলে সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাবার। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। বাবার সঙ্গে গ্রামের মেঠোপথে হাঁটা হলো না। বর্ষায় বিলের পানিতে নৌকা ভাসিয়ে শাপলা শালুক তোলা হলো না। টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ শোনা হলো না।’
মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারেন মা। তিনি মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ান। মেয়েকে কিছুটা প্রফুল্ল করতে ওর মাথায় হাত রাখেন। বলেন, মামণি! সামনে শরতে তোমার জন্মদিন; এবার জন্মদিনের অনুষ্ঠান করবো তোর, ছাত্রীরা সব উৎসুক হয়ে আছে।
: কী হবে জন্মদিনের উৎসব করে; বাবা যেখানে নেই !
: এভাবে বলে না মা! সুখ-দুঃখ নিয়েই তো মানুষের জীবন।
কবিতা মায়ের মুখের দিকে তাকায়। এবার নিজেকে কিছুটা সামলে নেয়। ভাবে মায়ের কষ্টও তো কম নয়। ‘ও’ মায়ের কথায় সায় দেয়।
: আচ্ছা কোরো। শরৎ আসতে এখনও ঢের বাকি।
লুবাবা ইয়াসমিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। স্বামীর শেষ চিঠিটা বুকে আগলে রেখে মেয়েকে বড় করছেন। তিনি ওর বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চান। “আমাদের মেয়ে একদিন অনেক বড় হবে। মানুষের মতো মানুষ হবে।” মাঝে মধ্যে মেয়ের আনমনা ভাব দেখে তিনি চিন্তিত হন। তখন মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। মেয়েকে সান্ত¡না দেন। বড় হবার স্বপ্ন দেখান।
কবিতা এবার ক্লাস টেন-এ পড়ছে। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। মা কত করে বারণ করেন, এখন টিউশনি করিস না। তোর লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। কিন্তু ‘ও’ শোনে না। বলে, বাচ্চাদের পড়িয়ে ওর প্রাণবন্ত সময় কাটে। ভালো লাগে।
কবিতা মেধাবী ছাত্রী। ও লেখালেখিও করে। স্কুল ম্যাগাজিনে যে বছর ওর ‘কবিতা’ ছাপা হয়েছিল, মা ওর বান্ধবীদের মিষ্টি খাইয়েছিলেন।
: মা জানো! শিশু পত্রিকা পাতা বাহারের সম্পাদক ফোন করেছিলেন। বর্ষা সংখ্যার জন্য আমার একটা ‘কবিতা’ চেয়েছেন।
সেই কবিতাটাই লেখার চেষ্টা করছি। কয়েক লাইন শুনবে ?
: অবশ্যই শুনবো মা।
কবিতা আবৃত্তি করে-
বৃষ্টি তুমি এসো
নজরুলের সৃষ্টি সুখের
উল্লাসে।
বৃষ্টি তুমি এসো
আমার মায়ের হাসি হেসে
প্রাণোচ্ছ্বাসে!!
আবৃত্তি শেষ হয়। মনের অজান্তে মায়ের দু’চোখ ভিজে ওঠে। গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা অশ্রু।
: ওমা, এ দেখি তুমিই বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করলে!
কবিতা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ওদিকে ড্রয়িং রুমে শিশুদের হইচই শোনা যায়। কবিতা সেদিকে এগিয়ে যায়। এ কী! বাচ্চাদের হাতে বৃষ্টি ভেজা থোকা থোকা কদম ফুল। ফুলের হলুদাভ দীপ্তি ছড়াচ্ছে ওদের চেহারায়। প্রতিটি মুখ যেন জ্বলজ্বল করছে। কবিতা খুশি হয়ে যায়। ‘ও’ শিশুদের সাথে আবারও গেয়ে ওঠে-
বৃষ্টি তুমি এসো
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।